আজ শুভ শ্রাবণী পূর্ণিমা। ২৫৬৫ বুদ্ধবর্ষের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রতের ৫ম গৃহী উপোসথ। আজ হতে ২৫০০ বছরেরও পূর্বে এমনি এক পূণ্যময় পূর্ণিমা তিথিতে মহাকারুণিক বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের তিনমাস পরে পঞ্চশত অহরত ভিক্খুসংঘের উপস্থিতিতে (ভবিষ্যতে মতভেদ না হবার জন্য) মগধরাজ অজাতাশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় অরহত মহাকশ্যাপ স্থবিরের সভাপতিত্বে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম সংগীতির মধ্যদিয়ে ধর্ম ও বিনয় ত্রিপিটকারে (বিনয়, সূত্র, অভিধর্ম) সুশৃ্ঙ্খলাবদ্ধ করেন। আর এভাবে করে দায়ক-দায়িকা সংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় মহান ভিক্খুসংঘ অদ্যাপি ত্রিপিটক সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু বর্তমান সময়ে দায়ক এবং ভিক্খু সংঘের সম্পর্কে এক ধরণের ছেদ বা ছন্দপতন, অনৈক্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে যা বৌদ্ধ সমাজের জন্য মোটেই সুখকর নয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে আমরা বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু! তার উপর নিকায়ভেদ, পার্বত্য বৌদ্ধ, আদিবাসী বৌদ্ধ, সমতলীয় বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ভাগে আমরা বিভক্ত। এ বিভক্ততার কারণে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাও প্রকট। পাশাপাশি নিয়ত অহংবোধ-মান, একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ-ভালবাসার অভাব, সম্প্রীতি-ঐক্য-সমন্বয়ের পথে অনগ্রসরতার কারণে আমরা বিভক্ত হতে হতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ছি। তথাপি সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের পথে না এগিয়ে জড়িয়ে পড়ছি দ্বন্ধ-বাক্-বিতন্ডাতায় এবং নিজেকে, নিজের মতকে উর্দ্ধে রাখার হীন চেষ্ঠায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, কুৎসা-নিন্দা রচনায় ব্যাপৃত। আর এভাবে ঘরের আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে, সুযোগ সন্ধানী, নিন্দুক, অহিতকামী ব্যক্তি-সম্প্রদায় আমাদের দুর্বলতাকে পুজিঁ করে একদিকে বুদ্ধের অহিংসা নীতিকে কটাক্ষ করছে, অন্যদিকে আমাদের অনৈক্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্য ধ্বংসে একের পর এক নীল নকশা এঁকে চলেছে।
অথচ মহাকারুণিক বুদ্ধ মানবের মঙ্গলার্থে সদা ঐক্য-সম্প্রীতি-মানবতা, স্নেহ, মায়া, মমতা, দয়া, করুণা, সহমর্মিতা, অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বোধ, সামাজিক কল্যাণ, নৈতিকতা ইত্যাদি সর্ব মানবধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন সাম্যনীতি। উৎপন্ন অবাঞ্ছিত সমস্যা সমাধানে বিচলিত না হয়ে অপ্রমত্তের সহিত উপশম করা জন্য সদা উপদেশ প্রদান করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মহাকারুণিক বুদ্ধের জীবনের একটি ঘটনা আলোকপাত করা হল- মহাকারুণিক বুদ্ধ সশিষ্যে কৌশাম্বীর ঘোষিতরামে অবস্থান কালে উদয়ন রাজার অগ্র মহিষী রাণী শ্যামাবতীর প্রতি মাগন্ধী সপত্নী ঈর্ষা-বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে বিবিধ প্রকারে তার অনিষ্ট করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে, রাণী শ্যামাবতীর একান্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি-পূজার পাত্র বুদ্ধ ও তৎ শিষ্য-প্রশিষ্যগণকে উদ্দেশ্য করে চোর চোর, হে অজ্ঞ, মুর্খ, গর্দভ, হে পশু, দুর্গতিগামী ইত্যাদি আক্রোশপূর্ণ বাক্য প্রয়োগে তিরষ্কার করে আত্মপ্রসাদ-আত্মতুষ্টি লাভেচ্ছু লোক নিযুক্ত করে তিরষ্কার করছে। এতে আনন্দ স্থবির তথাগত সমীপে বিচলিত স্বরে নিবেদন করলেন-
আনন্দ – ভন্তে, চলুন এ স্থান ত্যাগ করি; এখানে আর অবস্থান করা শ্রেয় হবে না।
বুদ্ধ – (বুদ্ধ স্নিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলেন) কেন, কী হয়েছে?
আনন্দ – ভন্তে, এখানকার লোকেরা ভিক্খুসংঘকে উদ্দেশ্য করে আক্রোশপূর্ণ বাক্য প্রয়োগে তিরষ্কার করছে। তা শুনে আমি অত্যদিক ব্যতীত।
বুদ্ধ – কোথায় যাবে আনন্দ?
আনন্দ – ভন্তে, চলুন আমরা এখান হতে অন্য কোথাও চলে যাই।
বুদ্ধ – সেখানকার লোকেরাও যদি তিরষ্কার করে?
আনন্দ – ভন্তে, তাহলে আমরা সে স্থানও ত্যাগ করব।
বুদ্ধ – আনন্দ, এরূপে আমাদের কতবার স্থান পরিবর্তন করতে হতে পারে; তার কী কোন নিয়ন্তা রয়েছে? তাছাড়া এরূপ করা তো ঠিক নয়। যেখানে উৎপন্ন হয়েছে অবাঞ্ছিত কারণ, সেখানেই হতে হবে এর উপশম। অতঃপর প্রয়োজনবোধে অন্যত্র গমণ করা শ্রেয়। এরূপ মৈত্রী বাণীতে মহাকারুণিক বুদ্ধ আনন্দ স্থবিরকে উপদেশ প্রদান করতঃ দেশনা করলেন-
“অহং নাগো’ব সঙ্গামে চাপাতো পতিতং সরং,
অতিবাক্যং তিতিক্খিস্সং দুস্সীলো হি বহুজ্জনো।”
অর্থাৎ, “সংগ্রামে অবতীর্ণ হাতির শরীরে ধনু-নিসৃত অজস্র শর এসে পড়ে, কিন্তু হাতি তা সহিষ্ণুতার সহিত সহ্য করে। তদ্রুপ আমিও সহিষ্ণুতার সহিত দুর্বাক্য সহ্য করব। কারণ এ জগতে দুঃশীল ব্যক্তিই সমধিক।” আনন্দ, শিক্ষার গুণে হাতি যেমন সুদান্ত হয় তেমনি আত্মসংযমী, সম্যক পথে পরিচালিত ব্যক্তি তিতিক্ষার গুণে দুর্জনের হীনবাক্যও সহ্য করেন। ক্ষমা, ন্যায়পরায়ণতা, ঐক্য-সম্প্রীতিতে সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হন।
বুদ্ধের উপরোক্ত উপদেশ হতে আমাদের শেখার অনেক কিছুই রয়েছে। এখানে সমস্যা সমাধানে সহিষ্ণু হবার শিক্ষা রয়েছে। রয়েছে ঐক্য-সম্প্রীতির শিক্ষা ইত্যাদি। বাধা আসবে শত, তবে কারণ অনুসন্ধানে মৈত্রী প্রেমে করতে হবে প্রতিহত। পরিশেষে, প্রার্থনা আজকের এ শুভ পূর্ণিমা তিথির পূর্ণ চন্দ্রের আলোয় আলোকিত হোক আমাদের চিত্ত জগত। দূর হোক অজ্ঞানতার অন্ধকার; পূর্ণ হোক অপূর্ণতা যত। মৈত্রী প্রেমে সুখ-দুঃখে একে অন্যের সাথী হয়ে জীবন হোক ধন্য। চলমান সমস্যা সমূহের হোক সৌম্য-সুন্দর সমাধান। প্রতি হৃদয়ে হোক সম্যক উপলব্ধির সঞ্চার। সকলের প্রতি রইল শুভ শ্রাবণী পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম্।