সুনীল বড়ুয়া:
২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে সাম্প্রদায়িক হামলার সাত বছর পূর্ণ হলেও এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলার একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি। উল্টো উপযুক্ত স্বাক্ষ্য প্রমানের অভাবে বিচার কাজ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ঠরা। অন্যদিকে সাত বছরের মাথায় এসে ২০১২সালের সেই ভয়াবহতা কাটিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও এ ঘটনার বিচার কার্যক্রম নিয়ে একটা ভাবছেন না। তবে এত বড় ঘটনার বিচার না পাওয়া নিয়ে তাদের অসন্তোষ কাটেনি।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, শুরু থেকেই এ সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে তারা কিছুই জানতেন না। সব মামলার বাদি পুলিশ,আসামীও করেছে পুলিশ। পুলিশের ইচ্ছে মতেই এসব মামলার অভিযোগ পত্র দেওয়া হয়েছে। যেখানে
ঘটনার সঙ্গে জড়িতে এবং বহুল আলোচিত অনেকেরেই অভিযোগ পুলিশের অভিযোগ পত্রে নাম নেই।
অন্যদিকে ঘটনার পর পর এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হলে ও সেই সেলেরই তেমন কোন অগ্রগতি নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দিলেও ছয় বছরেও মূল মামলার চুড়ান্ত শুনানীর কোনো অগ্রগতি নেই। উল্লেখ্য উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা,লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়।এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন।
এসব ঘটনায় রামু,উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি,উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব
মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয় । এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামী ছিল ৩৭৫ জন। পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৯৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে
অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামুর ৮টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিলো ৪৫৮ জনকে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক মোরশেদ পারভেজ তালুকদার জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ূয়ার করা মামলাটি দু'পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মামলাগুলোর স্বাক্ষী পাওয়া যাচ্ছেনা। যে কারণে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সদ্য বিদায়ী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন,মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যত
অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন,এসব মামলায় স্বাক্ষী বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা ভয়ে কেউ স্বাক্ষ্য দিতে অাসছেন না। অনেকে আসলেও তারা বলছেন উল্টো। ‘বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় এসব মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। যোগ করেন সাবেক পিপি। তবে,এ মামলার তদন্তকারী কর্মমকর্তা এবং কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) কক্সবাজার এর সাবেক এক পরিদর্শক জানান, এসব মামলার মধ্যে চারটি মামলার পূণঃতদন্ত করেছে পিবিআই। এসব মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম শেষে এমনভাবে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে স্বাক্ষী পাওয়া না গেলেও আসামীদের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এরকম বিভিন্ন ছবি,ও ভিডিও ফুটেজ রয়েছে।এসব দেখে সনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । আদালত চাইলে এদের শাস্তি দিতে পারে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হতাশা-
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া জানান, এসব মামলা নিয়ে বরাবরই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে সংশয় ছিলো।কারণ সব মামলার বাদি পুলিশ। পুলিশ এজাহারে কাকে আসামী করেছে
আবার কাকে অভিযোগ পত্রে এনেছে,কাকে বাদ দিয়ে এ বিষয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছুই জানতো না। কিন্তু পরে দেখা গেছে, যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগ পত্রে নেই। তিনি বলেন, প্রকৃত অপরাধীরা বাদ পড়ায় এবং বর্তমানে আসামীরা সবাই জামিনে থাকায় স্বাক্ষীরাও স্বাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। ‘কিছু দুর্বৃত্তের কারণে রামুর হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হলো, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যদি এভাবে পার পেয়ে যায়,তাহলে এটি ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা থেকেই
যায়’। নাম প্রকাশে অনিশ্চুক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক নেতা বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর পর আদালতের নির্দেশে চট্রগ্রামের দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিয়ার নেতৃত্বে বিচার
বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তিনি বলেন,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিবেদনে ২০৫ জনকে অন্যদিকে বিচার বিভাগীয় তদন্তেও ২৯৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এ দুটি তদন্ত কার্যক্রমের বাস্তবায়ন প্রয়োগ বা কোন অগ্রগতি নেই। এমনকি বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হলেও সাত বছরেও মূল মামলার চুড়ান্ত শুনানীর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি বলেন, আরও নানা কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বোঝে গেছে, ঘটনা যত বড়ই হউক না কেন, এ ঘটনার বিচার পাবেনা তারা। কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর,ঘটনার সাত বছর হয়ে গেছে। এই সাত বছরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনে যে ক্ষত সৃষ্ঠি হয়েছিল,সেই ক্ষতও অনেকটা মুছে গেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়।
তিনি বলেন, এই একটি ঘটনা রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িকসম্প্রীতিতে’ আঘাত হেনেছিল। যে কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে আস্থার সংকট গভীর হয়। সেই সংকটও আস্তে আস্তে কেটে ওঠছে। তবে পুরোটা ফিরে আসতে সময়লাগবে। তবে বিচারের জায়গায় গিয়ে বিচার না পাওয়ার যে প্রবণতা, সেটা থেকেই যাচ্ছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ১৮টি মামলাই বর্ততমানে বিচারাধীন রয়েছে। আমি যকটুকু জেনেছি, মূলত স্বাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে।
তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে,এসব মামলার স্বাক্ষীদের পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে । কিন্তু এর পরেও স্বাক্ষীরা স্বাক্ষ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।
রামু সহিংসতা স্মরণে সংঘদান ও ধর্মসভা-
এদিকে বিভীষিকাময় রামু সহিংসতার সাত বছর অতিক্রান্তে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ,শ্রীকুল লাল চিং-মৈত্রী কমপ্লেক্স চত্ত্বরে এ বছরও দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী গ্রহণ
করেছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান,ধর্মসভা, বেলা বারটায় অতিথি ভোজন, দুপুর
২টায় মৈত্রীর্যালী এবং সন্ধ্যায় দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনা। স্মরণানুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার কথা ছিিল একুশে পদক প্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, উপসংঘরাজ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। প্রধান ধর্মদেশক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব এস লোকজিৎথের। অনুষ্ঠানে সকলের উপস্থিতি কামনা করেছেন ২৯ সেপ্টেম্বর উদযাপন পরিষদের আহবায়ক ও রামু আর্য্যবংশ ভিক্ষু সংস্থার মহাসচিব প্রিয়রত্ন মহাথের।