সম্যক দৃষ্টি হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথম মার্গ, যার অর্থ হল জগতের প্রকৃত বাস্তব সত্য বা নিয়ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা।
ভগবান বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীতে অবস্থান করছিলেন, একদিন ভান্তে কাচ্ছায়ন বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, সম্যক দৃষ্টি বলতে কি বুঝায়?
তখন বুদ্ধ উত্তরে বললেন, এই ঘটনাবহুল জগৎ দুই ভাগে বিভক্ত। যথাঃ অস্তিত্বময় জগত (existence) এবং অস্তিত্বহীন জগত (non-existence)। কিন্তু যখন কেউ তার সূহ্ম বিচারশক্তি দিয়ে জগতের অস্তিত্বের সৃষ্টি সর্ম্পকে অস্তিত্বহীন জগতের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে, সে যখন তার সূহ্ম বিচারশক্তি দিয়ে অস্তিত্বহীন জগতের বিনাশ সর্ম্পকে অস্তিত্বময় জগতের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে সেটাই সম্যক দৃষ্টি।
এ জগতে সবকিছু বিদ্যমান এটা যেমন সত্য, আবার বিদ্যমান নয়, এটা তেমন দ্বিতীয় সত্য। সংযুক্ত নিকায়ের ’কাচ্চায়নগোথা’ সুত্রে (SN১ 12.15) ইহা বলা হয়েছে।
তার মানে একটি সত্যকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র অপর সত্যকে স্বীকার করা যাবে না, একে অপরের পরিপূরক।
অর্থাৎ কোন কিছুর চূড়ান্ত অস্তিত্ব বা সত্ত্বা এবং চূড়ান্ত অস্তিত্বহীনতা বা সত্ত্বাহীনতার দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করে মধ্যমপহ্নার কথা বলা হয়েছে (Bhikkhu, 1997)। এ মধ্যমপহ্নার কথা বুদ্ধ ধম্মচক্রপ্রবর্তন সূত্রেও (SN১ 56.11) বলেছেন।
অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতা বলতে কি বুঝায়?
অভিধর্ম অনুসারে (Siderits and Katsura, 2013, p. 153),
অস্তিত্বঃ অস্তিত্ব বলতে যে অস্তিত্বের সহজাত স্বভাব (intrinsic nature) থাকবে। তার মানে যে অস্তিত্ব অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। নাগার্জুনের যুক্তি হল, যদি কোন কিছুর উৎপত্তি ’কারন এবং পরিস্থিতির (cause and condition)’ উপর ভিত্তি করে হয় তার কোন সহজাত স্বভাব থাকতে পারে না এবং ইহার সহজাত স্বভাব বা ধর্ম হবে ’শূন্য’।
অস্তিত্বহীনতাঃ আর যে অস্তিত্বের সহজাত ধর্ম বা স্বভাব থাকবে না তাহাই অস্তিত্বহীনতা। যাহা অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উৎপত্তি হয় তাহার কোন সহজাত স্বভাব থাকবে না বা সহজাত স্বভাবের অস্তিত্ব থাকবে না। তার মানে এই অস্তিত্বহীনতা বলতে উচ্ছেদবাদ বা ধ্বংসবাদ (nihilism) নয়।
নিম্নে মধ্যমাকা মতবাদ অনুসারে অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হলঃ
যুক্তি–১: স্বতন্ত্র কারন এবং পরিস্থিতির (distinct cause and condition) উপর ভিত্তি করে যদি কোন কিছুর উৎপত্তি হয় তার কোন সহজাত স্বভাব বা ধর্ম থাকবে না, অর্থাৎ উৎপন্ন বস্তুটির সহজাত স্বভাব অস্তিত্বহীন ।
যেমনঃ বীজ হল ‘কারন’, ও মাটি, জল, তাপ, বায়ু, সূয্যের আলো হল ’পরিস্থিতি’। ফলে ‘কারন’ এবং ‘পরিস্থিতির’ কারনে সৃষ্টি হল ‘বৃক্ষ’। এখানে বৃক্ষের কোন সহজাত স্বভাব নাই, যেহেতু ’বৃক্ষ’ বীজ, মাটি, জল, তাপ, বায়ু ও সূয্যের আলোর উপর নির্ভরশীল। সুতরাং বৃক্ষের সহজাত স্বভাবের অস্তিত্ব নাই।
যুক্তি–২: যদি কোন কিছুর সহজাত স্বভাব (intrinsic nature) অনুপস্থিত তার বাহ্যিক স্বভাবও (extrinsic nature) অনুপস্থিত।
যেমনঃ উপরোক্ত উদাহরনে ‘বাহ্যিক স্বভাব’ হল বৃক্ষ এবং ’সহজাত স্বভাব’ হল বীজ, মাটি, জল, তাপ, বায়ু ও সূয্যের আলো। সুতরাং সহজাত স্বভাব অনুপস্থিত মানে বাহ্যিক স্বভাবও অনুপস্থিত।
যুক্তি–৩: যদি কোন কিছুর সহজাত স্বভাব এবং বাহ্যিক স্বভাব উভয়ই অনুপস্থিত তার বা তাদের অস্তিত্বও অনুপস্থিত।
যেমনঃ বীজ, মাটি, জল, তাপ, বায়ু ও সূয্যের আলো অনুপস্থিত এবং বৃক্ষও অনুপস্থিত, তার মানে তাদের অস্তিত্বও অনুপস্থিত।
যুক্তি–৪: যার বা যাদের অস্তিত্ব নাই তার বা তাদের অস্তিত্বহীনতাও নাই।
যেমনঃ বীজ, মাটি, জল, তাপ, বায়ু, সূয্যের আলো ও বৃক্ষের অস্তিত্ব নাই (বর্তমান নাই), সুতরাং তাদের অস্তিত্বহীনতার প্রশ্নই আসে না।
দাবি–১: বুদ্ধ যেমন শাশ্বতবাদকে (eternalism) অস্বীকার করেছেন আবার উচ্ছেদবাদকেও (nihilism) প্রত্যাখান করেছেন। তার মানে সত্ত্বা বা বস্তুর অস্তিত্বও থাকবে আবার থাকবেও না। অর্থাৎ মধ্যমপহ্না‘ই হল বাস্তবতা।
নিম্নে শাশ্বতবাদ এবং উচ্ছেদবাদ এর পার্থক্য উল্লেখ করা হলঃ
শাশ্বতবাদ (Eternalism) | উচ্ছেদবাদ (Nihilism) |
১) জগতের সবকিছুই পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং সবকিছুই নিত্য যা বুদ্ধের মূল শিক্ষা ‘অনিত্যতা’র বিপরীত। | ১) জগতের সবকিছুই মনের প্রতিফলন (mental projection), কিন্তু আবার মনকেও কোথায়ও পাওয়া যায় না, তার মানে জগতের সবকিছুই ’শুন্য’ বা দর্শনগতভাবে উচ্ছেদভাব। |
২) এ মত অনুসারে জগৎ শাশ্বত ও অসীম। | ২) এ মতের অনুসারে জগৎ অশাশ্বত ও সসীম। |
৩) এ মতের অনুসারীরা ‘আত্মা’য় বিশ্বাসী। অর্থাৎ, আত্মা শরীর বা দেহ থেকে ভিন্ন। ফলে মৃত্যুর পরেও আত্মা অবিনাশী থেকে যায় এবং জীবের বারবার জন্মানোর সুযোগ থাকছে। | ৩) আত্মা ও শরীর এক। অর্থাৎ, শরীরের বিনাশের সাথে সাথে আত্মারও বিনাশ সাধন হয়। ফলে বারবার জন্মানোর সুযোগ থাকছে না। |
দাবি–১ এর প্রতি যুক্তিঃ
১) কোন কিছুর যদি সহজাত স্বভাব বা ধর্ম থাকে তার অস্তিত্বকে বিলোপ বা বিনাশ করা যায় না।
২) চূড়ান্তভাবে যে অস্তিত্বগুলি বিদ্যমান থাকে তা চিরকালীন থাকবে না, এবং যে অস্তিত্বগুলির চূড়ান্তভাবে বিনাশ হচ্ছে তা উচ্ছেদবাদেরও সমান হবে না।
নাগার্জুনের (১৫০ – ২৫০ CE ) দ্বি-সত্য সম্পর্কে ব্যাখ্যাঃ
উল্লেখিত বুদ্ধের দ্বি-সত্য মতবাদ (অস্তিত্ব সত্য ও অস্তিত্বহীনতা সত্য) পরবর্তীতে নাগার্জুন নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করেন (Siderits and Katsura, 2013, p. 272)ঃ
১) প্রচলিত সত্য (Conventional truth – সংস্কৃত- সংভর্তী সত্য, পালি-সমুত্তি সচ্চ)ঃ যেটা আমরা প্রাত্যহিক বাস্তব জগত থেকে পঞ্চন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা) দ্বারা অভিজ্ঞতা লাভ করি। উদাহরণস্বরূপ জল, বায়ু, মাটি, প্রাণী, ইত্যাদি। অর্থাৎ এ জগতে বিদ্যমান যা কিছু আছে তারা সবই প্রচলিত সত্য।
২) পরম সত্য (Ultimate truth– সংস্কৃত- পরমার্থ সত্য, পালি- পরমার্থ সচ্চ)ঃ পরম সত্য হল, যে অস্তিত্বের স্বাভাবিক ধর্ম বা স্বভাব শূন্য (empty), অর্থাৎ যার অস্তিত্ব অন্য বস্তুর উপর নির্ভরশীল (dependent origination) নয় এবং যে ধর্ম (dharma) বা উপাদানকে (end-point) পুনরায় পৃথক বা বিভাজ্য করা যায় না।
এই জগতের বাস্তব অস্তিত্ব কিসের উপর ভিত্তি করে বা কোন মৌলিক বা অবিভাজ্য বা অন্যের উপর অনির্ভরশীল কণা দ্বারা রচিত হয়েছে ‘চূড়ান্ত বা পরম সত্য’ আমাদেরকে সে সম্পর্কে ধারনার পথ দেখিয়ে দেয়।
নাগার্জুনের মতে যারা বুদ্ধের এই দুটি সত্যের পার্থক্য বুঝবে না তারা বুদ্ধের ধর্মের প্রকৃত গভীর তত্ত্ব সম্পর্কে ধারনা লাভ করতে সক্ষম হবে না (MMK২ 24-9), (Siderits and Katsura, 2013, p. 273)।
উদাহরণ (ক)ঃ চায়ের কাপ – এটি একটি চা পরিবেশনের পাত্র (প্রচলিত সত্য- conventional truth) যা পোর্সেলিন বা চীনা মাটি দিয়ে গঠিত। এখানে পোর্সেলিন নাই চায়ের কাপও নাই। অর্থাৎ চায়ের কাপের অস্তিত্ব নির্ভর করছে পোর্সেলিনের উপর বিধায় চায়ের কাপের স্বাভাবিক ধর্ম শূন্য (empty) বা এর স্বাভাবিক ধর্ম অস্তিত্বহীন।
আবার পোর্সেলিন গঠিত হয় হাইড্রোজেন অনু (atom), এলুমিনাম অনু (atom), এবং সিলিকন অনু (atom) দিয়ে। এখানে পোর্সেলিনের অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই তিনটি মৌলিক পদার্থের অনুর উপর। সুতরাং পোর্সেলিনের স্বাভাবিক ধর্ম শূন্য (empty)।
উপরোক্ত তিনটি মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন অনু, এলুমিনাম অনু, এবং সিলিকন অনুর অস্তিত্ব নির্ভর করছে তাদের নিজ নিজ ইলেকট্রন পরমানু (sub-atom), ও নিউক্লিয়াসের (nucleus) উপর। নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন পরমানু (sub-atom) ও নিউট্রন পরমানু (sub-atom) দ্বারা। হাইড্রোজেন অনুর স্বাভাবিক ধর্ম, এলুমিনাম অনুর স্বাভাবিক ধর্ম ও সিলিকন অনুর স্বাভাবিক ধর্ম নির্ভর করছে তাদের নিজ নিজ ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের উপর বিধায় তাদের স্বাভাবিক ধর্ম শূন্য। কিভাবে বস্তুকে বিভাজ্য করা যায় তা Figure 1 এর মাধ্যমে দেখানো হল।
Figure 1: Hierarchy of particles Figure 2: An oversimplified vision of protons as made from
(Electropaedia). two up quarks and a down quark, and neutrons as made from two down quarks and an up quark — and nothing else (Strassler, 2013).
আবার প্রোটন গঠিত হয় তিনটি কোয়ার্ক (quark) দ্বারা – দুটি আপ কোর্য়াক (up quark) এবং একটি ডাউন কোর্য়াক (down quark) দিয়ে। নিউট্রন গঠিত হয় তিনটি কোয়ার্ক (quark) দ্বারা – দুটি ডাউন কোর্য়াক (down quark) এবং একটি আপ কোর্য়াক (up quark) দিয়ে (Figure 2)। সুতরাং প্রোটন ও নিউট্রন এর স্বাভাবিক ধর্ম নির্ভর করছে কোর্য়াকদের উপর বিধায় প্রোটন ও নিউট্রন এর স্বাভাবিক ধর্ম শূন্য। এখানে কোর্য়াক হল মৌলিক কণা (elementary particle)। কোর্য়াককে এখনো ভাঙ্গা সম্ভব হয় নাই। কোর্য়াকগুলি প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে ষ্ট্রং ফোর্সের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে। সুতরাং নিউট্রন ও প্রোটনকে নিউক্লিয়াস থেকে যেমন আলাদা করা যায় না আবার একটি কোর্য়াককে তাদের থেকেও আলাদা করা যায় না। অতএব এই কোর্য়াক একে অপরের উপর নির্ভরশীল বিধায় তাদের স্বাভাবিক ধর্মও শূন্য।
আবার নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন এর চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। এই ইলেকট্রন একটি মাত্রাবিহীন (dimensionless) মৌলিক কণা (elementary particle) কিন্তু Steven Chu৫ এর মতে এর বৈশিষ্ট্য নির্ভর করছে চার্জ (charge), ভর (mass), এবং ঘূর্ণন (spin) এর উপর।
অতএব আমাদের প্রতিদিনের জগতটা প্রধানত এই ইলেকট্রন ও কোর্য়াক দ্বারা গঠিত যারা হিগস ফিল্ডের ভর দিয়ে মাধ্যাকর্ষন বল, তড়িৎ-চৌম্বকীয় বল এবং পারমাণবিক শক্তির পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত।
ইলেকট্রন এর কি স্বাধীন অস্তিত্ব আছে?
কিন্তু কণা বা particle হিসাবে ইলেকট্রনের অস্তিত্বও নির্ভর করছে মন বা consciousness এর উপর (Chan, 2016, p. 19)।
এটা জানার জন্য Heisenberg৩ এর double-slit পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই পরীক্ষাটি Quantum Physics এর অদ্ভুদ আচরণ (weirdness) ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
Figure 3: Diagram illustrating the Figure 4: How electrons on the screen,
double-slit experiment using electrons accumulated over time, form an interference
pattern. (picture credit: Dr. Tanamura)
Figure 3 এ দেখা যাচ্ছে ইলেকট্রনের বন্দুক থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ইলেকট্রন ছোঁড়া হচ্ছে যেগুলো দু’টি স্লিট এর মধ্য দিয়ে পিছনের পর্দায় যাচ্ছে কিন্তু ইলেকট্রনগুলো সঠিকভাবে কোন কোন স্লিটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পরিমাপ করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় ইলেকট্রনগুলো এক অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার কারণে পেছনের পর্দায় (Figure 4) উজ্জ্বল এবং কাল প্রান্তগুলির একটি নকশার মতন সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের নকশাকে বলা হচ্ছে ‘তরঙ্গ’ (wave)। যেহেতু একমাত্র তরঙ্গের কারনেই এ ধরনের নকশা সৃষ্টি হতে পারে। তার মানে ইলেকট্রনগুলি উভয় স্লিটের মধ্য দিয়ে একই সময়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এমনকি ইলকট্রনের গতিপথ পরিমাপ ব্যাতিরেকে একবারে একটি করে ইলেকট্রন নিক্ষেপ করতে থাকলেও পেছনের পর্দায় একই ধরনের উজ্জ্বল এবং কাল প্রান্তগুলির নকশা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রত্যেকটি ইলেকট্রন পর্দার মধ্যে একটি করে বিন্দু সৃষ্টি করে। এভাবে যতবেশী ইলেকট্রন ছোঁড়া হচ্ছে ততবেশী বিন্দু সৃষ্টি হচ্ছে এবং এই বিন্দুর সমাহার অবশেষে উজ্জ্বল এবং কাল প্রান্তগুলির নকশা সৃষ্টি করে (Figure 4)।
এই double-slit পরীক্ষার মাধ্যমে একটি আশ্চয্যে্র বিষয় পরিলক্ষিত হয়, ইলেকট্রনগুলি নিক্ষেপ করার সময় যদি এদের গতিপথ পরিমাপ করা হয় তাহলে কোন স্লিট এর মধ্যে দিয়ে কোন ইলেকট্রন যাচ্ছে তা নির্ণয় করা যায় এবং সাথে সাথে পর্দায় দেখা যায় কোন নকশা সৃষ্টি হচ্ছে না। বলা হচ্ছে এটার মূল কারন হলো, পরীক্ষকের ’মন বা consciousness’ দিয়ে ইলেকট্রনের গতিপথ পর্যবেক্ষণের কারনে কোন স্লিট দিয়ে ইলেকট্রন যাচ্ছে সেই ইলেকট্রন কণা হিসাবে প্রকাশ করছে। কণা হিসাবে প্রকাশ করার কারনে ইলেকট্রনগুলি কোন ক্রমেই ‘তরঙ্গ’ হিসাবে প্রকাশ করছে না এবং পর্দার মধ্যে কোন উজ্জ্বল এবং কাল নকশা সৃষ্টি হচ্ছে না।
উপরের double-slit পরীক্ষার মূল সারাংশ হলঃ
১) ’মন বা consciousness’ দিয়ে ইলেকট্রনের গতিপথ পর্যবেক্ষণ না করলে ইলেকট্রন ‘তরঙ্গ (wave)’ হিসাবে প্রকাশ করে যাকে বলা হয় ’অবস্তু (non-matter)’।
২) ’মন বা consciousness’ দিয়ে ইলেকট্রনের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করলে ইলেকট্রন ‘কণা (matter)’ বা বস্তু হিসাবে প্রকাশ করে।
সুতরাং কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স আমাদেরকে দেখিয়ে দিল আমাদের বিজ্ঞান এবং দৈনন্দিন বাস্তবতার উপর ’মন বা consciousness’ এর একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে (Chan, 2016, p. 38)। মন ও কণা, একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা যাবে না। এই দ্বৈততা (duality) দিয়েই জগত পরিচালিত।
অর্থাৎ, নাগার্জুনের মধ্যমিকা দর্শনানুসারে বলা যায়, জগতের সবকিছুর সৃষ্টি পরষ্পর নির্ভরশীলভাবে (পতিত্যসমূদপাদ), সেইজন্য সবকিছুরই সহজাত ধর্ম শূন্য। তার মানে উভয় ‘মন’ ও ‘কণা’ পরষ্পরের উপরও নির্ভরশীল, সুতরাং তাদের সহজাত ধর্মও শূন্য এবং শূন্যতাও একটি নির্ভরশীল ধারনা। ঠিক এটাই মধ্যমপহ্না (MMK২ 24-18), (Siderits and Katsura, 2013, p. 277)। এই মধ্যমপহ্নার মানে, জগতের বাস্তবতা হল substantialism (জগতের সবকিছু পদার্থের এর উপর নির্ভরশীল) নয় এবং subjectivism (জগতের সবকিছু মনের দ্বারাই সৃষ্টি) নয়, ঠিক এই দু’য়ের এর মধ্যবর্তী।
চন্দ্রকীর্তি’র (৬০০–৬৫০ CE) সংভর্তী সত্য সম্পর্কে ব্যাখ্যাঃ
চন্দ্রকীর্তি সংভর্তী সত্যকে (Conventional truth) নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করেন (Siderits and Katsura, 2013, p. 272)ঃ
১) অজ্ঞতার আবরণ দ্বারা চূড়ান্ত বা পরম সত্যকে আড়াল করা
২) অস্তিত্বময় জগতের সবকিছু পরস্পরের উপর নির্ভরশীল
৩) পার্থিব জগতের একেকটি অস্তিত্বকে উপাধি বা নাম দিয়ে সনাক্ত করা
চন্দ্রকীর্তির উপরোক্ত ব্যাখ্যা বোঝার জন্য নিম্নোক্ত উদাহরণ মিলিন্দ-প্রশ্ন গ্রহ্ন থেকে হুবহু নেওয়া হয়েছে (মহাস্থবির, ১৯৭৭, পৃঃ ৫৪-৫৭)
উদাহরণ (খ)ঃ
২) মহারাজ! সব্রহ্মচারিগণ আমাকে নাগসেন নামে সম্বোধন করেন। তবে এখানে নাগসেন কে? ভন্তে! আপনার কেশ কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
লোম কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু অস্থি, অস্থি–মজ্জা, বক্ষ, হৃদয় যকৃৎ, ক্লোমা, প্লীহা, ফুসফুস, অন্ত্র, অন্ত্রবন্ধনী, উদরীয় (উদরস্থ খাদ্য), বিষ্ঠা, পিত্ত, শ্লোষ্মা, পূষ, রক্ত, স্বেদ, মেদ, অশ্রু, বসা, থুথু, সিকনি, লালা, মূত্র, মস্তকস্থ মগজ কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
ভন্তে! আপনার রূপ কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
আপনার বেদনা কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
আপনার সংজ্ঞা কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
আপনার সংস্কার কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
তাহা হইলে কি রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান নাগসেন?
না, মহারাজ!
রূপ–বেদনা–সংজ্ঞা–সংস্কার–বিজ্ঞান ব্যতীত আর কিছু কি নাগসেন?
না, মহারাজ!
ভন্তে! প্রশ্ন করিতে করিতে নাগসেনকে ত দেখিতেছি না। তবে নাগসেন শব্দ মাত্রই কি নাগসেন? শেষ পযর্ন্ত এখানে নাগসেন কে? ভন্তে! আপনি মিথ্যা বলিতেছেন। নাগসেন কেহ নাই।
৩) তখন, আয়ুষ্মান নাগসেন রাজা মিলিন্দকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি ক্ষত্রিয় সু–কুমার, দেহ অতি সুকোমল। এই মধ্যাহ্ন সময়ে তপ্তভুমি, উষ্ণ তপ্ত বালুকা ও প্রখর কাঁকর–পাথর মর্দন করিয়া পদব্রজে আসায় নিশ্চয় আপনার পা ব্যাথা করিতেছে, দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, মন অবসন্ন হইয়াছে, দুঃখ–যুক্ত কায়–বিজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকিবে। আপনি কি এখানে পদব্রজে আসিয়াছেন অথবা কোন যানবাহনে আসিয়াছেন”?
ভন্তে! আমি পদব্রজে আসি নাই। রথে চড়িয়া আসিয়াছি।
মহারাজ! যদি আপনি রথে করিয়া আসেন তবে আপনার রথ কি আমাকে বলুন! মহারাজ! ঈশা দন্ড কি রথ?
না, ভন্তে!
অক্ষ কি রথ?
না, ভন্তে!
চক্র কি রথ?
না, ভন্তে!
রথপঞ্জর কি রথ?
না, ভন্তে!
রথদন্ড কি রথ?
না, ভন্তে!
রথযুগ কি রথ?
না, ভন্তে!
রথরজ্জু কি রথ?
না, ভন্তে!
চাবুক কি রথ?
না, ভন্তে!
মহারাজ! তবে ঈশা, অক্ষ, চক্র, রথপঞ্জর, রথদন্ড, রজ্জু, চাবুক একত্রযোগে কি রথ?
না, ভন্তে!
মহারাজ! ঈশা, অক্ষ, চক্র, রথপঞ্জর, রথদন্ড, রজ্জু, চাবুক ব্যতীত অন্য কিছু কি রথ?
না, ভন্তে!
মহারাজ! আপনাকে প্রশ্ন করিয়া করিয়া রথ কোথায় দেখিতে পাইলাম না ত? রথ শব্দই বা কি তবে রথ? প্রকৃত পক্ষে এখানে রথ কি? মহারাজ! আপনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন। রথ নাই। মহারাজ! সমগ্র জম্বুদ্বীপে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা, কাহার ভয়ে আপনি মিথ্যা বলিতেছেন? হে পঞ্চশত যবনগণ, অশীতি সহস্র ভিক্ষুগণ! আপনারা শুনুন! রাজা মিলিন্দ বলিতেছেন, ”আমি রথে করিয়া আসিয়াছি।” যদি মহারাজ! আপনি রথে করিয়া আসেন, তবে রথ কি আমাকে বলুন। এই কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি রথ নির্ণয় করিতে পারিতেছেন না। তাঁহার কথা অভিনন্দনযোগ্য কি?
৪) এইরূপ কথিত হইলে পঞ্চ শত যবনগণ আয়ুষ্মান নাগসেনকে সাধুবাদ দিয়া রাজা মিলিন্দকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি সমর্থ হইলে এখন উত্তর দিন।” তখন, রাজা মিলিন্দ নাগসেনকে কহিলেন, “ভন্তে নাগসেন! আমি মিথ্যা বলি নাই। ঈশা অক্ষ চক্র চক্র রথপঞ্জর রথদন্ড রথ এই আখ্যা, সংজ্ঞা, প্রজ্ঞপ্তি ও নাম কেবল ব্যবহার বচনেই প্রচলিত হয়।”
”উত্তম মহারাজ! আপনি রথ কি জানিয়াছেন। এই প্রকারেই মহারাজ! কেশ ইত্যাদিকে আশ্রয় করিয়া কেবল ব্যবহারের নিমিত্ত ‘নাগসেন’ এই এক নাম কথিত হয়। কিন্তু পরমার্থ হিসাবে এখানে কোন পুদ্গল (আত্মা) বিদ্যমান নাই। মহারাজ! বজিরা ভিক্ষুনী ভগবানের সম্মুখে বলিয়াছিলেনঃ “অঙ্গসমূহকে আশ্রয় করিয়া যেমন ‘রথ’ এই নাম ব্যবহৃত হয়, সেইরূপ পঞ্চস্কন্ধকে উপলক্ষ্য করিয়া ‘সত্ত্ব’ (জীব) এই ব্যবহার প্রযুক্ত হয়।”
”ভন্তে নাগসেন! বড়ই আশ্চা্র্য! বড়ই অদ্ভুত! আপনি অতি বিচিত্র উপায়ে গভীর প্রশ্নের উত্তর দিলেন। যদি এই সময় বুদ্ধ থাকিতেন তবে আপনাকে এই ভাবে সাধুবাদ দিতেন। “সাধু, সাধু, নাগসেন! অতি বিচিত্র উপায়ে তুমি গভীর প্রশ্নের উত্তর দিয়াছ।”
চন্দ্রকীর্তির তিনটি সংভর্তী সত্যের ব্যাখ্যাকে রাজা মিলিন্দ্ ও ভন্তে নাগসেন এর উপরোক্ত কথোপকথনের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, কিভাবে এক একটি অঙ্গের নাম দিয়ে আসল সত্যকে আড়াল করা হয়েছে, কিভাবে রথ ও নাগসেন এর উৎপত্তি হয়েছে এবং কিভাবে রথ ও নাগসেন নাম দিয়ে তাদেরকে সনাক্ত করা হয়েছে।
উপরোক্ত সংভর্তী সত্যের ব্যাখ্যাকে আরো বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিভাবে পরমার্থ সত্যে উপনীত হওয়া যায় তা নিম্নের উদাহরনের মাধ্যমে পরিস্কার করা হল।
মানবদেহের শরীর যে সমস্ত মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত তা নিম্নের সারনীতে দেখানো হল (Siegel, 2017)ঃ
উপাদান | মানবদেহের শরীরের শতাংশ |
অক্সিজেন | ৬৫% |
কার্বন | ১৮.৫% |
হাইড্রোজেন | ৯.৫% |
নাইট্রোজেন | ৩.২% |
ক্যালসিয়াম | ১.৫% |
ফসফরাস | ১.০% |
পটাসিয়াম | ০.৪% |
সালফার | ০.৩% |
সোডিয়াম | ০.২% |
ক্লোরিন | ০.২% |
ম্যাগনেসিয়াম | ০.১% |
অন্যান্য: বোরন, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, কপার, ফ্লোরিন, আয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, সেলেনিয়াম, সিলিকন, টিন, ভ্যানাডিয়াম, এবং জিংক | <১.০% |
উপরোক্ত মৌলিক উপাদানগুলোকে পৃষ্ঠা নং ২ এ বর্ণিত চায়ের কাপের মতো সাব-এটোমিক লেভেলে বিশ্লেষন করলে ইলেকট্রন ও কোয়ার্ক পাওয়া যাবে যাদেরও কোন নিজস্ব স্বাধীন সত্ত্বা নাই। যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
উপসংহারঃ ম্যাথিউ রিকার্ড৪ এর মতে, ”বৌদ্ধরা মনে করে ”জগতের কোন কিছুই সত্যিকার অর্থে স্বকীয় (intrinsic) নয়, নিত্য বা স্থায়ী নয়, স্ব-নির্ভর নয়, অপরের থেকে স্বাধীন নয় বরঞ্চ একে অন্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল যা পারস্পরিক অধীনতা (interdependent) সম্পন্ন।” এবং এ জগতের বা মহাবিশ্বের সবকিছুই কা্র্যকারন এর কাঠামোর মাধ্যমে চলে এবং মহাবিশ্বে এমন কোন কিছু নাই যা কা্র্যকারন সূত্রের (causal law) আওতার বাইরে। সুতরাং কা্র্যকারনকে জানা মানে সত্যকে জানা, মধ্যমপহ্না-কে জানা মানে সত্যকে জানা, অনিত্যতা-কে জানা মানে সত্যকে জানা, পারস্পরিক নির্ভরতা-কে জানা মানে সত্যকে জানা – এটাই বুদ্ধের শিক্ষা।
পরিচিতিঃ
১. SN: সংযুক্ত নিকায়
২. MMK: মুলামধ্যমাকাকারীকা, নাগার্জুন কর্তৃক রচিত গ্রহ্ন।
৩. Heisenberg (1901-1976): Werner Karl Heisenberg was a German theoretical physicist
৪. ম্যাথিউ রিকার্ড (১৯৪৬ -): ফরাসী বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং দার্শনিক, বর্তমানে নেপালে বসবাসরত
৫. Steven Chu (1948 -): Steven Chu is a co-winner of the Nobel Prize in Physics in 1997 for the “development of methods to cool and trap atoms with laser light”
তথ্যসূত্র:
লেখক: রূপায়ন বড়ুয়া, পিইঞ্জ, অন্টারিও, কানাডা