1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১১:১৬ অপরাহ্ন

অতীশ দীপঙ্করের দেশে ফেরা

রায়হান রাইন
  • সময় শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০
  • ৬৭৮ পঠিত

বৌদ্ধ দার্শনিক অতীশ দীপঙ্কর বাঙালির বিস্ময়কর এক চরিত্র। বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ পর্বে তিব্বতে গিয়ে আর দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। সম্প্রতি রায়হান রাইনের অনুবাদ ও সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি। সেই সূত্রে তাঁর জীবন ও দর্শনের দিকে ফিরে দেখা।

অতীশ দীপঙ্করের একটা নতুন জীবনী লেখেন নাগওয়াং নিমা। তিনি এটা লিখেছেন তিব্বতীয় উৎসগুলো ব্যবহার করে। বইটি সংশোধন ও সম্পাদনা করে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেন লামা চিম্পা। এতে একটা ঘটনার বিবরণ আছে এ রকম: অতীশ তখন তিব্বতের নেথাংয়ে থাকেন। এক সন্ধ্যাবেলা বিখ্যাত এক যোগী এলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যোগী কিছুক্ষণ আলাপ করে চলে যাওয়ার পর কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে? অতীশ বললেন, ‘আমার পুরোনো বন্ধু মৈত্রী ভৃখোলি।’ এর কিছুক্ষণ পর অতীশ আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখছিলেন। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত তিনি ওভাবেই তাকিয়ে থাকেন। পরদিন ভোরবেলা এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে অতীশ বললেন, ‘সে এক দারুণ দৃশ্য! মৈত্রেয়নাথ ও মঞ্জুশ্রী দেখা দিলেন আকাশে। দুজনের মধ্যে মহাযান মত নিয়ে আলাপ চলছে, বজ্রপাণি আছেন পাহারায় আর দেবপুত্রেরা চারদিকে বসা। আমি তাদের আলাপই শুনছিলাম। এবার পুরো আলোচনাটা লিখে ফেলতে হবে।’ কথা শেষ করে অতীশ লেখার জন্য ছুটলেন। এ ঘটনা থেকে অতীশের লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে আঁচ করা যায়, যেন মহাযান ধারার দার্শনিকদের নিজের সামনে বসিয়ে লিখছেন তিনি। মৈত্রেয়নাথ, নাগার্জুন, বোধিভদ্র, আর্যদেব, শান্তিদেব, শান্তরক্ষিত প্রমুখের দার্শনিক ধারার ভেতর দাঁড়িয়ে নিজের পথ খুঁজেছেন অতীশ। তাঁর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানশ্রী মিত্র, অবধূতিপা, শীলরক্ষিত, আচার্য জেতারি, ডোম্বিপা, নারোপা, দানশ্রী, বোধিভদ্র, ধর্মকীর্তিসহ আরও অনেকে।

কাজেই শ্রীজ্ঞান অতীশকে পাঠ করা মানে কেবল তাঁকেই পড়া নয়, তিনি যোগসূত্র হয়ে ওঠেন এমন একটা দার্শনিক ঘরানার, যা আমাদেরই চিন্তার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। অথচ নানা কারণে এই পরম্পরাকে আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। অতীশের চিন্তার সঙ্গে যুক্ত অনেকে এ দেশেরই দার্শনিক, যাঁদের আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন আচার্য জেতারি, যিনি দশম শতকের যুক্তিবিদ, জন্ম বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে। লামা তারনাথের বইয়ে তাঁর ২৩টি রচনার তালিকা পাওয়া যায়। অতীশকে অল্প বয়সেই তাঁর মা-বাবা এই আচার্যের কাছে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। অতীশ তাঁর কাছে শেখেন প্রাথমিক বিজ্ঞান। তবে আচার্য জেতারির কাজের প্রধান বিষয় ছিল যুক্তিশাস্ত্র। হেতু-তত্ত্ব-উপদেশ এবং ধর্ম-ধর্মী-বিনিশ্চয় তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই। প্রথম বইটিতে তিনি ন্যায়-যুক্তির হেতুপদ নিয়ে এবং দ্বিতীয় বইয়ে সাধ্যপদ ও পক্ষপদ নিয়ে অন্বেষণ করেন। তিব্বতের প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহশালা তাঞ্জুরে সংরক্ষিত এই বইগুলো অনূদিত হতে পারে বাংলায়।

অতীশের আরেকজন গুরু জ্ঞানশ্রী মিত্র। তিনি গৌড়ের লোক। অতীশ যখন তিব্বতের উদ্দেশে যাত্রা করেন, তখনো তিনি বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। যুক্তিশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে জ্ঞানশ্রী মিত্রের। তাঞ্জুরে সংরক্ষিত তাঁর একটি বই কার্য-কারণ-ভাব-সিদ্ধি। নেপালি পণ্ডিত অনন্ত-শ্রী বইটি সম্পাদনা করে পুনঃপ্রকাশ করেন।

অতীশের একটি রচনায় ‘বোধিসত্ত্ব ব্রত বিষয়ে কুড়িটি স্তবক’ নামে এক লেখার কথা আছে। এটি লেখেন দার্শনিক চন্দদাস। তিনি চন্দ্রগোমিন নামেই বেশি পরিচিত। জন্ম রাজশাহী অঞ্চলে। কিন্তু পরে বসতি গড়ে তোলেন দক্ষিণ বাংলার এক দ্বীপে। তাঁরই নামে ওই দ্বীপের নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ, যা বরিশাল জেলার পূর্বনাম। অবশ্য আরেকজন চন্দ্রগোমিনের পরিচয় পাওয়া যায়, যাঁর বিবরণ আছে চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিঙের লেখায়, যিনি চন্দ্রকীর্তির সময়ে জীবিত ছিলেন। অতীশ দীপঙ্কর চন্দ্রগোমিনের লেখা অনুবাদ করেন তিব্বতীয় ভাষায়। এ রকম একটি লেখার অন্তঃশ্লোকে চন্দ্রগোমিন সম্পর্কে অতীশ বলেন, ইনি কবিদের শিরোমণি এবং ভাষাতত্ত্ব, যুক্তিশাস্ত্র, দর্শন, আরোগ্যবিদ্যা ও শিল্প—এই পঞ্চবিদ্যায় পারদর্শী। চন্দ্রগোমিনের বেশ কটি লেখা ইংরেজি ভাষায় পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এই দার্শনিক অপরিচিতই রয়ে গেলেন।

আরেকজন বিখ্যাত বৌদ্ধ যুক্তিবিদের লেখা উদ্ধৃত করেন অতীশ, তিনি আচার্য শান্তরক্ষিত, যাঁর জন্মও বাংলাদেশে—মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। অতীশের দুই শ বছর আগে তিনিও তিব্বতে গেছেন রাজা ঠিস্রোং দেচানের আমন্ত্রণে। শান্তরক্ষিতের গুরুত্বপূর্ণ একটা বই তত্ত্ব-সংগ্রহ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন গঙ্গানাথ ঝা। এ ছাড়া আরও ১০টি বইয়ের নাম আছে লামা তারনাথের বইয়ে। শান্তরক্ষিত এত বড় দার্শনিক যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর একটি পুস্তকে ‘তাঁকে বাংলার গৌরব’ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর দর্শনও বাংলাদেশে খুব সামান্যই চর্চিত হয়।

অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি

অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি

অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি

দাম: ৩২০ টাকা

পাওয়া যাচ্ছে: প্রথমা প্রকাশনের আউটলেট ও সারাদেশের মানসম্মত বইয়ের দোকানে

অনলাইনে কিনুন:

www.prothoma.com

যাঁরা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং ভিক্ষু, যাঁরা মঠ কিংবা বিহারে বাস করেন, সাধারণ লোকদের ধারণা, তাঁরা ধর্ম ও বিদ্যাচর্চা, ধ্যান ও সমাধি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, সংসার তাঁদের চিন্তার বিষয় নয়। এটা একেবারেই ভুল ধারণা। সংসারে থাকা মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত করা মহাযান বৌদ্ধ সাধকদের প্রধান কর্তব্য। এটাই সর্বজনীন করুণা। এটা মহাযান বৌদ্ধ মতের নৈতিক অবস্থানের দিক। অন্য দিকটা হলো, জগৎ-সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা। এই দুটো দিকের সমন্বয় ছাড়া কোনো সাধকের পক্ষে বোধিলাভ সম্ভব নয়। মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত করা এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কর্তব্য অতীশ সব সময় পালন করে গেছেন। রাজা নয়পালের সঙ্গে চেদীরাজ লক্ষ্মীকর্ণের যুদ্ধের সময় অতীশের উদ্যোগ এবং চেষ্টাতেই উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অতীশ নেপালে অবস্থানকালে রাজা নয়পালকে চিঠি লিখে ন্যায্য পথে শাসন পরিচালনার উপদেশ দেন। সুবর্ণদ্বীপে অবস্থানকালেও সেখানকার রাজা গুরুপালকে বাস্তবতাসম্পর্কিত পথ দেখানোর জন্য তিনি লেখেন ‘দুই প্রকার সত্য প্রসঙ্গে ভূমিকা’ নামে একটি লেখা।

অতীশ দীপঙ্কর তাঁর ‘মধ্যপথের স্তোত্র’ শিরোনামের একটি লেখায় বলেন, একজন চক্ষুরোগী বাস্তবতাকে যেমন দেখে, তেমন দেখাকেই সে সত্য ভাবে, একইভাবে অবিদ্যাগ্রস্ত লোকও তার দেখা বাস্তবতাকেই সত্য ভেবে নেয়। এটা একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকট। এ থেকে বেরোনোর উপায় হলো ব্যক্তির রূপান্তর। এ লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি প্রবর্তন করেন লামরিম শিক্ষাপদ্ধতি, যাতে ধাপে ধাপে ব্যক্তির মানসিক পরিবর্তন ঘটবে। ব্যক্তির এই রূপান্তরে ভূমিকা রাখবেন একজন গুরু বা ‘কল্যাণ মিত্র’ এবং এতে সহায়ক হবে সাধকের নিরন্তর মানসিক প্রস্তুতি, পঠনপাঠন ও জনহিতকর কাজ। বৌদ্ধ সহজিয়াদের গুরু যেমন অলঙ্ঘনীয়, অতীশের কল্যাণ মিত্র ঠিক তেমন নন, তিনি আলোকময়তার পথে কেবলই একজন পথপ্রদর্শক, মিত্র।

তিব্বতে যাওয়ার ব্যাপারে অতীশের আগ্রহ ছিল না। রাজা এশেওদের তরফ থেকে প্রথম দফায় আমন্ত্রণের পর তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তবে রাজা এশেওদ অতীশকে তিব্বতে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। এ কাজের জন্য প্রচুর সোনা সংগ্রহ চলতে থাকে। এটা করতে গিয়ে বৌদ্ধধর্মবিরোধী রাজা গারওয়ালের সৈন্যদের হাতে বন্দী হন রাজা এশেওদ। কারারুদ্ধ রাজাকে মুক্ত করতে প্রচুর সোনা দাবি করা হয়। রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র জনছুবওদ সেই সোনা জোগাড়ও করেন। কিন্তু রাজা এশেওদ তাঁকে অনুরোধ করেন সেই সোনা যেন অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নেওয়া এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে ব্যয় করা হয়। এভাবে কারাগারে মৃত্যু হয় রাজা এশেওদের। এসব ঘটনা শোনার পর দ্বিতীয়বারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান অতীশ। তিনি তিব্বতে কাটান তাঁর জীবনের শেষ তেরো বছর।

দেশে ফেরা হয়নি অতীশের। ১৯৭৮ সালে তাঁর দেহাবশেষ চীন থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশে আনা হয়। এই ফিরে আসার একটা প্রতীকী তাৎপর্য হয়তো আছে, কিন্তু অতীশের সত্যিকার দেশে ফেরা হবে যদি আমরা তাঁর লেখা এবং চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হই। তাঁর দর্শন, উপদেশ ও নির্দেশনাগুলো আমাদের মনে যতটুকু আলো ফেলবে, ততটুকুই হবে তাঁর দেশে ফেরা।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!