আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। এটি বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত শোকাবহ একটি ঘটনা। এই পূর্ণিমা তিথিতেই মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ তার মহাপরিনির্বাণের দিন ঘোষণা করেন। আজ সারা বিশ্বের বৌদ্ধরা এই মহান তিথিটি নানা অনিত্য সভা এবং পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে উদযাপন করছে।
ভগবান বুদ্ধ পঁয়তাল্লিশ বর্ষাবাস অর্থাৎ অন্তিম বর্ষা রাজগৃহের বেনুবনে অধিষ্ঠান করেন। সে সময় তিনি ভীষণ রোগে আক্রান্ত হন। পরে প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর ধ্যানবলে রোগমুক্ত হন। ভগবান বুদ্ধ বেনুবনে বর্ষাব্রত শেষ করে দেশ পরিভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করেন। পরে তিনি ক্রমে বৈশালীর চাপালচৈত্যে উপস্থিত হন। তখন তার বয়স পূর্ণ হয় আশি বছরে। এ সময় তিনি চাপালচৈত্যে ধ্যানস্থ হয়ে ভাবলেন তার পরিনির্বাণের সময় সন্নিকটে। পরে তিনি ভাবলেন এখনও তার শিষ্য-প্রশিষ্য, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী এবং উপাসক-উপাসিকাগণ সুন্দর জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন করেনি। এ অবস্থায় তিনি কি পরিনির্বাণ লাভ করতে পারেন? তখন তিনি সেবক আনন্দকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আনন্দ, এই বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান। এখানকার উদ্যান, চৈত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।’ ভগবান ইচ্ছা করলে ঋদ্ধিবলে কল্পকাল অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু কাল সর্বগ্রাসী। জীবন অনিত্য, সংস্কার অনিত্য। জন্ম হলেই মৃত্যু অনিবার্য। এই বিশ্বে যে যতই শক্তি ও ক্ষমতাশালী হোক না কেন এবং যে যতই বিত্ত-বৈভব ও সম্পদ-ঐশ্বর্যের অধিকারী হোক না কেন, কেউ মৃত্যু থেকে মুক্ত হন। ধ্যানী-জ্ঞানী, মুনি-ঋষী- মৃত্যু সবাইকে স্পর্শ করে। সবাই মৃত্যুর অধীন। এই মহান সত্যটি বুদ্ধজীবনেও অনিবার্য।
ভগবান বুদ্ধ আনন্দকে আবার সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আনন্দ, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হবেন। এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই আমি পরিনির্বাপিত হবো।’ সুতরাং আজ মাঘী পূর্ণিমায় ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দিন ঘোষণাই ছিল মুখ্য বিষয়। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ঘোষণা শুনে তার শিষ্য-প্রশিষ্যগণ সবাই ব্যথিত হন, রোদন করেন। তখন বুদ্ধ তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘অনিচ্চা বত সঙখারা, উপ্পাদা বয ধম্মিনো, উপ্পাজিত্বা- নিরুজ্জন্তি ততো উপ সম সুখো।’ অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিলয় জগতের নিয়ম। উৎপত্তি হয়ে নিরুদ্ধ হওয়া জাগতিক ধর্ম। এই মহাসত্যটি জীবন ও জগতের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অতএব এই মহান সত্যবাণী ও দর্শনটি আমাদের সবারই অনুধাবন করা উচিত।
এই তিথিতে মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ তার শিষ্যদের উদ্দেশে অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন। বুদ্ধ শিষ্যদের বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ! তোমরা অপ্রমাদের সঙ্গে ধর্মপালন করিও। আমি তোমাদের উদ্দেশে এবং জগতের সব প্রাণীর হিত ও কল্যাণের জন্য যে ধর্ম ভাষণ করেছি, তা উত্তমরূপে আচরণ করিও। যে ধর্ম আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তেও কল্যাণকর সেই ধর্ম প্রচার করিও এবং বিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য পালন করিও। ‘বয ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথ’- অর্থাৎ জগতের সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, ধ্বংসশীল। অতএব তোমরা অপ্রমাদের সঙ্গে নির্বাণ সাধনা করিও।
আজ মাঘী পূর্ণিমায় সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বুদ্ধের সেই ভাষিত অনিত্য ভাবনা করেন। ইহকাল ও পরকালের সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য ধ্যান সমাধি করেন এবং জীবনকে শীলময়, ভাবনাময় ও বিশুদ্ধিপূর্ণ করার জন্য কঠোর সংকল্পে ব্রতী হন। দিনব্যাপী সব বিহারে, প্যাগোডায় এবং নিজ বাসস্থানে অনিত্য গাথা আবৃত্তি হয়, মরণানুস্মৃতি ভাবনা করা হয়। বিহারে সংঘদান ও বুদ্ধপূজাসহ অষ্টশীল গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা করা হয়।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
skbaruadu@gmail.com