1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ১১:৫৮ অপরাহ্ন

শুভময় প্রবারণা পূর্ণিমা

প্রতিবেদক
  • সময় মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৮
  • ১৮০৭ পঠিত

শতদল বড়ুয়াঃ

আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সব পূর্ণিমা তিথি কোনো না কোনো কারণে বৌদ্ধদের জন্য শুভময় দিন। তাই আজকের পূর্ণিমা তিথি ব্যাপক তাৎপর্য বহন করছে। প্রবারণা শব্দের অর্থ ‘আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, ধ্যান বা শিক্ষা সমাপ্তি বোঝায়।’ অন্যদিকে আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনাও বলে। আজকের দিনে ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য একে অন্যকে করজোড়ে বলেন, ‘বন্ধু, যদি আমার কোনোরূপ দোষত্রুটি দেখ বা কারো থেকে শুনে থাক এবং এ কারণে যদি আমার ওপর সন্দেহ হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে বলুন, আমি তার প্রতিকার করব।’ বিনয় পিটকের পরিভাষায় একে বলে ‘প্রবারণা’। এ শুভ তিথিতে ভগবান বুদ্ধ দেবলোক হতে সাংকশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন। ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রতাদি সম্পন্ন হলো আজকের দিনে। এ কারণে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধদের পরম পবিত্র দিন। আগামীকাল থেকে মাসব্যাপী প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামে পালাক্রমে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় শুরু হচ্ছে দানশ্রেষ্ঠ ‘কঠিনচীবর দান’।

ভিক্ষুরা একসঙ্গে তিনটি চীবর ব্যবহার করতে পারেন। সেগুলো হলো উত্তরাসঙ্গ, সংঘাটি ও অন্তরবাস। উল্লিখিত, এগুলোর যেকোনো একটা দিয়ে ‘কঠিনচীবর দান’ করা যায়। কঠিনচীবর দানের দিন অরুণোদয় হতে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ে সূতা কাটা, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা (কর্তন), সেলাই ও রং করা প্রভৃতি কাজ উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে দান করতে হয়। বাংলাদেশের একমাত্র রাঙামাটির রাজবন বিহার ছাড়া অন্য কোনোখানে এ নিয়মে কঠিনচীবর দান করা হয় না। রাঙামাটি রাজবন বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ প্রয়াত সাধনানন্দ মহাথেরোর (প্রকাশ বনভান্তে) একক প্রচেষ্টায় এবং সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণ সহযোগিতায় এখনো এ নিয়ম পালন অব্যাহত রয়েছে। ইদানীং বাজার থেকে কাপড় ক্রয় করে কঠিনচীবর দান করা হয়। তবে এতে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক অতিরিক্ত পুণ্য সঞ্চয় না-ও হতে পারে। এটাই কঠিনচীবর দানের বিশেষত্ব। তাই এ দানকে ‘দানশ্রেষ্ঠ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। চীবর তৈরি হলে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করে নিম্নোক্তভাবে তিনবার বলে ভিক্ষুসংঘকে চীবর দান করতে হয় : ‘ইমং কঠিন চীবরং ভিক্খুসঙ্ঘস্স দেমং, কঠিন অত্থরিতুং।’

কঠিনচীবর দানের ফল অসংখ্য ও অপ্রেময়। মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, ‘অন্যান্য দানীয় সামগ্রী শত বছর দান করেও যে পুণ্য সঞ্চিত হয়, কঠিনচীবর দানের ফল তা হতে ষোলগুণ বেশি। শত বছর মহাপুণ্যপদ অষ্ট পরিষ্কার দান করলেও তার ফল এই দানের ষোল ভাগের একভাগের সমান হবে না। স্বর্গের বৈজয়ন্ত প্রাসাদ সাদৃশ্য চুরাশি হাজার রতœময় বিহার দান করলেও সেই দানময় পুণ্যাংশ কঠিনচীবর দানের প্রভাবে স্ত্রী বা পুরুষ জন্ম-জন্মান্তরে স্ত্রীজন্ম লাভ করেন না। কঠিনচীবর দান প্রদানকারী এবং দান গ্রহণকারী উভয়ের ফল পুণ্যময়। কঠিনচীবর লাভের ভিক্ষুর পঞ্চফল এবং তিনি পাঁচটি দোষমুক্ত হন। কঠিনচীবরলাভী পঞ্চফলগুলো নিম্নরূপÑ ক. পূর্বাহ্নের জন্যে নিমন্ত্রিত ভিক্ষু দাতার বাড়ি হতে সহপাঠীর অপরাপর ভিক্ষুকে না বলে অন্যগৃহে গমন করতে পারে, খ. যে বিহারে কঠিনচীবর প্রাপ্ত হয়, তা সমস্তই কঠিনচীবর লাভী ভিক্ষুরই অধিকার থাকবে, গ. অধিষ্ঠিত ত্রিচীবর নিজের হস্তপাশে না রেখে অরুণোদয় পর্যন্ত থাকতে পারবে, ঘ. অতিরিক্ত ইচ্ছানুরূপ অধিষ্ঠান কিংবা বেনামায় নিজের নিকট রাখতে পারবে ও ঙ. চারিজনের একাধিক ভিক্ষু নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভোজন করতে পারবে। বিহারস্থ ভিক্ষুগণ কঠিনচীবর অনুমোদনের পর আগুন্তুক ভিক্ষুরা অনুমোদন করতে পারেন।

মহাকারুণিক বুদ্ধ পাথ্যেয়কবাসী ৩০ জন ভিক্ষুকে উপলক্ষ করে দানোত্তম কঠিনচীবর দানের প্রবর্তন করেছিলেন। বুদ্ধ একসময় পঞ্চশত ষড়ভিজ্ঞ অরহত ভিক্ষুসহ আকাশ পথে হিমালয়ে গিয়ে ‘অনবতপ্ত হ্রদ’ নামক মহাসরোবরে উপস্থিত হন। সহস্র দল পদ্মে উপবিষ্ট হয়ে বুদ্ধ বললেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, নাগিত স্থবিরের মুখে কঠিনচীবর দানের মাহাত্ম্য শোন। অতপর নাগিত স্থবির বলতে লাগলেন, ‘আমি শিখি বুদ্ধের সময়ে বহুবিধ পুণ্যকর্মসহ উত্তম পুণ্যশ্রেষ্ঠ সংঘমধ্যে কঠিনচীবর দান দিয়ে এই কল্প থেকে বিগত ত্রিশকল্প পর্যন্ত দুর্গতি অনুভূতি করিনি। আঠারকল্প দেবলোকে দিব্যসুখ ভোগ করেছি। চৌত্রিশবার ইন্দ্র হয়ে দেবকূলে রাজত্ব করেছি। অজস্রবার ঐশ্বর্যশালী ব্রহ্মা হয়েছি। কোথাও আমার ভোগ সম্পদের অভাব হয়নি। যেখানে জন্মগ্রহণ করি না কেন, সেখানে সম্পত্তি লাভের কোনো কমতি থাকত না। যে ফলগুলোর কথা বললাম, সবগুলোই একমাত্র কঠিনচীবর দানের ফল। নাগিত স্থবিরের ভাষণ শেষ হলে ভগবান বুদ্ধ পুনরায় কঠিনচীবর দানের ফল ব্যাখ্যা করেন, ‘হে ভিক্ষুগণ শিখিবুদ্ধের সময় সনজয় ব্রাহ্মণ হয়ে কঠিনচীবর দান করেছিলাম। তার মহাফল বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি পর্যন্ত ভোগ করেছি। অষ্ট পরিষ্কারাদি অন্যান্য যাবতীয় দানীয় সামগ্রী শত বছর ধরে দান দিলেও কঠিনচীবর দানের ষোল ভাগের একভাগের সমান হবে না। বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ ও মহাশাবকগণ কঠিনচীবর দানের ফল প্রাপ্ত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছেন। যিনি শ্রদ্ধাসহকারে কঠিনচীবর দান করেন তার ফল তিনি প্রয়োজনে বিস্তৃত কনক বিমান, সহস্র অপসরা এবং মণিমুক্তা বৈদুর্য্য এবং কল্পকর্ম প্রভৃতি সম্পদ এবং দিব্যপুস্করিণী লাভ করেন। ইহার পঞ্চফল যুক্ত এবং পঞ্চ দোষ বিবর্জিত। এই কঠিনচীবর দানের কথা ভগবান দেশনায় বলেছেন, ইহার ফল অসংখ্য ও অপ্রেময়। সুতরাং, প্রত্যেকের জীবনে অন্তত একবার কঠিনচীবর দান করা একান্ত প্রয়োজন। ইহা ভবিষ্যতে মহাফল দান করে।

ঐতিহ্যেরই একটা অংশ ফানুস। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পুণ্যময় একটি ঐতিহ্যেরই প্রতীক। মহামানব গৌতম বুদ্ধ ছিলেন রাজা শুদ্ধোধনের ছেলে। কপিলাবস্তু নগরীতে পরিভ্রমণকালে রাজার ছেলে সিদ্ধার্থ দেখেছিলেন শবযাত্রা, রুগ্ণ মানুষ, সন্ন্যাসি, বয়স্কলোকসহ মানবের দুঃখ-কষ্টের নানা দৃশ্য। সিদ্ধার্থ ভাবলেন, ‘মানবজীবন তো দুঃখময়, এর থেকে পরিত্রাণের পথ নিশ্চয় আছে। আমি জীবের মুক্তির পথ খুঁজে বের করব। জীবের কল্যাণ আনায়নের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করব।’

আড়াই হাজার বছরেরও অধিককাল আগের কথা। সংসারের সকল মায়া ত্যাগ করে, স্ত্রী-পুত্রের বন্ধন ছিন্ন করে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গভীর রাতে গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে গিয়ে হাজির হলেন। মানবমুক্তির পথ সন্ধানে চলে যাওয়ার মুহূর্তে সিদ্ধার্থ শরীর থেকে খুলে ফেললেন একে একে সব কাপড় তথা রাজকীয় পোশাক। পরিশেষে স্বীয় তরবারি দিয়ে নিজের মাথার চুল কেটে এ সত্যক্রিয়া অধিষ্ঠান করলেন, ‘আমি যেই উদ্দেশ্যে রাজসুখ ত্যাগ করে মায়াময় সংসার থেকে মুক্ত হয়েছি সেই উদ্দেশ্য যদি সফলকাম হয় তাহলে আমার মাথার কাটা এ চুলগুলো বাতাসে নিচে না পড়ে আকাশ পথে উড়ে যাবে।’ এই বলে হাতের মুঠোর চুলগুলো রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বাতাসে উড়িয়ে দিলো। তার চুলগুলো সেদিন নিচে পড়েনি, আকাশ পথে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তথাগত বুদ্ধের সেই সত্যক্রিয়ার সত্যনিষ্ঠ আবহে আজও আশ্বিণী পূর্ণিমা তথা প্রবারণা পূর্ণিমার দিন আকাশ মার্গে সিদ্ধার্থের চুলগুলো উড়ে যাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা-বন্দনা জানানোর জন্যে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা ভক্তি-প্রণত চিত্তে ‘ফানুস’ উড়ায়। ফানুস উড়িয়ে বুদ্ধের চুলধাতুকে পূজা করে বন্দনা জানায়। বুদ্ধ বিধান অনুযায়ী দীর্ঘ তিন মাস বর্ষাবাস পালন করা হয়। ভিক্ষুসংঘসহ উপাসক-উপাসিকা, দায়ক-দায়িকারা এ সময় ধর্ম অনুশীলনে রত থাকেন স্ব স্ব বিহারে। শেষ দিন শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। ‘প্রবারণা’ শব্দের মূল অর্থ হলো, ‘আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, শিক্ষা সমাপ্তি বা ধ্যান শিক্ষা সমাপ্তি বোঝায়। অন্যদিকে আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনা বলে।’ এ দিন ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্যে একে অন্যকে কড়জোড়ে বলেন, ‘বন্ধু, যদি আমার কোনো রূপ দোষত্রুটি দেখে, শুনে ও সন্দেহ করে থাকেন আমাকে বলুন, আমি তার প্রতিকার করব। বিনয় পিটকের পরিভাষায় এটাকেই ‘প্রবারণা’ বলে।’

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’। দ্বিতীয় প্রধান উৎসব ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’। বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পূর্ণিমা উপভোগের সুযোগ পায়। কিন্তু প্রবারণা পূর্ণিমায় সেই সুযোগ নেই সরকারি ছুটি না থাকায়। এত বড় একটা স্মরণীয় উৎসব পরিবারের সবার সঙ্গে মিলিত হয়ে পালনের সুযোগের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিবেদন, প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য বছরে শুধু একদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!