সপ্তম শতাব্দী থেকে ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমতে থাকে। তারপর দ্বাদশ শতকে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর হয় অন্তর্হিত। টিকে রইল শুধু উত্তরের হিমালয় অঞ্চলে। উনবিংশ শতকের অন্তিমে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান ঘটল। ব্রিটিশ পণ্ডিতদের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার অনাগরিক ধর্মপাল এই কর্মে নেতৃত্ব দিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মহাবোধি সোসাইটি। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে বৌদ্ধ তীর্থস্থান গুলির সংস্কার ও সংরক্ষণ। এই কাজে তারা যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেন। নির্মিত হয় বহু মন্দির এবং সেগুলি হয়ে উঠে ভিক্ষুদের আবাস।
১৯৫০ এর দশকে ভীমরাও আম্বেদকর দলিতদের মধ্যে নব বৌদ্ধ আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে জাতি ভেদের নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লক্ষ-লক্ষ দলিত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ২% হলেন বৌদ্ধ।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র কর্তৃক শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের প্রচারের সময় থেকে সে দেশ বৌদ্ধধর্ম চর্যার একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিগনিত হয়। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের একটি নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘকালীন ইতিহাস রয়েছে। এদেশেও যুদ্ধ এবং ষোড়শ শতক থেকে উপনিবেশিকতার সঙ্গে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারীদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণের ফলে বৌদ্ধধর্মের নিরবচ্ছিন্ন ধারাটি হয়েছে ব্যাহত।
ইংরেজ বিদ্বজ্জন এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তায় ১৯ শতকে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের জোরদার পুনর্জাগরণ ঘটল। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অধ্যয়ন, গৃহস্থ উপাসকদের জন্য ভিক্ষুদের ধর্মোপদেশ দানের ব্যবস্থা সহ তাদের জন্য ধ্যান সাধনায় সহায়তা ইত্যাদি করলে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধধর্মকে অনেক সময় “Protestant Buddhism” নামে অভিহীত করা হয়। ১৯৪৮ সনে এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তদ্পশ্চাৎ এই দেশে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির উপর প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে ৭০% শ্রীলঙ্কার নাগরিক হলেন বৌদ্ধ। তাদের অধিকাংশ থেরবাদ পরম্পরা অনুসরণ করেন। ৩০ বৎসর কাল অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের পর এখানে জাতীয়বাদী বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটেছে। বুদু বাল সেনার মতো কিছু সংগঠন মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংগঠিত করছে। উদারপন্থী বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ হয়ে উঠছেন তাদের আক্রমণের লক্ষ্য।
ঐতিহাসিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বার্মায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস দুই হাজার বছরের থেকেও বেশী পুরনো। ৮৫% মানুষ নিজেকে বৌদ্ধ হিসেবে পরিচয় দান করেন। এ দেশে প্রব্রজিত ভিক্ষুদের মধ্যে অধ্যয়ন ও ধ্যান সাধনার একটি অপূর্ব মেলবন্ধনের ঐতিহ্য রয়েছে। গৃহস্থ উপাসক উপাসিকাদের মধ্যেও দেখা যায় গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং তা একই রকম রয়েছে। এমনই একজন হলেন বিখ্যাত সত্য নারায়ণ গোয়েঙ্কাজী। তিনি বর্মা পরম্পরার একজন পূজনীয় সাধক।
ইংরেজদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সামরিক ও গণতান্ত্রিক শাসকগণ থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। সামরিক শাসনে বৌদ্ধধর্ম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বিরুদ্ধ মতবাদীদের মন্দির থেকে নিয়মিত বিতাড়ন করে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালের নৈতিক বিপ্লবের মতো ভিক্ষুদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সামনের সারিতে দেখা গেছে।
বিগত এক দশকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে, যারা ইসলামের বিরোধীতার সঙ্গে চেষ্টা করছে বৌদ্ধধর্মের পূনঃজাগরণ করার জন্য। ১৯৬৯ গোষ্ঠীর ভিক্ষুনেতা অশিন বিরাথু, স্ব-ঘোষিত “বার্মিজ বিন লাদেন” মুসলমান দোকান বয়কটের ডাক দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্ম রক্ষার নামে মসজিদ ও মুসলমানদের বাড়িঘর আক্রমণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ঘটনা। মুসলমানদের প্রত্যাঘাত আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করছে।
একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। বর্তমানে এই দেশে মোট জনসংখ্যা ১% এরও কম হলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা বার্মা সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেন। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে চারটি বৌদ্ধ মন্দির এবং পূর্বাঞ্চলের গ্রাম গুলিতেও অনেক মন্দির আছে। বার্মার তুলনায় এই দেশে বৌদ্ধ সাধনা ও চর্চার স্তর কিছুটা অনুন্নত বলা যেতে পারে।
দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার এই সাম্রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম আসে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে। লোকায়ত ধর্ম ও হিন্দুধর্ম প্রভাবিত হলেও এখানে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মহাযান পরম্পরা। একটি বিষয়ে এই দেশ শ্রীলঙ্কা ও বার্মার বিপরীত। এখানে কখনো ভিক্ষুণী সঙ্ঘ স্থাপিত হয়নি। এই দেশের জনসংখ্যার ৯৫% শতাংশ হলেন বৌদ্ধ। থাই ভিক্ষু সঙ্ঘ রাজতন্ত্রের অনুরূপ। সেই অনুরূপ পরম্পরার শুদ্ধতার রক্ষায় রয়েছে প্রধান স্থবিরদের নিয়ে গঠিত পরিষদ, যার নেতৃত্বে রয়েছে মহাস্থবির। এখানে গ্রামবাসী ও অরণ্যবাসী ভিক্ষু রয়েছে। তারা সকলেই গৃহস্থ উপাসক উপাসিকাদের পরম শ্রদ্ধা ভাজন।
অরণ্যবাসী ভিক্ষুগণ কঠোর সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। গ্রাম্য ভিক্ষুগণ সূত্রপাঠ এবং গ্রামবাসীর পূজা পাঠনে সহায়তা করেন। থাই সংস্কৃতি অশরীরী শক্তি বিশ্বাস করেন। এই ভিক্ষুগণ গ্রামবাসীদের রক্ষাকবচ দান করেন। ভিক্ষুদের জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও মুখ্যতঃ ভিক্ষুদের প্রশিক্ষণ ও পালি থেকে আধুনিক থাই ভাষায় অনুবাদের কর্ম সম্পাদিত হয়।
লাওসে সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছোয়। সেখানে বর্তমানে ৯৫% জনগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তবে এর মধ্যে সর্বপ্রাণবাদীদেরও প্রভাব রয়েছে। সাম্যবাদী জমানায় প্রথম দিকে তারা বৌদ্ধধর্মকে দমন করেনি, বরং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘকে কাজে লাগিয়েছে। কালক্রমে সেখানে বৌদ্ধধর্মের ওপর নেমে আসে চরম উৎপীড়ন। ১৯৯০ থেকে চাপ মুক্ত হয়ে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ হয় শুরু। শ্রদ্ধাবান লাওসবাসী পুরুষগণের অধিকাংশ জীবনে অন্ততঃ একবার কিছুদিনের জন্য হলেও ভিক্ষু জীবন পালন করে। অধিকাংশ পরিবার ভিক্ষুদের ভোজন দান করে এবং পূর্ণিমার দিন মন্দির দর্শন করতে যায়।
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম এই দেশের রাষ্ট্র ধর্ম। এখনও এই দেশে ৯৫% জনগণ বৌদ্ধ। ১৯৭০-এর দশকে খেমের রুজ বৌদ্ধধর্মকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রায় সফল হয়েছিল। ১৯৭৯ তে প্রায় সকল বৌদ্ধ ভিক্ষু হয় নিহত হয়েছিলেন, নয়তো বিদেশে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সমস্ত মন্দির ও গ্রন্থাগার ধ্বংস হল। রাজকুমার সিহান্ধক রাজা হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ ধীরে-ধীরে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফিরে এলো বৌদ্ধধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি যা লুক্কায়িত ছিল। কম্বোজবাসীরা হলেন ভবিষ্যৎবক্তা, জ্যোতিষচর্চা এবং অশরীরী লোক সম্বন্ধে গভীর বিশ্বাসী। ভিক্ষুগণ কখনও-কখনও এসকল বিষয় নিরাময়ে কাজ করেন। সমাজে সকল স্তরে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রীতি-নীতিতে এবং আচার-অনুষ্ঠানে ভিক্ষুগণ অংশগ্রহণ করেন।
দুই হাজার বছর আগে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম ভিয়েতনাম পৌঁছোয়। পরে তা এসেছিল চীন থেকে। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য হারানোয় এর অগ্রগতি থমকে যায়। বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে বৌদ্ধধর্মে পুনর্জাগরণ ঘটে। তবে প্রজাতান্ত্রিক শাসনকালে ক্যাথলিক খ্রিস্টানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বৌদ্ধরা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বর্তমানে ১৬% জনগণ ঘোষিত বৌদ্ধ হলেও তা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ধর্ম।
বর্তমানে সরকার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ শিথিল করলেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোন মন্দির কাজ করতে পারে না।
ভারত থেকে বানিজ্যপথ ধরে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দীতে। পনেরো শতকে ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ সম্রাট মাজাপহিত পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং বৌদ্ধধর্মের আগমন কাল থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত এ দেশে ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পালিত হয়েছে। ১৭ শতকের গোড়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে দিয়ে ইসলাম হয়ে ওঠে প্রধান ধর্ম।
ইন্দোনেশিয়ার সরকারী পঞ্চশীল নীতি অনুযায়ী সরকারী ধর্ম হতে হবে ঈশ্বর বিশ্বাসী। ভগবান একজন ব্যক্তিসত্ত্বা এরকম বৌদ্ধধর্ম স্বীকার করে না। কিন্তু হাজার বছর আগে বিকশিত কালচক্রযানে বর্ণিত আদি বুদ্ধকে স্বীকার করে। আদি বুদ্ধ অর্থাৎ প্রথম বুদ্ধ তিনি একটি প্রতীকি শক্তি কোনো ব্যক্তি সত্ত্বা নয়। তিনি সময়াতীত বা অনন্ত এই দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং সর্বজ্ঞ। প্রভাস্বর রুপী চিত্ত রূপে আদি বুদ্ধ সকলের মধ্যে রয়েছে। এর ভিত্তিতে ইসলামের সঙ্গে হিন্দু, খ্রিস্টান, কনফুশিয়ানিজম সহ বৌদ্ধধর্মকেও গ্রহণ করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার বালি ও তৎসন্নিহীত অঞ্চলে শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুগণ থেরবাদী পরম্পরার প্রচার করছেন। তবে তা অত্যন্ত সীমিত স্তরেই রয়েছে। বালির এই বুদ্ধান্ধগামীগণ হলেন সেখানকার হিন্দু, বৌদ্ধ ও স্থানীয় লোকায়ত ধর্মানুরাগীদের এক মিশ্রণ। ইন্দোনেশিয়ার অবশিষ্ট অংশে জনসংখ্যার ৫% হল বৌদ্ধ। এই ইন্দোনেশীয়গণ মূলতঃ চীনা বংশোদ্ভূত। এছাড়াও কিছু ইন্দোনেশিয়া সম্প্রদায় রয়েছেন যারা থেরবাদ, চীনা ও তিব্বতী পরম্পরার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে।
মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ২০% হল বৌদ্ধ। মূলতঃ ওরা হলেন বহিরাগত চীনা সমাজ। পঞ্চাশ বছর আগে সেখানে বৌদ্ধধর্মের প্রতি দেখা দেয় অনাগ্রহ। সেই কারণে ১৯৬১ সনে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের লক্ষ্যে গড়ে উঠে বৌদ্ধ মিশনারি সোসাইটি। বিগত দশক থেকে বৌদ্ধ সাধনার উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমনকি যুবকরাও তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেন। বর্তমানে সেখানে বহু থেরবাদী, মহাযান-বজ্রযান কেন্দ্র রয়েছে এবং সেগুলি পাচ্ছে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনও।
বিগত দু-হাজার বছরের চীনা ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম বিস্তারে চীনের ভূমিকা উল্লেখ যোগ্য। তাং রাজবংশ (৬১৮-৯০৭ খ্রিঃ) বৌদ্ধধর্মের পক্ষে ছিল সুবর্ণযুগ। এই রাজবংশের রাজত্বকালে সাহিত্য ও বৌদ্ধ ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে।
১৯৬০-৭০ এর দশকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অধিকাংশ বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করা হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে সুশিক্ষিত শীলবান ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল। অবশিষ্টদের জুটল কারাবাস। চীনা কর্তৃক অধিকৃত মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতে বৌদ্ধদের উপর নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। চীনে মুক্ত বানিজ্য এবং সংস্কারের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ধর্ম গুলির পুনরুজ্জীবনে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। পুরনো মন্দির গুলির সংস্কারের পাশাপাশি চলছে নতুন মন্দির গড়ার কাজ। মন্দির গুলিতে যারা যোগদান করেছেন তারা সাধারণতঃ গ্রামবাসী তারা দরিদ্র ও অশিক্ষিত। তাদের শিক্ষার মান সত্যিই সাধারণ পর্যায়ের। অধিকাংশ বিহার হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যটকের দর্শনীয় স্থান। আর ভিক্ষুদের টিকিট পরীক্ষা আর মন্দিরের দেখাশোনা করা ছাড়া কোন কাজ নেই।
বর্তমানে বিরাট সংখ্যায় চৈনিক জনগণ বৌদ্ধধর্ম বিশেষ করে তিব্বতী পরম্পরায় উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এবং তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। চীনে সেই জনসংখ্যার ২০% বৌদ্ধ এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্দিরগুলি খোলার সময় ব্যস্ত থাকেন। সেখানে মানুষ হয়ে উঠেছে বিত্তবান এবং ব্যস্ত। এর সঙ্গে বাড়ছে চাপ। তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষ বৌদ্ধধর্মে আশ্রয় খুঁজছেন। হান চীনাদের মধ্যে তিব্বতী পরম্পরার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এর কারণ হল তিব্বতী ভিক্ষুগণের মধ্যে অনেকে চীনা ভাষায় উপদেশ দিতে পারেন।
চীন থেকে মহাযান পরম্পরা প্রসারিত হয়ে হংকং ও তাইওয়ানে শক্তিশালী হয়েছে। তাইওয়ানে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সঙ্ঘ সুদৃঢ় রূপে প্রতিষ্ঠিত এবং পৃষ্ঠপোষকতায় উপাসকবৃন্দ সর্বদা আগ্রহী। এখানে রয়েছে একাধিক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমাজ কল্যাণ মূলক কার্যক্রমের হার ক্রমবর্ধমান। হংকং-এও ভিক্ষুসমাজ বর্ধিষ্ণু এবং আত্মনির্ভর তাছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপিন্সের বৌদ্ধ চীনাজাতির লোকজন নানারকম অনুষ্ঠানাদি করে থাকেন। যেমন প্রয়াতদের শান্তি কামনা, আত্মিক ও জনসম্পদ প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা ইত্যাদি। বৌদ্ধ দৈবজ্ঞদের মাধ্যমে উপাসক-উপাসিকাগণ তাদের স্বাস্থ, মানসিক সমস্যা বিষয় সম্পত্যির বিষয় সমাধান খোঁজেন। ‘এশিয়ার বাঘ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের চীনা ব্যবসায়ীগণ তাদের ব্যবসায়ের সাফল্যের জন্য প্রায়ই এই ধরনের অনুষ্ঠান করেন এবং ভিক্ষুদের যথেষ্ট পরিমাণে দান করেন। তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াতে তিব্বতী বৌদ্ধদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
তৃতীয় শতকে চীন থেকে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছল কোরিয়ায়। গোরা খ্রিস্টানদের ক্রমাগত চাপ সত্ত্বেও দক্ষিন কোরিয়ায় বৌদ্ধ পরম্পরা এখনও শক্তিশালী। ঐ ধরনের সংগঠকদের মদতে বিগত দশকে বহু বৌদ্ধ মন্দির ও বিহারে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে। এখানে ২৩% জনগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।
পঞ্চম শতাব্দীতে কোরিয়া থেকে বৌদ্ধধর্ম জাপানে প্রসারিত হয়েছে। জাপানে সমাজ ও সংস্কৃতিতে বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ত্রয়োদশ শতক থেকে মন্দিরের ভিক্ষুগণ ধীরে-ধীরে ব্রহ্মচর্য পালনকারী ভিক্ষুদের পরিবর্তে বিয়ে করা ও মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাই হয়ে ওঠে পরম্পরা। ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে, কিছু বৌদ্ধ পরম্পরা অতি মাত্রায় জাতীয়তাবাদী। ওরা বিশ্বাস করে যে, জাপান হল বৌদ্ধধর্মের স্বর্গ। আধুনিক যুগে কিন্তু অন্ধবিশ্বাসী সম্প্রদায় রয়েছে যারা নিজেদের বলেন বৌদ্ধ কিন্তু শাক্যমুনি বুদ্ধের উপদেশাবলীর সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্ক নেই।
৪০% জাপানী নিজেদের বৌদ্ধ বলে থাকেন এবং অধিকাংশ জাপানীদের ধর্ম বিশ্বাস হল তাদের প্রাচীন পরম্পরা শিন্টো ও বৌদ্ধধর্মের মিশ্রণ। জন্ম ও বিবাহের অনুষ্ঠান হয়ে শিন্টো মতে কিন্তু পারলৌকিক কর্ম সমাধা হয় বৌদ্ধ মতানু্যায়ী।
দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এখানকার মন্দির গুলি অত্যন্ত সু-সংরক্ষিত। বেশ কিছু মন্দিরে তো আবার বানিজ্যিকরণও হয়েছে অতিমাত্রায়। অধিকাংশ স্থানে বৌদ্ধ অধ্যয়ন ও সাধনা হয়েছে দুর্বল। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বৌদ্ধ সংগঠন সোকা গাক্কাই জাপানেই তৈরী হয়েছে।
সপ্তম শতকে বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে পৌঁছোয়। শত-শত বছর ধরে রাজকীয় এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম তিব্বতের সংস্কৃতির ভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত হয়েছে।
চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের পর তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের উপর ঘোর অন্ধকারে নেমে আসে। ৬৫০০ বিহার ও ভিক্ষুণীদের মন্দিরের মধ্যে মাত্র ১৫০টি ছাড়া সব কটি ধ্বংস করা হয়েছে। বিদ্বান ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়েছে অথবা কারাগারে দেহত্যাগ করেছেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর নির্বাসিত তিব্বতী, স্থানীয় জনগণ ও যে কয়জন ভিক্ষু তখন জীবিত ছিলেন তাদের প্রচেষ্টায় মন্দির গুলির পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সরকার মাত্র তিন-চারটে মন্দির সংস্কারের কাজ করেছেন। চীনা সাম্যবাদী সরকার নাস্তিক কিন্তু পাঁচটি ধর্মকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের একটি হল বৌদ্ধধর্ম। যদিও ওরা দাবি করে যে ধর্মীয় বিষয়ে তারা নাকগলায় না, কিন্তু পরম পূজ্য দালাই লামা পাঞ্চেন লামার অবতার হিসেবে একটি শিশুকে চিহ্নিত করার পর সপরিবারে শিশুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। তার পরেই চীন একজন তিব্বতী-চীনা মিশ্র বর্ণের একটি বালককে তাদের পাঞ্চেন লামা বলে স্বীকৃতি দিয়ে দিল তখন থেকে পরম পূজ্য দালাই লামা দ্বারা চিহ্নিত বালকটিকে আর দেখা যায়নি। বর্তমানে প্রতিটি মন্দির ও ভিক্ষুণীদের বিহারে সরকারি প্রতিনিধি আছে। প্রকৃতপক্ষে সহায়তার নামে ওরা হল সাদা পোশাকের পুলিশ। ওরা সবসময় বিহারের কাজ কর্ম ও ভিক্ষু সঙ্ঘের ওপর নজর রাখে এবং কর্তৃপক্ষকে খবর দেয়। কোন-কোন সময় সহায়তার নামে প্রায় ভিক্ষুদের সমান সংখ্যায় ওদের উপস্থিত হতে দেখা যায়। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া অপর একটি বিষয়ে তিব্বতীরা অসুবিধায় পড়েছেন। তা হল জ্ঞানী ও শিক্ষিত ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের অভাব। সঙ্ঘ ও উপাসকগণ শিখতে খুবই আগ্রহী কিন্তু অধিকাংশ আচার্যদের প্রশিক্ষণ সীমিত। বিগত দশকে সরকার ল্হাসার নিকটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। ওখানে তরুণ টুলকু (অবতার লামা)-দের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে তারা তিব্বতী ভাষা, হস্তলেখ, চিকিৎসা শাস্ত্র ও আকুপাংচার সহ কিছু বৌদ্ধ দর্শনের অধ্যয়নও করেন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে তিব্বতী যুবাগণ বৌদ্ধধর্মের আরও কাছে এসেছেন। wechat এবং weibo এর মত গোষ্ঠীর মাধ্যমে তারা বৌদ্ধ উপদেশ ও কাহিনী শ্রবণ সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। “খাঁটি তিব্বতী” এই বোধটিকে শক্তিশালী করতে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
কালমাইক মোঙ্গলদের নিবাস পূর্ব তুর্কিস্তানের জিনজিয়াঙে অবস্থিত অধিকাংশ মন্দির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ধ্বংস করা হয়েছিল। অধূনা বেশ কিছু মন্দিরের পুণর্নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে তিব্বতের থেকেও আচার্যদের বড়ই অভাব। অধ্যয়নের অভাব হেতু নবযুবক ভিক্ষুগণ অনেকেই হতাশ। কিছু ভিক্ষু তো চীবর ত্যাগ পর্যন্ত করেছেন।
তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের সর্বাপেক্ষা করুন পরিণতি হয়েছে মঙ্গোলিয়ার অভ্যন্তরে। তা ঘটেছে চীন নিয়ন্ত্রিত অংশে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পশ্চিমাংশের প্রায় সব বিহার ধ্বংস করা হয়েছিল। পূর্বাংশে যা এক সময় ছিল মাঞ্চুরিয়ার অংশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে স্ট্যালিনের বাহিনীর হাতে আগেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে সময় রাশিয়া উত্তর চীনকে জাপানের কব্জা মুক্ত করেছিল। ৭০০টি মন্দিরের মধ্যে রইল মাত্র ২৭টি।
১৯৮০ সালের পর মন্দির ও বিহারগুলির পুণর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এগুলিতে বর্তমানে শুধু মঙ্গোলীয় নয়, বরং হান চীনাগণ ও উপাসনা করছে।
মঙ্গোলিয়াতে এক সময় হাজার-হাজার মন্দির ও বিহার ছিল। ১৯৩৭-এ স্ট্যালিনের আদেশে সবগুলি আংশিক বা পূর্ণতঃ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ওলান কটোরে প্রতি রূপে একটি বিহার খোলা হয়েছিল। ১৯৭০-এ খোলা হয়েছিল একটি কলেজ। যেখানে ভিক্ষুদের প্রশিক্ষণের জন্য পঞ্চবার্ষিকী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে সাম্যবাদ পড়ানো হতো বেশি। উপাসকদের পুজো পাঠনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে ভিক্ষুদের সীমিত অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯০ সালে সাম্যবাদী সরকারের পত্তনের পর নির্বাসিত তিব্বতীদের প্রচেষ্টায় সেখানে প্রবল ভাবে ফিরে এল বৌদ্ধধর্ম। প্রশিক্ষণের জন্য বহু নব দীক্ষিত ভিক্ষুকে পাঠানো হল ভারতে। ২০০টির বেশি মন্দির এবং বিহার কাজ চালানোর মত করে পুনর্নির্মাণ করা হল।
১৯৯০-এর পরে মঙ্গোলিয়া একটি অন্য ধরণের গম্ভীর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। ইংরেজি শেখানোর ছলে খ্রিস্টান মিশনারীদের অনুপ্রবেশ। তাদের বলা হয় মোরমোন। ধর্মান্তরিত হলে তাদের সন্তানদের আমেরিকায় পড়তে পাঠানো হবে, দেওয়া হল টাকা, উপহার। বিনামূল্যে সহজবোধ্য মঙ্গোলীয় ভাষায় যীশুর বাণী সম্বলিত সুন্দর প্রচার পুস্তিকা হয় বিতরিত। এইভাবে অনেক যুবক-যুবতী খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এর পাল্টা হিসেবে বৌদ্ধ সংগঠন গুলিও বৌদ্ধধর্মের তথ্যকে চলিত ভাষায়, মুদ্রিত উপাদান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রচার সহ রেডিও-র মাধ্যমে প্রচার করছেন।
বর্তমানে মঙ্গোলীয়াতে অগ্রাসী ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ হয়েছে। ২০১০ সালে সে দেশের মোট জনগণের ৫৩% ছিলেন বৌদ্ধ এবং ২.১% খ্রিস্টান।
মধ্য এশিয়ার তিব্বতী পরম্পরার অনুগামীদের মধ্যে সর্বপেক্ষা শক্তিশালী হলো নির্বাসিত তিব্বতীগণ। তারা ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে গণ বিদ্রোহের পর পরম পূজ্য দালাই লামার সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। তিব্বতের প্রধান বিহার ও ভিক্ষুণী সঙ্ঘগুলি তারা ভারতে পুনরায় চালু করে। এগুলিতে চালু হয়েছে শিক্ষক, সাধনার আচার্য ও বিদ্বান ভিক্ষুদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনার উপযুক্ত কার্যক্রম ও পাঠ্যসূচী। তিব্বতী পরম্পরার প্রতিটি শাখার সংরক্ষণ ও সংবর্ধনের জন্য রয়েছে গবেষণা, প্রকাশনা বিভাগ ও শিক্ষা বিভাগ।
কুল পরম্পরার দীক্ষা এবং গুরুদের ক্রমাগত দর্শন ও উপদেশ দানের মাধ্যমে হিমালয় অঞ্চল বিশেষ করে লাদাখ, নেপাল, সিকিম ও ভুটানে বৌদ্ধধর্ম নবজীবন পেয়েছে। এই অঞ্চলে বহু ভিক্ষু-ভিক্ষুণী নির্বাসিত তিব্বতীদের বিহারে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে চলছেন।
সংখ্যা গরিষ্ঠ নেপালিগণ হলেন হিন্দু। বুদ্ধের জন্মভূমিতে সব ক্ষেত্রেই বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। নেওয়ারী, তামাং এবং গুরুংদের মতো জাতিগুলি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ পরম্পরা পালন করছে। নেপালের জনসংখ্যার ৯% হলেন বৌদ্ধ।
সম্ভবতঃ হিন্দু প্রভাবের কারণে নেপালের বৌদ্ধ সমাজ হল একমাত্র নিদর্শন যেখানে বৌদ্ধ বিহারেও জাতিভেদ প্রথা দেখা যায়। বিগত ৫০০ বছর ধরে নেপালে ভিক্ষুদের মধ্যে বিয়ে করার প্রথা দেখা গেছে এবং মন্দিরের তত্ত্বাবধান ও আচার অনুষ্ঠানের নেতৃত্বদানের বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে বংশগত।
বুরিয়াত, টুভা এবং কালমাইকিয়া হল রাশিয়ার তিনটি অঞ্চল, যেখানে তিব্বতী পরম্পরাগত বৌদ্ধগণ বাস করেন। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে স্ট্যালিনের নির্দেশে সকল বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি ছিল অবশিষ্ট। ১৯৪০-এর দশকে বুরিয়াতিইয়াতে KGB-এর নজরদারিতে দুটি মন্দির প্রতীকি রূপে খোলা হয়। তবে ভিক্ষুদের চীবর ধারণ ছিল নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পূজাপার্বণে তা পরিধান করতে পারতেন। সাম্যবাদের পতনের পর এই তিনটি অঞ্চলেই ব্যাপক ভাবে বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান ঘটল। নির্বাসিত তিব্বতীগণ সেখানে আচার্যদের প্রেরণ করলেন। আর সেখান থেকে ভারতে তাদের বিহারগুলিতে এলো সে দেশের নবযুবক-যুবতীবৃন্দ। বুরিয়াতিয়া, টুভা এবং কাল্মাইকিয়াতে ২০টির বেশী বিহার পুনস্থাপিত হয়েছে।
ঔপনিবেশীকতা, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের খোঁজ এবং বিদ্বানদের প্রয়াসে ইউরোপে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছল উনবিংশ শতকে। প্রায় একই সাথে প্রবাসী চীনা এবং জাপানিগণ উত্তর আমেরিকাতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং মন্দির।
চিরাচরিত ভাবে অবৌদ্ধ দেশগুলিতেও বর্তমানে সর্বপ্রকার বৌদ্ধ পরম্পরার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে দুটি গোষ্ঠী দেখা যায়। একটি হল এশীয় অভিবাসী এবং এশীয় নন এমন সাধক। এশীয় অভিবাসীগণ বিশেষ করে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং কিছুটা ইউরোপে তাদের ঐতিহ্যবাহী বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। মন্দির গুলির প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে সাধনা আর সেই সঙ্গে সমাজের একটি সাধারণ কেন্দ্র যা তাদের ঐতিহ্যবাহী পরম্পরাগুলিকে সংরক্ষণ ও সংবর্ধন করবে। এই সময়ে আমেরিকাতে ৪০ লক্ষ বৌদ্ধ বাস করেন। আর ইউরোপে সংখ্যাটি ২০ লক্ষ্যের ও বেশী।
সব মহাদেশে একশোটি থেকেও বেশী দেশে আজ সকল বৌদ্ধ পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য বৌদ্ধধর্ম কেন্দ্র রয়েছে। তাদের মধ্যে তিব্বত, জেন এবং থেরবাদ প্রমুখ। এই কেন্দ্রগুলিতে অসংখ্য এশীয় নন এমন মানুষ আসছেন, শিখছেন ধ্যান, করছেন অধ্যয়ন এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। গুরুদের মধ্যে এশীয় নিবাসী বৌদ্ধ থেকে এশীয়গণ, সবাই রয়েছেন। সবচেয়ে বেশী কেন্দ্র রয়েছে আমেরিকা, জার্মানি এবং ফ্রান্সে। প্রকৃত সাধক গভীর সাধনা শেখার জন্য যায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বৌদ্ধ পাঠ্যসূচি। মনোবিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে মত-বিনিময় ক্রমবর্ধমান। পরম পূজ্য চতুর্দশ দালাই লামা এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন, সঞ্জীব কুমার দাস, রামকৃষ্ণ দাস (কর্মা জ্ঞানবজ্র) এবং দেবজিৎ চ্যাটার্জী।