“আমি বুদ্ধের নামে গেরুয়া বসনে পঞ্চশীল শুনাবো আমি বুদ্ধের নামে সংকীর্তনে সারাটি বিশ্ব ঘুরিব। অহিংসা মন্ত্রে অশান্ত পৃথিবী; শান্ত করিয়া দেব।”
শাক্যমিত্র বড়ুয়ার কীর্তনের হৃদয়স্পর্শীয় এইটুকু চরণখানির ভাবাবেগ একটি কাল্পনিক চরিত্র দাঁড় করালেও বর্তমানে আমাদের মাঝে লুকিয়ে আছে প্রতিভাবান অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা বৌদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তাদের ভিড়ে অন্যতম “ভিক্ষু শরণাপালা”। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এই প্রতিভাবান ভিক্ষু দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। অর্জন করেছেন বহুবিধ শিক্ষা এবং সুখ্যাতি। অবশ্য এইটুকুখানি অবস্থানে পৌঁছতে ভিক্ষু শরণাপালাকে স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ; দিতে হয়েছে অনেক শ্রম এবং অধ্যবসায়। “আরবান বুড্ডিস্ট মংক” হিসেবে খ্যাত এই বৌদ্ধসন্ন্যাসীর ঝুলিতে রয়েছে বিবিধ শিক্ষা সনদ, পদক, সম্মাননা স্মারক ইত্যাদি।
ভান্তের সাথে আমার তেমন সুসম্পর্ক না থাকলেও রীতিমত উনার কর্মকান্ডে আমি বেশ উৎসাহী। উনার ফেইসবুক পেইজ “ভান্তে শরণাপালা” একাউন্টে উনার দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের খবরাখবর বেশ আলোচিত এবং প্রশংসনীয়। ভান্তেকে জানার এবং জানানোর আগ্রহে আমি উনাকে একটি ছোট্ট বার্তা প্রেরণ করি উনার ফেইসবুক পেইজে। সময় না গড়াতেই উনার প্রত্যুত্তর। ভান্তের সরল সহজ বার্তা- তিনি বাংলা ভাষায় লিখার ব্যাপারে তেমন দক্ষ নন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, শিক্ষা এবং সন্ন্যাসজীবনের গাঁথা আমায় ধারাবাহিকভাবে পাঠালেন। সেখান থেকে কিছু সারমর্ম উপস্থাপন করার দুঃসাহস দেখালাম।
চট্টগ্রামের ছোট্ট গন্ডি পেরিয়ে শ্রামণ্যবেশে ধর্মীয় শিক্ষার্থে তিনি গমন করেন শ্রীলংকার ক্যান্ডি শহরে। প্রিমরোজ গার্ডেন শাখায় যোগদানের সুবাদে শ্রীলংকার সুপ্রাচীন পবিত্র নগরী ক্যান্ডিতে “ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সন্ন্যাসধর্ম” বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। বৌদ্ধিক চর্চা এবং ধর্মাচরণের দূর্গম পথ অতিক্রমে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন সর্বাধিক পূজ্য মাদিথে পঞঞশিলা মহানায়েকার। তারই উপাধায়িত্বে তিনি লাভ করেন ভিক্ষু জীবন। আচার্য্যগুরু হিসেবে ছিলেন আমারাপুরা সেক্টরের প্রধান শ্রী রাহুলা মহানায়েকা থেরো মহোদয়। “প্রাচ্যভাষা এবং বৌদ্ধধর্ম” বিষয়ে তিনি স্মাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন পেরেদানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে। বুড্ডিস্ট স্ট্যাডিজ (বি.এ)-এ অধ্যয়ণরত অবস্থায় তিনি আইসল্যান্ডের হ্যালোয়েড ওরিয়েন্টাল লেংগুইজ ইনস্টিটিউটে পালি, সিংহলিজ এবং সংস্কৃত ভাষার উপর “লাউড রয়েল পন্ডিত” ডিগ্রী লাভ করেন। শ্রীলংকায় দীর্ঘকাল শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন শেষে তিনি কানাডার মিসিসাউগাতে ওয়েস্ট এন্ড বুড্ডিস্ট মনেস্টারীতে বিহারাধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রাপ্ত হোন। তারপর ভর্তি হোন কানাডার সুবিখ্যাত টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালের দিকে তিনি পাশ্চাত্য দর্শন এবং ধর্মবিষয়ে বিবিধ ডিগ্রি অর্জন করেন। গর্বের বিষয় যে, তিনি সেই বছরেই ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাজক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। এর দু’বছর পর তিনি সফলতার সাথে হামিল্টনের এম.সি মার্স্টাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “বুড্ডিস্ট স্ট্যাডিজ”র উপর মার্স্টাস ডিগ্রী লাভ করে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত হোন। পাশাপাশি বৌদ্ধধর্ম বিষয়ের উপর গবেষণা শুরু করেন।
মিসিসাউগা বিহারের ব্যানারে তিনি সেখানে চালু করেন “সানডে ধাম্মাস্কুল” এবং “স্যুপ কিচেন প্রজেক্ট”। সুদীর্ঘ ১৫ বছরের এই কার্যক্রমে প্রিন্সিপাল পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন যেখানে সহযোগিতায় ছিল ডাউনটাউটে খ্রীট সেন্টার। এছাড়াও তিনি বেশ আলোড়ন তুলেন বুদ্ধের অবিশ্বস্মরণীয় স্মৃতিপ্রস্থান ভাবনাকে সাপ্তাহিক চর্চায় স্নায়ুন্দ্রিয়কে সচল এবং কর্মক্ষম করার প্রয়াস দিয়ে। সাথে যুক্ত ছিল তাঁর গবেষণধর্মী বাস্তবমুখী ধর্মালোচনা। তিনি সেখাকার লোকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন বুদ্ধের আদিষ্ট পঞ্চশীলের শুদ্ধতা এবং সততার প্রভাব দিয়ে। উনার প্রতিটা সাপ্তাহিক ধ্যান ক্লাশে শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষার্থীরাই নয়, কানাডিয়ান পুলিশ ফোর্স, অবসরপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তারাও উৎসাহী হয়ে মিসিসাউগা বিহারে আসেন। বুদ্ধের মহামন্ত্রে শান্ত হতে সকলের প্রবল এই উদ্দীপনাকে মঙ্গলসুতোয় গেঁথে ভান্তে শরণাপালা ছড়িয়ে দিয়েছেন বুদ্ধের জয়ধব্বনি। “বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি”, “ধম্মং সরণং গচ্ছামি”, “সঙ্ঘং সরণং গচ্ছামি”র মৌনকন্ঠে মুখরিত মিসিসাউগা শহর কেন! এক সময় কানাডা রাজ্য পেরিয়ে সারাবিশ্বে শান্তির বার্তা ছড়াবে ভিক্ষু শরণাপালাদের মত পুজ্য ভিক্ষুরা। একটি বিষয় উলেখ না করলেই নয়; ভিক্ষু শরণাপালা ধর্মবিষয়ে দক্ষতা লাভ, বিশ্বপরিভ্রমণ ছাড়াও কানাডার রাজনৈতিক গন্ডিতেও বেশ প্রভাব বিস্তার করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি অরেন্টো সংসদে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পান। এবং পরের বছরই তিনি লাভ করেন অরেন্টো সরকারের পক্ষ থেকে “অরেন্টারিও পুরস্কার”। মানবিক সাহায্য এবং সহযোগিতার প্রমাণে তিনি লাভ করেন “স্প্রিরিট আওয়ার্ড”। টরেন্টো পিন এরিয়া সিটি কাউন্সিলর ও ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডের প্রিন্সিপাল ধ্যান রিসোর্সের প্রোগ্রামে তিনি ভূষিত হোন “শ্রেষ্ঠ বক্তা”র সম্মানে। সুন্দর উপস্থাপন এবং হাস্যোজ্জ্বল মুখ দিয়েও তিনি জয় করেছেন অনেক মানুষের হৃদয়। বুদ্ধের শিক্ষা এবং আদর্শকে গঠনমূলক উপমা ও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার এই গবেষণাধর্মী গুণ ভান্তেকে করেছে অনেক জনপ্রিয়। ভিক্ষু শরণাপালার মতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বুদ্ধ কুলপুত্ররা উড়াচ্ছে বুদ্ধের মৈত্রী আর শান্তির নিশান। ভিক্ষু আমাদের অহংকার; আমাদের গৌরব। আমরা গুণবান, প্রতিভাবান, ধ্যানী-জ্ঞানী ভিক্ষুদের মাথার শিরোমনি করে রাখব শ্রদ্ধাভরে। ভিক্ষু শরণাপালার মত আরো অনেক ভিক্ষুরা নিজ পরিবার পরিজন ছেড়ে একাকী কষ্ট, তিতীক্ষা আর যাতনার মধ্য দিয়ে ধর্ম-ধ্যান-জ্ঞান লাভে নিঃস্বার্থভাবে আত্মবিসর্জন দিচ্ছে। আমাদের উচিত সেইসব ধব্বজাধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পুজা সৎকার করা। তাই বুদ্ধের উপদেশে স্মরি…….
“অসেবনা চ বালানং, পণ্ডিতানঞ্চ সেবনা,
পূজা চ পুজনীযাং, এতং মঙ্গলমুত্তমং।”
মূর্খের সেবা নয়; পন্ডিত ব্যক্তির সেবা এবং পূজনীয়দের পূজায় মঙ্গল বয়ে আসুক জীবনে।
আসুন আমরা পুজনীয়দের চিনতে শিখি; পুজা করি, সেবা করি। সকলের জয়মঙ্গল হোক।