বিশ্বজগতে মহাপুরুষগণ তার আপন শৈল্পিক সত্ত্বা, সমৃদ্ধ কর্মজীবন, মানবিক হৃদয়, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি গুণধর্মের সম্মিলিত প্রয়াসে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় জীবনকে মহীয়ান করে তোলে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন প্রদীপ্ত আলোকের ন্যায়। মায়ানমার সরকার কর্তৃক অগ্গমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধ্বজ, শ্রীলংকা থেকে ত্রিপিটক সাহিত্য চক্রবর্তী, থাইল্যান্ড থেকে ওয়ার্ল্ড পিস মডেল, জাপান থেকে সুপ্রিম বুড্ডিস্ট লিডার উপাধিপ্রাপ্ত, অতীশ দীপংকর ও বিশুদ্ধানন্দ অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য সম্মাননা-উপাধি-অভিধায় বিভূষিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু মহামান্য দ্বাদশ সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথেরো মহোদয়ও তাঁর মহিমান্বিত কর্মগুণে জীবনকে মহীয়ান করে অনন্তকাল ভাস্বর-দ্যুতিময় হয়ে থাকবেন।
১৯২৮ খৃষ্টাব্দের ১৭ জুন, রবিবার, পটিয়া থানার অন্তর্গত ঊনাইপুরা গ্রামে দানশীল পিতা মহিরাজ বড়ুয়ার ঔরসে, পুণ্যশীলা মাতা সুরবালা বড়ুয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন রসধর বড়ুয়া। ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি মহাপুরুষ আর্যশ্রবাক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাথেরো মহোদয়ের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। গৃহবাস ত্যাগের সাথেই গৃহীনাম পরিবর্তন হয়ে প্রব্রজিত নাম হয় শ্রীমান ধর্মসেন শ্রামণ। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দের ১৭ আশ্বিন আচারিয়া পূর্ণাচার সীমালয়ে আর্যশ্রাবক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাথেরো মহোদয়ের উপাধ্যায়ত্বে শ্রীমান ধর্মসেন শ্রামণ উপসম্পদা গ্রহণ করেন। নাম হয় ভিক্খু ধর্মসেন। জীবনকে গুণময় উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধ করার মধ্যদিয়ে ব্যাপৃত হতে থাকে ত্যাগময় এক মহাজীবন। পরমার্থ জ্ঞান, অভিধা, বরণ, পুণ্যকীর্তিতে বিশ্বময় এর স্বীকৃতিও মেলে। পরবর্তীতে একাদশ সংঘরাজ পণ্ডিত শাসনশ্রী মহাথেরো মহোদয়ের মহাপ্রয়াণের পর ২০০৪ খৃষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারী তিনি বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু দ্বাদশ সংঘরাজ হিসেবে অভিসিক্ত হন।
মাতৃ গর্ভাশয়ে নিরাপদে বড় হয়ে গঠনে পূর্ণতা পেলে জন্ম হয় একটি মানব শিশুর। পৃথিবীতে একটি নতুন জীবনের যাত্রা শুরু। যাত্রা শুরুর এই জন্ম শব্দটিতে আনন্দ আছে। একসময় এই আনন্দের শেষ হয় শোকে, চিরবিদায়ে, ব্যথায়, জীবনের মৃত্যুতে! সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথেরো মহোদয়ও জীবনের সেই অবধারিত সত্য, শ্বাশত অধ্যায়ের সম্মুখীন সেদিন। ২১ মার্চ, ২০২০ খৃষ্টাব্দ, সময় রাত ১২টা ৫৮মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর রয়েল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিভে গেল জ্ঞান বাতিঘর, এক মহাজীবন কাব্য। সদ্ধর্মের অনন্য এক পুরোধা, ক্ষণজন্মা মহাত্মা সংঘমনীষা, যাঁর আবির্ভাব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সম – তিনি সুদীর্ঘ ১৬ বছর বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু হিসেবে বৌদ্ধ জাতিকে ছত্রছায়া এবং সদ্ধর্মদানে আলোক সম দেদীপ্যমান রেখেছেন। আজ এবং আগামীকাল (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ খৃষ্টাব্দ) দু’দিন ব্যাপী যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও মহাসমারোহে পূজনীয় সংঘরাজের জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সাধনপীঠ ঊনাইনপূরা লংকারামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
হে মহাজীবন, গুরু মহোত্তম – আপনি নির্বাণগামী হোন, আপনার প্রজ্ঞা, মেধা, কর্ম-গুণ কীর্তি অনুপ্রাণিত করুক নব প্রজন্মকে, সেসাথে আপনার আশীর্বাদ আমাদের সম্মুখ পথচলার পাথেয় হোক। বিনম্র শ্রদ্ধা-বন্দনা, পুণ্যদান সতত।
মহামান্য দ্বাদশ সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথেরো
আবির্ভাবঃ ১৭ জুন, ১৯২৮ খৃষ্টাব্দ।
মহাপ্রয়াণঃ ২১ মার্চ, ২০২০ খৃষ্টাব্দ।