এম. বোধিরত্ন ভিক্ষুঃ
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন অশোক। সম্রাট বিন্দুসার এর ঔরসে ও রাণী ধর্মা ( মতান্তরে সুভদ্রাঙ্গির) গর্ভে। উত্তর – ভারতের কিম্বদন্তী অনুসারে চম্পাদেশীয় রাজকণ্যা সুভদ্রাঙ্গী ছিলেন অশোকের মা।আর দক্ষিণ ভারতীয় কিম্বদন্তী অনুসারে তাঁর মায়ের নাম ধর্মা।তাঁর চারজন স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- তিশ্যারাক্ষ, পদ্মাবতী, কারুভাকী, বিদিশা। মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে বিন্দুসার তাঁকে উজ্জ্বয়িনীর শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, তক্ষশীলায় বিদ্রোহ শুরু হলে বিন্দুসার তাঁকে বিদ্রোহ দমনের জন্য তক্ষশীলায় পাঠান। অশোক এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলে, তাঁকে তক্ষশীলার শাসনভার লাভকরেন। এই মসয় তিনি মহাদেবীকে বিবাহ করেন।
বিন্দুসারের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের দখল নিয়ে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়।বৌদ্ধ কিম্বদন্তী অনুসারে জানা যায়, বিন্দুসারের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬ জন এবং পুত্রের সংখ্যা ছিল ১০১ জন।তাঁর মত্যুর পর পুত্র অশোক অন্যান্য ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। সিংহলীয় উপাখ্যানসমূহে পাওয় যায়, তিনি তাঁর ৯৮ জন ভাইদের হত্যা করেছিলেন। এই জন্য তাঁকে চন্ডাশোক বলা হয়েছে। সিংহাসন দখলের পর, দেবানাম – প্রিয়- পিয়দসী অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী উপাধি ধারণ করেন। ধারণা করা হয় তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে সিংহাসন লাভ করেন।কিন্তু তাঁর সম্রাট হিসাবে অভিষেক হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দের দিকে।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০-৬৩ অব্দের দিকে তিনি কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন।এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাসী সর্বশক্তি দিয়ে অশোকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও কলিঙ্গবাসী পরাজিত হয়।এই যুদ্ধে এক লক্ষ নরনারী প্রাণ হারায় এবং প্রায় দেড়লক্ষ নরনারী বন্দী হয়।এই যুদ্ধের এই বীভৎসতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্হ করে তোলে। পরে তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন।এরপর তিনি ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ ধম্রের প্রতি বিশেষভাবে আসত্তু হয়ে পড়েন এবং উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্মগ্রহণ করেন।এরপর থেকে তিনি অহিংসা নীতি গ্রহণ করনে।তিনি তার্র গুরু উপগুপাদ্তকে সাথে নিয়ে কপিলাবস্তু,লুম্বিনী,কুশীনগর, বুদ্ধগয়া -সহ নানা স্হানে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধম্রের প্রচার করেন।এই সময় তিনি নানা স্হানে ম্তপ, স্তম্ভ এবং পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বানী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাবস্থা করেন।জনকল্যাণের জন্য তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেন।জলকষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ্যের বিভিন্ন স্হানে জলাশয় তৈরি করে দেন।অশোকের এই অহিংস নীতির কারণে, তার্র সাথে প্রতিবেশী রাজ্যে এবং গ্রিকদের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠে।তিনি সিরিয়া, মিশর, এপিরাস, সিংহল, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, নেপালপ্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিনিধি পাঠান।খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২অব্দে সম্রাট অশোক মৃত্যুবরণ করেন।তিব্বতীয় কিম্বদন্তী অনুমারে জানা যায় তিনি তক্ষশীলায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
অশোকের ধর্মনীতি ও ধর্ম প্রচারঃ
অশোক বৌদ্ধ এবং জৈন ধম্রের অনুরাগী ছিলেন।তবে তাঁর ধর্ম প্রচারণা এবং জীবনাদর্শ বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য পেয়েছিল। অশোক বিহারযান্রার পরিবর্তে ধর্মযান্রার প্রচলন করেছিলেন।
।তীর্থযাক্রার সাথে তিনি যুত্তু করেছিলেন শ্রামণদের উপহার দান, বুদ্ধের বাণী প্রচার এবং নানাবিধ উপদেশের মধ্য দিয়ে মানুষকে ধর্মভাবাপন্ন করার কার্যক্রম। সাধারণ মানুষকে বৌদ্ধ ধর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্হানে (পাহাড়ের গায়ে, পাথরের স্তমম্ভে, পবর্তগুহায়)বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।ধর্মীয় প্রচারের জন্য তিনি রাজুক, যুত এবং মহাপান্র নামক পদের সৃষ্টি করেছিলেন।এরাঁ অশোকের ধর্মনীতিকে প্রচার করতেন।এছাড়া রাজর্মচারীদের দ্বারা সাধারণ মানুষ যাতে নিগৃহীত না হয়।তার জন্য ধর্মমহাপান্র নামক কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের জন্য এবং বৌদ্ধ সংঘসমূহের ভিতরে আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাটলিপুত্র নগরে একটি বৌদ্ধ সংগীতি অর্থাৎ তৃতীয় সংগীতি আহ্বান করেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি রাজপুত্র মহেন্দ্রকে সিংহল দ্বীপে পাটিয়েছিলেন।
অশোকলিপি ঃ
অশোক নানারকমের বাণী পাহাড়ের গায়ে, পাথরের স্তম্ভে, পর্বতগুহায় লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাবস্থা করেন। যে সকল লিপিতে এই বাণী লেখা হয়েছিল, সে সকল লিপিকে সাধারণভাবে অশোকলিপি বলা হয়। এই সকল বাণী লেখা হয়েছিল ব্রাক্ষীলিপি ও খরোষ্ঠীলিপিতে। অবশ্য ব্রাক্ষীলিপির আদিপাঠগুলো সম্রাট অশোকের নির্দেশে স্থাপিত হয়েছিল বলে, অনেকে এই লিপিকে অশোকলিপি নামে অভিহিত করেছেন।

অশোকস্তম্ভ ও অশোকচক্রঃ
চারটি সিংহের মুখযুত্তু একটি একক মূর্তি।এই সিংহ চারটি পশ্চাৎ অংশ যুত্তু থাকে এবং মুখগুলো চারটি দিকে নির্দেশ করে।এর ফলে যে কোন দিক থেকে তিনটি সিংহের মুখ একবারে দেখা যায়।এই চারটি সংযুক্ত সিংহমূর্তি একটি একটি উল্টানো পদ্মফুলের উপরে বেদীটি স্হাপিত থাকে।এই বেদীর পার্শ্ব বরাবর খোদিত আছে চারটি প্রাণীর রিলিফ মূর্তি।এই প্রাণীগুলো হলো -একটা হাতি, একটি দৌড়ানো ঘোড়া, একটা ষাঁঙ এবং একটি সিংহ।এই চারটা জন্ত্তর মাঝে রয়েছে একটি করে চক্র।এই চক্রকে বলা হয় অশোক চক্র বা ধর্ম চক্র।
অশোক চক্র বা ধর্ম চক্রঃ
অশোক চক্রের কেন্দ্র থেকে ২৪ টি শলাকা, সাইকেলের চাকার মতো এর ছড়ানো। তবে এই শলাকাগুলো এর পরিধির সাথে যুক্ত থাকে না। এর শলাকাগুলো ২৪ টি বিষয়ের প্রতিক হিসাবে নির্দেশিত হয়।
সুত্ত নিপাতে বলা হয়েছে – শাক্যদের একটি গ্রাম লুম্বিনি জনপদে গৌতম বুদ্ধ জন্ম হয়। বৌদ্ধ পুরাণ অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধের মা মায়াদেবী শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু থেকে তার পৈতৃক বাসগৃহে যাচবছিলেন। পথিমধ্যে লুম্বিনি বনেরএকটি শালগাছের নিচে গৌতম।বুদ্ধের জন্ম হয়। বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবী এখানে একটি দীঘিতে স্নান করেন। সিদ্ধার্থ গৌতমকে ও জন্মের পর এই দীঘিতে স্নান করানো হয়। পরে এখানে মায়াবেদী মন্দির প্রতিষ্টিত হয়। এই মন্দিরের একটি স্থানকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্হান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুুরক্ত হয়ে অশোক এই তীর্থভূমি পরিদর্শনে এসে দছিলেন।অশোকের আগমনের স্মারক হিসাবে এখানে একটি অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়।