৭১- এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অবদান, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ আমাদের বৌদ্ধ জাতিকে গর্বিত ও অনুপ্রাণিত করেছে।এ ক্ষেত্রে যাদের নাম সর্ব প্রথম উল্লেখ করতে হয় তাঁরা হচ্ছেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার ২৪তম মহাসংঘনায়ক প্রয়াত বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও ১০ম সংঘরাজ শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথের।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মাধ্যমে বৌদ্ধ পরিচয়পত্র দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে যেমন দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয় রেখেছিলেন তেমনি আরও অনেক মুসলমান, হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদেরকে তিনি প্রাণ রক্ষা করেন। বাঙালি জাতির এ দুঃসময়ে বাংলাদেশের প্রায় ষোল হাজার মাইল পথ পরিভ্রমণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। এসময়ে তাঁর সহযোগী হিসেবে শহীদ জিনানন্দ ভিক্ষু, শহীদ ননী গোপাল বড়ুয়া (লাখেরা), প্রয়াত সংঘনায়ক প্রিয়ানন্দ মহাথের, প্রয়াত সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের, প্রয়াত বেধিপাল মহাথের, প্রয়াত অনুনায়ক সুগতানন্দ মহাথের, প্রয়াত শাক্যবোধি মহাস্হবির, উঃ জিনিতা মহাথের ( পটুয়াখালি), ডাঃ ইন্দুভূষণ বড়ুয়া (কধুরখীল), অশ্বিনী রঞ্জন বড়ুয়া (পটিয়া), প্রকৌশলী ব্রহ্মদত্ত বড়ুয়া (রাউজান),প্রয়াত উঃ পন্ডিতা মহাথের (টেকনাফ),ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া ও ড.বসুমিত্র বড়ুয়াসহ আরো অনেকে কাজ করেছে।
স্মরণীয় যে মহাসংঘনায়কের সহযোগী শ্রীমৎ জিনানন্দ ভিক্ষু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুদিন পূর্বে শহীদ হন।
স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে তাঁর দৈনন্দিক জীবনের বিচিত্র কার্যাবলী নিয়ে ১৯৭২ সালে রচনা করেন ‘রক্তঝরা দিনগুলোতে’ শীর্ষক ৪৫ পৃষ্টার এক ক্ষুদ্র পুস্তিকা।
মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের রচিত এ গ্রন্থটি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র”-এর চতুর্থ খন্ডে হুবহু বর্ণিত আছে।
মহাথের সময়োচিত এবং দূরদর্শী ভূমিকায় বৌদ্ধ গ্রামগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু পরাস্ত করার কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরো।অনেকের মত তিনি বিদেশে মুজিব নগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।প্রবাসী সরকার কর্তৃক পণ্ডিত জ্যোতিপাল মহাথের এবং তাঁর সঙ্গী অ্যাডভোকেট ফকির সাহাবুদ্দিন বৌদ্ধ রাষ্ট্র শ্রীলংকার বিভিন্ন স্থানে প্রচারণাসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস বন্দর নায়েকের সাথে সাক্ষাৎ করে অস্ত্রবাহী পাকিস্তানি বিমানের কলম্বো হয়ে ঢাকা যাতায়াত বন্ধ করান। এছাড়া থাইল্যান্ড, জাপান ভ্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের অভ্যন্তরে মাননীয় বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বর্হিবিশ্বে মাননীয় জ্যোতিঃপাল মহাথের’র অবদান বাঙালি বৌদ্ধদের অত্যন্ত গৌববের।
২০ সেপ্টেম্বর ৯৬ বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধধর্ম গুরুদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন; বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রয়াত সভাপতি মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো ও সংঘের বর্তমান উপদেস্টা মণ্ডলীর প্রধান পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরো, এঁদের মধ্যে একজন স্বদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা ও আশ্রয় দিয়েছিলেন, অন্যজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রতিণিধি হয়ে, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন’।
এছাড়া এসময়ে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভার সাধারণ সম্পাদক শ্রীমৎ শান্তপদ মহাথের, লাকসাম থানার আলীশ্বর বিহারের অধ্যক্ষ পূর্ণানন্দ মহাথের, কুমিল্লা সদরের কনকস্তুপ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ধর্মরক্ষিত মহাথের এবং লাকসাম থানার আলোকদিয়া বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ সংঘরক্ষিত স্থবির ভারতে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন।
তথ্যসূত্রঃ
১। বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, ভিক্ষু ড. সুনীথানন্দ।
২। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, পৃঃ ১৩৭ ।
৩। আত্মঅন্বেষাঃ বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়, জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, পৃঃ ১৪৮-১৫২।
৪। বাংলার বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, শিমুল বড়ুয়া, পৃঃ ১৮৯-১৯০।
৫। বাঙালি বৌদ্ধদের ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া।