মোগলমারী বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব নিয়ে দুটি ব্যাখ্যা বর্তমান। প্রথমটি হল প্রাচীন ভারতে সম্পর্কে চৈনিক পর্যটকদের বিবরণ।চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন (খ্রি ৩৩৭-৪২২) থেকে হিউয়েন-সাঙ (খ্রি ৬০২-৬৬৪) সবাই ভারতের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে বিভিন্ন রকমের তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হিউয়েন-সাঙ তাঁর ‘সি-ইউ-কি’ গ্রন্থে বঙ্গদেশে চারটি অঞ্চলের বর্ণনা করেছিলেন- পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্ত। এই তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের দশটি বৌদ্ধবিহার ও এক হাজার বৌদ্ধসন্ন্যাসীর উপস্থিতির কথাও তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়। তবে এই অঞ্চলে মোগলমারী ছাড়া অন্য কোন বৌদ্ধবিহার এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
মোগলমারীতে বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্বিতীয় ধারনাটি পাওয়া যায় বর্ধমানের লোককবি ফকির রাম রচিত ‘সখীসেনা’ কাব্য থেকে। অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক এটিকে জনশ্রুতি বলেছেন। ফকির রামের মতে এই গ্রামটির প্রাচীন নাম ছিল ‘অমরাবতী’। এই অঞ্চলে বিক্রমকেশরী নামে এক সামন্তরাজা ছিলেন। সখীসেনা নামে সেই সামন্ত রাজার কন্যা একসময়ে এখানে অধ্যয়ন করতেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকেই ‘সখীসেনার পাঠশালা’ নামে বর্ণনা করেছেন। অতীতের সেই মুখর পাঠশালা আজ পলিমাটির উপরে ক্ষুদ্র ভগ্নস্তূপ রূপে বিরাজমান। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে এই মোগলমারী অতীতের এক বিস্ময়কর রত্নভাণ্ডার, যা আজ সখীসেনার পাঠশালার সকল জনশ্রুতির দ্বিধাদ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে অবস্থিত অন্যান্য বৃহৎ ও প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলির মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে।
মোগলমারী বৌদ্ধবিহারের আবিষ্কারের ইতিহাসও খুব চমকপ্রদ। প্রাচীন নদী-বাণিজ্য বিষয়ে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের অনুসন্ধান চালানোর জন্য ১৯৯৯ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতনে আসেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ড. অশোক দত্ত। তিনি দাঁতন স্কুলের প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সহায়তায় দাঁতন ১নং ব্লকের মোগলমারী গ্রামে ‘সখীসেনা ঢিবি’ নামে একটি ঝোপজঙ্গলে আচ্ছাদিত একটি পরিত্যাক্ত ঢিবির সন্ধান পান। এইখানে ইটের তিনটি গোলাকার স্তূপের অংশ এবং গ্রামবাসীদের কাছে সযত্নে সংরক্ষিত পোড়ামাটির গোলাকার উৎসর্গ ফলক মিলেছে যার উপর খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠশতকের ব্রাহ্মীলিপিতে এবং মিশ্রসংস্কৃত প্রাকৃত ভাষায় লেখা রয়েছে। এখানে প্রাপ্ত বৌদ্ধধর্মের অতি প্রাচীন বাণী ‘হে ধর্ম হেতু প্রভব’ এবং ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় মস্তকহীন বৌদ্ধমূর্তি এখানকার বৌদ্ধনিদর্শন সংক্রান্ত ধারণাকে যথেষ্টভাবে সুদৃঢ় করেছে।
ড. অশোক দত্ত’র নেতৃত্বে প্রথম এখানে পাঁচটি পর্যায়ে (২০০৩-২০১২) খননকার্য চালানো হয়। পরবর্তী তিনটি পর্যায়ে (২০১৩-২০১৬) খননকার্য পরিচালিত হয় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে। এই পর্যায়ে খননকার্য শুরু হয় মূলত ঢিবির উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে। এই খননকার্যে প্রাপ্ত উপকরণগুলি (মূলত নকশাযুক্ত ইট, বৌদ্ধভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের কুঠুরি, ত্রিরথ কাঠামোযুক্ত নকশা ইত্যাদি) থেকে মনে করা হয় যে এখানে একটি মন্দির বা গর্ভগৃহ ছিল। এছাড়াও এখানে কৃষ্ণ ও লোহিত মৃৎপাত্রের নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে।
স্টাকোযুক্ত দেওয়াল, খণ্ডবিখন্ড বৌদ্ধমূর্তি, লৌহ সামগ্রী, ষষ্ঠ শতাব্দীর সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিল, প্রদক্ষিণ পথ, বৌদ্ধস্তূপ, পাথরের মূর্তি, তামার মুদ্রা, বৌদ্ধবিহারের মূল প্রবেশদ্বারের উভয়দিকের দুটি সমায়তনের বৃহৎ কক্ষ, ইটের কারুকার্যমণ্ডিত স্তম্ভযুক্ত কুলুঙ্গি, চুনের প্লাস্টারযুক্ত মেঝে, পোড়ামাটির প্রদীপ, আতরদানি, কারুকার্যমণ্ডিত ছিদ্রযুক্ত নল, গুপ্তোত্তর যুগের নকশাযুক্ত মৃৎপাত্র, ১৩টি স্টাকোর মূর্তি (মঞ্জুশ্রীর, কুবেরজাঙ্গুলি, অবলোকিতেশ্বর, লোকেশ্বর গান্ধর্ব, নৃত্যরত মানব-মানবী ও গণমূর্তি), মস্তকহীন বুদ্ধমূর্তি, রাজা সমাচার দেবের মিশ্রধাতুর মুদ্রা, সোনার লকেট, লোহার কাঁটা, তামার বালা, আংটি, হাতির দাঁতের জপমালা, ৯৫টি ব্রোঞ্জের মূর্তি (২৫-৩০টি বৌদ্ধমূর্তি ছাড়াও, হারিতি, তারা, সরস্বতী প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি), স্বর্ণমুকুটের অংশ, ধাতুর ধুনুচি, কমন্ডলু, ধাতব বস্তু, খেলনা গাড়ির চাকা, নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির অলঙ্কার, পাথরের মূর্তি-ভাস্কর্য ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এখানে একটি ফলক উৎকীর্ণ করা রয়েছে যাতে লেখা আছে ‘শ্রীবন্দক মহাবিহার আর্যভিক্ষু সংঘ’।
মোগলমারী বৌদ্ধবিহারটি বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর তথা দাঁতন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ইতিহাসচেতনাকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানে অসংখ্য মানুষ বাইরে থেকে এই প্রত্নক্ষেত্র দর্শন করতে আসছেন। ঐ এলাকায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় প্রশাসনও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকরণে ও এই নিদর্শনগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে খুব আগ্রহের সাথে কাজ করে চলেছে। এখানে ‘সখীসেনা ঢিবি’ নামে একটি ছোট্ট সংগ্রহশালাও গড়ে তোলা হয়েছে।
বর্তমানে এই এলাকাতে অনেক দোকানপাটও নির্মাণ করা হয়েছে যা সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বছলতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠেছে। ঐ গ্রাম ও তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষ এখন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পেলে তা আর পূর্বের মতো অবহেলায় ফেলে দেন না বরং তা যত্নসহকারে নির্দ্বিধায় সংগ্রহশালায় জমা দেন যা তাদের বর্ধিত ইতিহাস চেতনার সাক্ষ্য বহন করে।
স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে এই বৌদ্ধবিহারটির আবিষ্কার এই এলাকার সাধারণ মানুষকে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত করে তুলেছে । ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের আরও প্রসার ঘটলে ও তা বিশ্বআঙিনায় স্থান পেলে এই অঞ্চলের গুরুত্বও যে অনেকখানি বেড়ে যাবে সে সম্পর্কে এলাকাবাসী যথেষ্ট সচেতন।
মোগলমারীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের ফলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির যে এক নতুন দিক উন্মুক্ত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতদিন এই অঞ্চলের বৌদ্ধ সংস্কৃতির যে ধারা শুধুমাত্র জনশ্রুতি ও চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-য়েন-সাঙ-এর বিবরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে তাম্রলিপ্তসহ এই এলাকার ইতিহাসকে আবারও এক নতুন রূপ দিয়েছে। এছাড়াও এই এলাকায় যে আরও অনেক ছোট-বড় বৌদ্ধপ্রত্নক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যা এখনও অবধি উৎখনন করা সম্ভব হয়নি সেগুলো উৎখননের ক্ষেত্রে এই প্রত্নক্ষেত্র যথেষ্ট উৎসাহ সঞ্চার করবে বলে আশা করা যায় ।
মোগলমারীর প্রত্নক্ষেত্রটি ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল-এর বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাথে সাথে বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের এক নতুন আঙ্গিক তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ সংস্কৃতি নতুন করে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের রূপ নিয়ে আবারও নব আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে যা বর্তমান ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলির বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস চর্চার জন্য নিঃসন্দেহে সদর্থক বার্তা বহন করে আনবে বলে আশা করা যায়।
ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক। রামকৃষ্ণ জানা, ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধান অনুষদ (নয়া দিল্লী) প্রদত্ত গবেষণা প্রকল্পের ক্ষেত্র সমীক্ষক।