মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর আব্দুল্লাহপুরের নাটেশ্বর গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন ‘রেলিক চেম্বার’ বা ‘স্মারক কুঠুরি’। আরও আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮০ বর্গমিটার আকৃতির দুটি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ, ১৭ মিটার সুরক্ষা প্রাচীর ও নকশা করা ইট। গবেষকরা জানিয়েছেন, অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের কেন্দ্রে বিশেষ ধরনের স্থাপত্য ‘স্মারক কুঠুরি’ একটি দুষ্প্রাপ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার। যেখানে গৌতম বুদ্ধ বা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ শিষ্যের দেহভস্ম বা ব্যবহৃত জিনিস রাখা হতো। বাংলাদেশে এ ধরনের আবিষ্কার এই প্রথম।
বুধবার (৩ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি এসব তথ্য দেন। বেলা সাড়ে ১১টায় টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামের প্রত্নস্থানে সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী।
বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচি পরিচালক ড. নূহ-উল-আলম লেনিন ও গবেষণা পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠ করেন প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তিনি জানান, নাটেশ্বর দেউলে দ্বিতীয় সভ্যতার স্তর (৯৫০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ) এর আগে এবং এবার যে আবিষ্কার হলো তা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করে যে নাটেশ্বর প্রত্নস্থানে ছিল দশম-একাদশ শতকে একটি বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ স্তূপ কমপ্লেক্স যা বাংলাদেশে এই প্রথম। বিগত বছরের আবিষ্কারগুলোর মধ্যে ছিল ২৫ দশমিক দুই বর্গমিটার আকৃতির বৃহৎ আকারের নান্দনিক কেন্দ্রীয় অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ। এটির চারপাশে ১৮ বর্গমিটারের চারটি স্তূপ হলঘর। প্রতিটি হলঘরে আবার আড়াই বর্গমিটারের চারটি করে স্তূপ।
তিনি জানান, অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের কেন্দ্রে বিশেষ ধরনের স্থাপত্য ‘স্মারক কুঠুরি’ একটি দুষ্প্রাপ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার, যেখানে গৌতম বুদ্ধ বা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ শিষ্যের দেহ ভস্ম বা ব্যবহৃত জিনিস রাখা হতো। এর ওপরের অংশ গোলাকার ও নিচের অংশ চতুষ্কোণাকৃতি। বাংলাদেশে এ ধরনের আবিষ্কার এটাই প্রথম।
গবেষকরা বলছেন, স্মারক কুঠুরির গোলাকার অংশ বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্ব ‘শূন্যবাদ’-এর প্রতীকী রূপ। এছাড়া স্তূপের ভেতরের অংশটি নির্মিত হয়েছিল স্পোকযুক্ত গাড়ির চাকার আদলে। গোল চাকাই শূন্যের প্রতিরূপ এবং চাকা গতির প্রতীক। উলম্ব ইটের বিন্যাসকে চাকার স্পোকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। স্পোককে কল্পনা করা হয় সূর্যের রশ্মির সঙ্গে। ইতোপূর্বে ইট নির্মিত সুরক্ষা প্রাচীরের অংশবিশেষ পাওয়া গেলেও বিস্তৃতি বুঝা যায়নি। সুরক্ষা প্রাচীরটি যে পুরো স্তূপ কমপ্লেক্স জুড়েই ছিল, এবারের আবিষ্কারে তা অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। পুরো বসতিজুড়ে সুরক্ষা প্রাচীরও বাংলাদেশ এই প্রথম।
ইতোপূর্বে উৎখননে নকশা আকৃতির ইটের ভাঙা টুকরা পাওয়া গেলেও স্থাপত্যের সঠির অবস্থানে ইটের নকশা পাওয়া যায়নি। এবার সুরক্ষা প্রাচীরের বাইরের দেয়ালে একটি হলেও ইটের পূর্ণাঙ্গ নকশা সঠিক অবস্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। খননকালে হতাশার জায়গা ছিল নাটেশ্বরে পোড়ামাটির ফলক না আবিষ্কৃত হওয়া। কিন্তু নকশাকৃত ইটের ব্যবহার বুঝতে পেরে রহস্যটি উন্মোচিত হলো। অতীশের জন্মভূমিতে স্তূপ কমপ্লেক্সের দেয়াল অলংকরণের ক্ষেত্রে পোড়ামাটির ফলকের পরিবর্তে নকশাকৃত ইট ব্যবহৃত হয়েছে। যার কারণ গবেষকদের নতুন করে ভাবতে সহায়তা করবে।
সংবাদ সম্মেলনের আগে প্রতিমন্ত্রী মুন্সীগঞ্জে রঘুরামপুর ও নাটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পাঁচ মাসব্যাপী খননে যেসব প্রত্নবস্তু মিলেছে সেসব ঘুরে দেখেন প্রতিমন্ত্রী। প্রায় ১০ একর ঢিবিতে উৎখনন কাজ চলছে। এ সময় বিক্রমপুরী বৌদ্ধবিহার প্রত্নস্থান জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার, পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচির ‘কর্মসূচি পরিচালক’ ড. নূহ-উল-আলম লেনিন, গবেষণা পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।