এম.বোধিরত্ন ভিক্ষু:
লিচ্ছবিবংশজাত মহানাম ছিলেন বৈশালীর এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক। একদিন যখন তিনি তাঁর প্রমোদ উদ্যানে ভ্রমনরত ছিলেন, তখন তাঁর উদ্যানপালক একটি সদ্যোজাত শিশুকণ্যাসহ মহানামের সম্মুখে উপন্থিত হয়ে জানায় যে, সে একটি আব্রবৃক্ষমূেলে শায়িত এই শিশুটিকে দেখে তাকে সেই স্থান থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।মহানাম ছিলেন নিঃসন্তান।শিশু কন্যাটিকে দেখে বাৎসল্যরসে তাঁর রিদয় পর্ণ হয়ে ওঠায় সাগ্রহে উদ্যানপালকের হস্ত থেকে শিশুটিকে গ্রহণ করলেন এবং স্ত্রীর হস্তে তাকে অপর্ণ করলেন।স্ত্রীর ও সাদরে শিশুকন্যাটিকে বক্ষে ধারণ করলেন।তদবধি শিশুটি এই নিঃসন্তান দম্পতীর স্নেহচ্ছায়ায় তাঁদের আপন কন্যারুপে পতিপালিত হতে লাগল।অপদান গ্রন্থে বলা হয়েছে যে আম্রশাখান্তরে ঔপপাতিক (স্বয়ং সম্ভবা)রুপে জন্মগ্রহণ করায় উক্ত শিশুকন্যাটি নাম রাখা হয় আম্রপালী(অম্বপালী)।
বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আম্রপালী অনিঅনিন্দ্যসুন্দরী হয়ে উঠলেন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি মূলক নানা বিদ্যার্জনের সঙ্গে নৃত্য-গীত-বাদ্যেও বিশেষ নিপুণতা লাভ করলেন।ক্রমে আম্রপালী রুপে-গুণের খ্যাতি বিস্তত হল, ফলে তাঁকে লাভ করার জন্য বহু রাজপুত্র উদগ্রীব হয়ে উঠলেন,ক্রমে তাঁরা পরস্পরের মধ্যে কলহে প্রবৃত্ত হচ্ছেনন দেখে মহানাম প্রমাদ গণলেন,কারণ কন্যার পাণিপ্রাথীদের মধ্যে যাঁকেই তিনি বিমুখ করবেন তিনিই হয়ে উঠবেন মহানামের ঘোর শক্র।উপায়ান্তর না দেখে তখন মহানাম এক সভা আহ্বান করলেন।সেই সভায় আম্রপালীর বিবাহ প্রসঙ্গ উল্থাপিত হলে সভাস্থ ব্যক্তিবর্গ আম্রপালীকে সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য মহানামকে অনুরোধ জানালেন।পিতার আদেশে কন্যা আম্রপালী সভায় উপস্থিত হলে সভাস্থ সকলে একবাক্যে স্বীকার করলেন যে,সর্বাঙ্গ -সুন্দরী আম্রপালী স্ত্রীর রত্ন।বৈশালীতে তৎকালীন প্রচলিত নিয়মানুসারে সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী বিবাহ করতে পারতেন না তিনি হতেন গণভোগ্যা।অতএব সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীরুপে স্বীকৃতা আম্রপালীকেও এই প্রচলিত নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধা হতে হবে।এই সিদ্ধান্ত উক্ত সভায় গৃহীত হলে মহানাম অত্যান্ত ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়ে পগলেন,কিন্ত্ত সভায় গৃহীত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদ করতেও সাহসী হলেন।স্নেহময় পিতার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আম্রপালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে সভায় এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।আম্রপালীর উক্ত শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) নগরের সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ)একবারে একজন মাত্র তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ)তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত কার্ক্ষাপণ(কহার্পণ)।
(ঘ)শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ)তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।
আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই উক্ত সভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।এরপর বারবিলাসিনীরূপে আম্রপালীর জীবনের নতুন অধ্যায় আরম্ভ হল।কালেক্রমে তিনি প্রচুর অর্থ-সম্পদের অধিকারিণীহলেন।বিনয়পিটকে উল্লিখিত আছে যে আম্রপালী বিভিন্ন স্থান থেকে দক্ষ চিত্রশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের দ্বারা বহু রাজা,মন্ত্রী, সম্ভ্রান্ত নাগরিক এবং ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠীগণের প্রতিকৃতি নিজ গৃহের প্রাচীরে অম্কিত করিয়েছিলেন।এই সকল প্রতিকৃতির মধ্যে মগধরাজ বিম্বিসারের প্রতিকৃতি দেখে আম্রপালী মোহিত হন এবং মগধরাজের সহিত মিলনের জন্য অধীর হয়ে ওঠেন।অপরপক্ষে মগধরাজ বিম্বিসারের ও আম্রপালীর অপ্সরীতুল্য। রূপের খ্যাতি শ্রবণ করে তাঁকে দেখার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হন।সেই সময় লিচ্ছবীদের সঙ্গে মগধরাজের সদ্ভাব ছিল না,কিন্ত্ত আম্রপালীকে দেখার আগ্রহে তিনি সকল বাধা অগ্রাহ্য করে শক্র রাজ্যের রাজধানী বৈশালীতে অবস্থিত আম্রপালীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এবং সপ্তাহকাল আম্রপালীর গৃহে নিরাপদে অবস্থনও করেছিলেন।মগধরাজ বিম্বিসারেরে ঔরসে আম্রপালীর গর্ভে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়।ওই পুত্রটি বিম্বিসারেরে অন্যান্য পুত্রদের সহিতত সমান মর্যাদায় রাজপ্রাসাদে লালিত পালিত হয়।কালত্রমে আম্রপালীর পুত্র বৌদ্ধভিক্ষুসংঘভুক্ত হন এবং বিমল কৌণ্গুণ্য(বিমল কোন্ডঞ্ঞ)নামে খ্যাত হন।পুত্রের নিকট মাতা আম্রপালী ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে বৌদ্ধধর্মে শ্রদ্ধাবতী হন,এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের জন্য তাঁর হূদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
অশীতিপর বয়সে বুদ্ধ যখন বেশালীর আম্রপালীর আম্রকাননে অবস্থান করছিলেন সেইসময় এই সংবাদ শ্রবণ করে বুদ্ধকে ভক্তিপুর্ণ প্রাণের প্রণতি জানাতে আম্রপালী সেই স্থান গমন করেন। বুদ্ধের চরণে পণতা আম্রপালীকে আশীর্বাদ করে বুদ্ধ তাঁকে ধর্মোপদেশ সহ মুক্তির পথ প্রদর্শন করলেন।মুক্তপথের সন্ধান পেয়ে আম্রপালীর রিদয় আনন্দে পর্ণ হল। যথারীতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আম্রপালী সসংঘ বুদ্ধকে তাঁর গৃহে পরদিবস আহারের জন্য নিমন্ত্রণ করে (অধিবাসেতু মর মে ভন্তে ভগবা স্বাতনায় ভত্তং সদ্ধিং ভিকখুসংযে নাতি)অভিবাদনান্তে স্বগৃহে ফিরে গেলেন।লিচ্ছবীরা যখন শুনলেন,বুদ্ধ ইতিমধ্যে আম্রপালীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন তখন তাঁরা আম্রপালীকে অনুরোধ করলেন-লিচ্ছবীদের কাছ থেকে শত সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করে আম্রপালী যেন এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন।(দেহি জে অম্বপালি এত ভত্তং সতসহসসেনাতি) লিচ্ছবীদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আম্রপালী জানালেন যে,সমগ্র বৈশালী নগরের বিনিময়ে ও তিনি এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করবেন না।অতিথিসেবক হিসাবে বুদ্ধর নিকট আম্রপালী অপ্রক্ষা লিচ্ছবীদের প্রাধান্য বেশী হতে পারে এই চিন্তা করে লিচ্ছবীরা বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন যে,বুদ্ধ যেন আম্রপালীর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে লিচ্ছবীদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।কিন্ত্ত বুদ্ধ লিচ্ছবীদের এ অনুরোধ রক্ষা করতে অসম্মত হলেন।তখন লিচ্ছবীরা আম্রপালীর নিকট পরাজিত হওয়ার জন্য আক্ষেপ করতে থাকলে বুদ্ধ উপদেশদানে তাঁদের সকলকে শাস্ত করলেন।অতঃপর বুদ্ধকে যথারীতি অভিবাদন জানিয়ে সন্ত্তষ্ট চিত্তে লিচ্ছবীরা ফিরে গেলেন।বুদ্ধর ভিক্ষুসংঘসহ নির্দিষ্ট দিনে বারঙ্গনা আম্রপালীর গৃহে নানা উপচারে আহার গ্রহণ করেছিলেন।উপরোক্ত ঘটনা কয়েকটি তথ্যপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে বলে উল্লখ করা যায়।