1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
  3. wp-configuser@config.com : James Rollner : James Rollner
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ পূর্বাহ্ন

প্রবারণা ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

প্রতিবেদক
  • সময় রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯
  • ৫৭৯ পঠিত

ড. বিমান চন্দ্র বড়ুয়া:

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘প্রবারণা’। বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অনন্য সাধারণ এক তিথির নাম এটি।

প্রবারণার মূল লক্ষ্য হলো অন্তরের পাপমল ত্যাগ করে বিশুদ্ধিতা ও পরিশুদ্ধিতা আনয়ন। চিন্তা-চেতনা এবং নিজ নিজ কর্মে সব ধরনের লোভ-দ্বেষ-মোহের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে নির্মল থাকা। যাপিত জীবনের গতিপথে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতে কোনো পঙ্কিলতার ছোঁয়া লাগলে তা পরিশোধন করার এক ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠানের নামই প্রবারণা।
আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি প্রবারণা পূর্ণিমা নামেই পরিচিত। প্রবারণা পূর্ণিমার ধারাবাহিক কার্যক্রম শুরু হয় আষাঢ় মাসের পূর্ণিমালগ্ন থেকেই। এটির মাধ্যমে বুদ্ধ প্রবর্তিত মহান ভিক্ষু সংঘ তিন মাস বর্ষাবাসব্রত (বর্ষাবাসকালীন আবাস) পালন করেন। আর বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি হয় প্রবারণা পূর্ণিমায় (আশ্বিনী পূর্ণিমা)। তাই এটি প্রবারণা তিথি নামেও পরিচিত। তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাস পালনের শেষ দিন প্রবারণা পূর্ণিমা উদ্যাপিত হয়।

বুদ্ধ রাজগৃহে (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত) অবস্থানকালে রাজা বিম্বিসারের অনুরোধে উপোসথ শীল পালন করার অনুমতি প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে তারই ধারাবাহিকতায় তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাসের প্রতি অষ্টমী, অমাবস্যা এবং পূর্ণিমায় গৃহীরা উপোসথ পালন, ধ্যান, সমাধি এবং শীল পালন করে সুন্দর জীবন গঠনে উৎসাহিত হয়।
এ দেশে বসবাসরত বৌদ্ধ সম্প্রদায় ধর্মীয় আচার-আচরণও অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উৎসবটি পালন করে। ত্রিপিটকের অন্যতম বিনয় বিষয়ক ‘মহাবর্গ’ নামক আকর গ্রন্থে প্রবারণার সুবিন্যস্ত ঐতিহাসিক কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। বুদ্ধ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সময়ানুসারে বিভিন্ন অনুজ্ঞা প্রদান করেন। বুদ্ধ নির্দেশকৃত অবশ্যই পালনীয় বিনয় বিধানগুলোর স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট রয়েছে। তেমনি প্রবারণারও রয়েছে একটি ইতিহাসসমৃদ্ধ প্রেক্ষাপট।
প্রবারণা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবশ্যকীয় পালনীয় বিনয়কর্ম। সাধারণত ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের সময় একটি বৌদ্ধ বিহারে একাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু বর্ষাবাস পালন করেন। এ অবস্থায় একসঙ্গে বসবাস করার ফলে কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ বলেন : ‘একসঙ্গে অবস্থান করলে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে কোনো না কোনো সময় মৃদু বাদানুবাদ হওয়া স্বাভাবিক। তাই বর্ষাবাস পরিসমাপ্তির পর একত্র হয়ে একে অপরের প্রতি দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পায়। পারস্পরিক কল্যাণ সাধিত হয়। ’ এমন প্রবারণাকর্ম একদিকে ভিক্ষু সংঘের পারস্পরিক আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে, আবার অন্যদিকে অন্যায় কর্ম সম্পাদনের আশঙ্কা থেকে মুক্ত করে। সুন্দর, নির্মল, আদর্শিক এবং শৃঙ্খলিক জীবন যাপনে বুদ্ধের এই চিরশাশ্বত এবং চিরন্তন উপদেশের গুরুত্ব আজও অপরিসীম।
বলা বাহুল্য, এটি একটি অর্থবোধক শব্দের নাম। এটির দুটি প্রায়োগিক দিক রয়েছে। একটি হলো বারণ করা, নিষেধ করা, মানা ও বর্জন করা এবং অন্যটি হলো বরণ করা কিংবা স্বাগত জানানো। এখানে বারণ, নিষেধ, মানা এবং বর্জন বলতে চিত্তের লোভ-দ্বেষ-মোহ, ক্রোধ ও হিংসা ইত্যাদি ত্যাগ করাকে বোঝায়। আর বরণ কিংবা স্বাগত জানানো বলতে আচার-আচরণে সংযত হওয়া, মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা, ন্যায়-নীতি, সততা, দান, ত্যাগ ইত্যাদি কুশল মনোবৃত্তিকে বোঝায়। এখানে সব ধরনের অকুশল কর্ম কিংবা পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে অসুন্দরকে বারণের দৃঢ় প্রত্যয়ে এবং সব ধরনের কুশলকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে ন্যায়-নীতি ও সতত সুন্দরকে প্রকৃষ্টরূপে বরণের এক মঙ্গল কিংবা শুভময় প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়। বিষয়গুলো মনোজাগতিক হলেও মনের প্রবহমানতায় এগুলোর প্রভাব ক্রিয়াশীল। এগুলো সচরাচর অদৃশ্যমান এবং অবয়হীন হলেও খুবই প্রভাবশালী। আমাদের প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের মনোজগতের চেতনায় বারণীয়, নিবারণীয়, নিষেধীয় এবং বরণীয় উভয় বিষয়াবলি সুপ্তাবস্থায় বিরাজমান। শুধু আপন আপন প্রজ্ঞার আলোকে আলোকিত হতে পারলেই এগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। আর চিহ্নিত করা সম্ভব হলেই চিত্তে উদিত হয় কুশল-অকুশল, ভালো-মন্দ, হিত-অহিত ভেদে বর্জন এবং গ্রহণ-বরণের জ্ঞান। এখানেই প্রবারণার বিশেষত্ব।
প্রবারণা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণিক কর্ম হলেও গৃহীদের মধ্যে রয়েছে এটির এক অসাধারণ গুরুত্ব। এ অবস্থায় প্রবারণা গৃহীদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এ সময় তারা নিজেদের পূত-পবিত্র ও বিশুদ্ধ করে তোলে। সব ধরনের অস্থিরতা কিংবা চঞ্চলতা বিদূরিতকরণে দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে। অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যকর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। আচার-আচরণে সংযত হয়। নৈতিক ও শৃঙ্খলিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হয়। মানবিক চেতনাভাব জাগ্রত করে। দানে আগ্রহ বৃদ্ধি করে তোলে। অনিন্দ্যসুন্দর আদর্শ জীবন গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী হয়।
প্রবারণায় রয়েছে সর্বজনীন শিক্ষা। এটি আমাদের ন্যায়-নীতিপরায়ণতা কিংবা সৎপথে চলতে সহায়তা ছাড়াও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপনেও উদ্বুদ্ধ করে। এটি মূলত ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। প্রবারণার অন্যতম আকর্ষণীয় বিশেষ দিক হলো ফানুস উত্তোলন। ফানুস উত্তোলন ঘিরে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে ফানুস উত্তোলন দেখে আনন্দ লাভ করে। এ সময় দেশের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে সম্প্রীতির সমাবেশ ঘটে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমবেত সবাই উৎসবটির আনন্দ নিজেরাও ভাগাভাগি করে নেয়। এ সময় সবার উপস্থিতিতে বৌদ্ধ বিহারে এক ধরনের আনন্দঘন অসাম্প্রদায়িক এবং সম্প্রীতিময় পরিবেশ তৈরি হয়। একে অন্যে সবাই সম্প্রীতির বাতাবরণে আবদ্ধ হয়। এ ধরনের উৎসবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম কিংবা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সদ্ভাব এবং সৌহার্দ্যতা বৃদ্ধি পায়। একজন আরেকজনকে বোঝার পরিবেশ তৈরি হয়। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হয়। সবাই যখন একসঙ্গে উৎসব পালন করে তখন সবার মধ্যে জাগ্রত হয় মানবিকতাবোধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এটাই বাংলদেশের চিরায়ত সংস্কৃতি। যেখানে কে কোন ধর্মের অনুসারী কিংবা বিশ্বাসী—সেই প্রশ্ন থাকে না। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে সব ধর্মের উৎসব পালন করে। এখানেই মানবতার মূর্ত প্রতীক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগানের সার্থকতা।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!