২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। আজ থেকে ছয় বছর আগে ভয়াল এ রাতের বিভীষিকা মুছে দিয়েছিল কক্সবাজারের রামুর শত বছরের ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তীর্থে সৃষ্টি হয়েছিল অবিশ্বাসের বিশাল ক্ষত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের আইডিতে পোস্ট করা একটি ছবি নিয়ে রামুর বৌদ্ধ বিহারগুলোয় অগ্নিসংযোগ এবং বসতিতে হামলা চালানো হয়। সম্প্রীতির তীর্থ হিসেবে পরিচিত রামুতে এ সহিংস ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
সহিংসতা-পরবর্তী সরকারের যথাযথ উদ্যোগের ফলে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়। নির্মিত এসব বিহারে এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায় উপাসনা ও ধর্মীয় সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় রামুর বিহারগুলো দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক ছুটে আসছেন।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক কাজী দিদারুল ইসলাম জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এরমধ্যে ৫টি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনটি মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করে পিবিআই।
তিনি বলেন, ১৮টির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। তবে উপযুক্ত সাক্ষী না পাওয়ায় এসব মামলার গতিও থমকে আছে। নাম-ঠিকানা ধরে পাওয়া যাচ্ছে না মামলার বেশিরভাগ সাক্ষীকে। অনেক সাক্ষী আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরি সাক্ষী’ হিসেবে।
কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক কৈশানু মার্মা জানান, রামুর উখিয়ার ঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, মোট ৫টি মামলা তাদের কাছে পাঠানো হলেও এর মধ্যে চারটি মামলা অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি একটি মামলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশনা ছিল আদালতের। কিন্তু ওই সময় এ পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কক্সবাজার পিবিআই-এ না থাকায় তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। পরবর্তীতে জবাব দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তবে পিবিআইএর এ কর্মকর্তার দাবি, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে তাদের শাস্তি দিতে পারেন।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এসব মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। আর যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, এরা বলেছেন উল্টো। তাই বেশিরভাগ সাক্ষীকে ‘বৈরি ঘোষণা’ করেছেন আদালত। তিনি বলেন, বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে এসব মামলার বিচার।
তিনি বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী যারা তারা যদি সাক্ষ্য না দেন, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
j
এদিকে আজ (২৯ সেপ্টম্বর) রামু সহিংসতার ৬ বছর উপলক্ষে রামুতে বৌদ্ধ যুব পরিষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানা গেছে। কর্মসূচির মধ্যে বিকালে শ্রীকুল গ্রামের লাল চিং-সাদা চিং মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত হবে স্মৃতিচারণ, হাজার প্রদীপ প্রজ্বলন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিহারে পালন করা হবে ধর্মীয় কর্মসূচি।
এদিকে ২০১২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর
রামুতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার স্মরণে
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ’ প্রতি বছরের ন্যাায় বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ চত্ত্বরে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।আলোর শরণে কাটুক আধার’ শিরোনামে এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেেব স্বাস্হ্য মন্ত্রী জনাব মো: নাসিম উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, একে একে ৬ বছর পার হয়ে গেল। এরই মধ্যে সেদিনের ভয়াবহতা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে বর্তমানে রামুতে সব ধর্মের মানুষ অতীতের মতো শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে হয়ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনের ক্ষত মুছে যাবে।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ যুব পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিপুল বড়ুয়া আব্বু জানান, সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এখন রামুর সব ধর্মের মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে; কিন্তু হামলার পর পুলিশের দায়ের করা মামলাগুলোতে অনেক নিরীহ ব্যক্তিকে জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায় চায় নিরপরাধ কোনো মানুষই যেন মামলায় হয়রানি না হয়।