আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমগ্র বিশ্বে বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ একটি দিন। বৈশাখ বা বুদ্ধ পূর্ণিমার চাইতেও এ দিবসটির তাৎপর্য কোন অংশে কম নয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে গুরু পূর্ণিমাও বলা হয়। কেননা এ দিনেই বুদ্ধ প্রথম বারের মত গুরু আসনে বসে পাঁচজন ঋষিকে ধর্মদেশনার মাধ্যমে দীক্ষা দিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিনেই বুদ্ধ তাঁর নৈর্বাণিক ধর্মের প্রথম উদ্ঘোষ করেছিলেন বলে এ পূর্ণিমাকে ধর্মপূর্ণিমা বা ধর্মজয়ন্তী নামেও অভিহিত করা যেতে পারে। এদিনেই ভগবান মহাকারুণিক বুদ্ধ ধরাধামে পবিত্র মহান সঙ্ঘরত্নের জন্ম দিয়েছিলেন। অতএব, এ পূর্ণিমাকে সঙ্ঘ জয়ন্তী দিবসরূপেও নির্ণয় করা যেতে পারে।
এগুলি ছাড়াও এ মহান দিনটি যে সমস্ত ঘটনাবলীর জন্য স্মরণীয় ও সমুজ্জ্বল সে সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।
১) এ পূর্ণিমা বাংলা আষাঢ়-শ্রাবন মাসে এবং ইংরেজী জুলাই মাসেই হয়ে থাকে।
২) বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায় বুদ্ধত্ব লাভ করে তথাগত বুদ্ধ এ পূর্ণিমার দিনে বারাণসীর ঋষিপতন সারনাথের মৃগবনে পঞ্চবর্গীয় ঋষিদেরকে প্রথম বারের মত ধর্ম শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেন।
৩) ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্র দেশনা সম্পন্ন করার পরে ভদন্ত কৌণ্ডণ্য থের সংঘের মধ্যে প্রথম অরহত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ বুদ্ধের পরে ভদন্ত কৌণ্ডিণ্যই প্রথম অরহত হন এ দিনে।
৪) এদিনে ভগবান বুদ্ধ মানব জাতিকে প্রথম ধর্ম শিখিয়েছেন। সারনাথের যে স্থানে বুদ্ধ প্রথম বারের মত ধর্ম শিখিয়েছিলেন সে স্থানে ঐতিহাসিক ‘ধামেক স্তূপ’ অদ্যাবধি বিরাজমান রয়েছে।
৫) এ পূর্ণিমার দিনে মহারাণী মহামায়া দেবীর গর্ভে ভাবী বুদ্ধের প্রতিসন্ধি হয়েছিল। ভারতরত্ন বোধিসত্ব বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর তাঁর মহান কৃতি ‘ Buddha and His Dhamma’ নামক পুস্তকে ভাবী বুদ্ধের প্রতিসন্ধি গ্রহণের চিত্রকে নিম্নোক্তভাবে মার্মিক বর্ণনা করেছেন-
শাক্যরা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমাকে উপলক্ষ্য করে এ উৎসবের আয়োজন করতেন। এ উৎসব মহাসমারোহে সাতদিন পর্যন্ত চলত। রাণী মহামায়া একবার এ উৎসবকে খুবই ভব্য পদ্ধতিতে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নানা রকমের সুগন্ধি যুক্ত মালা, ফুল এবং বিবিধ বর্ণের পতাকাদিতে নগর সুসজ্জিত করে নিজেও উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করেছিলেন। উৎসবের সপ্তম দিনে তিনি খুব ভোরে শয্যা ত্যাগ করে সুগন্ধি যুক্ত জলে স্নানাদি সম্পন্ন করে চার লক্ষ মুদ্রা সাধু-সন্ত ও দীন-দু:খীদেরকে মুক্ত হস্তে উদারচিত্তে দান দিয়েছিলেন। নিজেকেও বহুমূল্য অলঙ্কারাদি দ্বারা সজ্জিত করেছিলেন। নিজের পছন্দ মাফিক উত্তম ভোজন গ্রহণ করেছিলেন এবং সেদিন রাত্রে শয়নের জন্য কল্পনাত্মকরূপে উত্তম শয্যা প্রস্তুত করেছিলেন এবং রাত্রে শয়ন কক্ষে প্রবেশ করলেন।
সে রাত্রিতে মহারাজ শুদ্ধোদন এবং মহারাণী মহামায়া একাকী হলেন এবং মহারাণী মহামায়াদেবী প্রতিসন্ধি গ্রহণ করে গর্ভবতী হলেন। সে রাত্রিতে নিদ্রার সময় রাণী এক মাঙ্গলিক স্বপ্নে বিভোঢ় হয়েছিলেন।
তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, চারি লোকপাল দেবতাগণ এসে তাঁকে ঘুম হতে তুলে এক অলঙ্কৃত মঞ্চে উঠালেন এবং তাঁকে হিমালয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁকে এক বিশাল শালবৃক্ষের নীচে রাখলেন।
তথায় চারি লোকপাল দেবগণের স্ত্রীগণ এসে মহারাণী মহামায়াকে ধূপ এবং সুগন্ধি পুষ্ফ দ্বারা অলঙ্কৃত করলেন। যেন কোন দৈবশক্তিকে স্বাগত জানাতে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে মনে করতে পারেন।
তখন সুমেধ নামে এক বোধিসত্ব তাঁর সামনে প্রকট হয়েছেন এবং তিনি বললেন-‘ আমি এ ধরাতলে স্বীয় অন্তিম জন্ম নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি কি আমার মা হতে সম্মতি আছেন?’ রাণী সানন্দে উত্তর দিলেন-‘এর থেকে খুশীর সংবাদ আমার আর কী আছে।’ ঠিক এমনি মঙ্গল মুহূর্তের সময় রাণীর নিদ্রাভঙ্গ হল।
এখানে স্মরণ যোগ্য যে, এ সাতদিন উৎসবের সময় মহারাজা ও মহারাণী কোন রকমের সুরাদি পানে লিপ্ত ছিলেননা। উৎসবের সপ্তম দিনে তাঁরা দান এবং শীলে নিবিষ্ট ছিলেন। এ ঘটনা হতে ইহা স্পষ্ট বলা যায় যে, যে সকল লোক সমগ্র সংসারের উপদেশক হয়ে থাকেন, তাঁরা শীলবান ও শীলবতী পিতা-মাতা হতেই জন্ম নিয়ে থাকেন।
৬) এ পূর্ণিমার দিনে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম ২৯ বছর বয়সে মহাভিনিষ্ক্রমণ অর্থাৎ গৃহত্যাগ করে প্রব্রজ্যা নিয়েছিলেন। ইহাকে মহাভিনিষ্ক্রমণ বা Great Renunciation বলা হয়।
৭) এ পূর্ণিমার দিনের বর্ষাঋতু হতে প্রথমবার তথাগত বুদ্ধ তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘকে বর্ষাবাস শুরু করতে নির্দেশ জারী করেছিলেন। বুদ্ধ নিজেও পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের সঙ্গে প্রথম বর্ষাবাস সারনাথে অধিষ্ঠান করেছিলেন। সে সময় হতে এখনও পর্যন্ত ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ বর্ষা তিন মাস এক স্থানে অবস্থান করে নিবিষ্টভাবে ধর্ম ও ধ্যান চর্চা করে আসছেন। এ সময় তাঁরা লম্বা সময়ের জন্য কোন দূরবর্তী স্থানের যাত্রা হতে বিরত থাকেন। বর্ষার সময়ে উপাসক-উপাসিকারাও অধিকতর ধর্মানুশীলনে মনোযোগী হয়ে থাকেন। প্রতি পূর্ণিমা, অমাবশ্যা ও অষ্টমী তিথিতে তাঁরা নিকটস্থ বিহারে সমবেত হয়ে তন্ময়তার সাথে অষ্টশীল পালন, ধর্মাধ্যয়ন ও ধ্যান অনুশীলন করে থাকেন এবং বিশেষ দানাদি পুণ্যক্রিয়া করার মাধ্যমে যথাসম্ভব শুদ্ধ ও পবিত্র জীবন যাপন করে থাকেন।
৮) এ পূর্ণিমার দিনে ভগবান বুদ্ধ তাঁর জন্মদাত্রী মাতা মহামায়াদেবীকে ধর্ম দেশনা প্রদান করার জন্য তাবতিংস দেবলোকে গিয়ে সপ্তম বর্ষাবাস তথায় অবস্থান করে দেবপুত্ররূপী মাতাকে উপলক্ষ্য করে সমস্ত তাবতিংসবাসী দেবগণকে তিনমাসব্যাসী ‘অভিধর্ম’ দেশনা করে মাতৃঋণ পরিশোধ করেছিলেন। বুদ্ধ কর্তৃক এদিনে দেবলোকে অভিধর্মের দেশনা শুরু করা হলে তা তিনি তিন মাস পর মর্ত্যলোকে এসে আবার তাঁর অগ্রশ্রাবক ও ধর্মসেনাপতি ভদন্ত সারিপুত্র স্থবিরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। সে পরম্পরা অনুসারে অন্যান্য বৌদ্ধ দেশ সমূহেও বর্ষাবাস তিন মাসে অভিধর্মের শিক্ষা এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা হতে শুরু করা হয়।
৯) এ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিনে ভগবান শ্রাবস্তীতে গণ্ডম্ববৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব জীবনের দুর্লভ ‘যমক প্রতিহার্য ঋদ্ধি’ প্রদর্শন করেছিলেন, যা সমগ্র বুদ্ধ জীবনে একবার মাত্রই প্রদর্শিত হয়।
১০) ভগবানের মহাপরিনির্বাণের তিন মাস পরে এ আষাঢ়ী পূর্ণিমার মহামঙ্গল দিনেই মগধের রাজধানী রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপর্ণী গুহায় পাঁচশত অরহত ভিক্ষুর উপস্থিতিতে পবিত্র বুদ্ধ বাণী সংগ্রহ ও পাঠের জন্য ‘প্রথম সঙ্গায়ন’ বা প্রথম বৌদ্ধধর্ম সঙ্গীতির অানুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল এবং তা পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত চলমান ছিল।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দৃষ্টিপাত করলে আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য ও গুরুত্ব বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বুদ্ধজয়ন্তী হতে কোন অংশে কম নয়। বুদ্ধ রত্নের আবির্ভাব বৈশাখী পূর্ণিমায় যেমন হয়েছিল, তেমনি বৌদ্ধদের আরাধ্য ত্রিরত্নের মধ্যে অপর দু’ রত্ন অর্থাৎ ধর্ম ও সঙ্ঘ রত্নের আবির্ভাব হয় এ আষাঢ়ী পূর্ণিমার মহাপুণ্য লগ্নে। সেজন্য অতীব ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে এবং সমধিক মাহাত্য সহকারে দিবসটি পালন করা প্রত্যেক বৌদ্ধদের অবশ্য কর্তব্য। এদিনে অন্যান্য দিনের চেয়েও আরও নিবিষ্টভাবে দান-শীল ও ভাবনাদি কুশল কর্ম সম্পাদন করা বৌদ্ধদের আবশ্যিক করণীয়।