রাজীব বড়ুয়াঃ ভবনদী শব্দের ব্যঞ্জনপূর্ণ অর্থ হল মার ভূবন হতে অমার ভূবনে উন্নীত হবার মধ্যভাগের মাধ্যম। সরল ভাষায় বলি, আমরা আমাদের কর্মের গতিনুযায়ী পরবর্তী জন্মের হেতু উৎপন্ন করছি। যার ফলে বার বার জন্ম নিতে হচ্ছে নানা প্রকার আসক্তি এবং তৃষ্ণার কারণে। এই আসক্তি আর তৃষ্ণার মূল কারণ হল অজ্ঞানতা। তৃষ্ণা বা আসক্তিতে আমরা কিভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি সেটা না জানাটাই হল অজ্ঞানতা।
জানাটা হল জ্ঞান, বিশেষভাবে জানাটাকে আবার প্রজ্ঞা বলা হয়। জ্ঞান আর প্রজ্ঞার স্তর একই নয়। উপমা প্রয়োগ ব্যতীত উভয়ের অন্তর বুঝানো কষ্টকর। ধরুণ, আপনার একজন বন্ধু টেলিভিশন এবং কম্পিউটারে পার্থক্য বুঝেন। তিনি নির্ণয় করতে জানেন, কোনটা টিভি আর কোনটা কম্পিউটার। তিনি উভয়ের কাজ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। তিনি আরো জানেন, কিভাবে কম্পিউটার অন করতে হয়; কিভাবে বন্ধ করতে হয়। এতোটুকু হল আপনার বন্ধুর জানার সক্ষমতা। এটাই হল জ্ঞান। পক্ষান্তরে আপনি কম্পিউটারের প্রতিটা যন্ত্রাংশ সম্পর্কে অবগত আছেন। র্যাম, প্রসেসর, মাদারবোর্ড, পাওয়ার বক্স, হার্ডডিক্স, মনিটর ইত্যাদি সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখেন। কোন যন্ত্রাংশের কি কি কাজ সেটা সম্পর্কেও আপনার ধারণা বেশ চার্তুয্যপূর্ণ। কম্পিউটারের যেকোন সমস্যা হলে আপনি সমস্যা নির্ণয় করতে পারেন এবং সেরূপ ব্যবস্থা নিয়ে সেটা পুনরায় ঠিক করতে পারেন। এটাই হল বিশেষভাবে জানা অর্থাৎ প্রজ্ঞা। সুতরাং জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার পার্থক্য আশা করি অনেকাংশে পরিস্কার হল।
শিরোনামের মূল প্রসঙ্গে অনাসক্তিতা বলতে বুঝানো হয়েছে কোন বিষয় বা বস্তুর প্রতি আসক্তি পরায়ণ না থাকা। পৃথিবীতে জন্মের পর আমরা নানা প্রকার অবলম্বন লাভ করি। সেটা ব্যবহারের পর একটা সময় তা পরিত্যাজ্য হয়ে যায়। একটা শিশু জন্মের পর ছোট একটি গাড়ির সাহায্যে হাটতে শেখে। যখন সে ওটা ব্যবহার করতে করতে হাঁটা রপ্ত করে ফেলে তখন ঐ গাড়ীটা তার আর প্রয়োজন হয় না। সেটা তখন পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। এখন যদি ঐ শিশুটি বড় হয়ে যুবক অবস্থায় ঐ গাড়িটি নিয়ে পড়ে থাকে তবে সে নানা প্রকার দুঃখের সম্মুখীন হবে। যেমনঃ গাড়িটি তার ব্যবহার অনুপযোগী দেখে সে কষ্ট পাবে, গাড়িটি পূর্বের সৌন্দর্য্য হারিয়েছে বলে সে কষ্ট পেতে পারে, গাড়িটির ভঙ্গুরতা দেখে সে ব্যথিত হবে। ঠিক তেমনি আমরা জন্মের সাথে বস্তুগত জিনিস ছাড়াও আরো অনেক অবলম্বন লাভ করি। যেমনঃ বাবা, মা, ভাই, বোন, সন্তান, স্ত্রী ইত্যাদি। এরাও অবলম্বন হিসেবে একে অন্যের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ। সবাই যার যার মতো করে একটি জালে বন্দী। প্রত্যেকেই এই অবলম্বনের প্রতি খুবই আসক্তি পরায়ন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা এই সকল অবলম্বনে আসক্তিযুক্ত থাকি শত কষ্ট পাওয়া সর্তেও। এই অবলম্বনগুলো হতে আমাদের নিজেদের আলাদা করে চিন্তা করতে হবে। আমরা কেউ কারো নয়, এই সত্যটা মেনে নিতে হবে। জন্ম দুঃখের অবসান করতে চাইলে অবশ্যই অনাসক্তভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। ভবনদী পাড় হতে অবশ্যই অবলম্বনগুলো ব্যবহার করতে হবে, তবে অবলম্বনকে আকড়ে ধরে থাকলে নির্বাণস্তরে পৌঁছানো আদৌ সম্ভবপর হবে না। অবলম্বন এবং আকড়ে ধরার বিষয়টিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক।
ধরুন, আপনাকে একটা গভীর জঙ্গলে ফেলে আসা হল। চারিদিকে গাছপালা পাহাড় আর নদী। নদীর অপর প্রান্তে পৌঁছাতে হবে। এমতাবস্থায় আপনি আছেন গভীর জঙ্গলে। আপনি জঙ্গলে কিছুদিন কাটানোর পর ক্ষুধা অনুভব করলেন। উপায়ন্ত না দেখে গাছে থাকা ফলগুলো খেয়ে জীবনধারণ করছেন। হঠাৎ কোন বন্য পশু এলে আপনি নিজেকে রক্ষার জন্যে গাছের তৈরী লাঠি ব্যবহার করছেন। নিন্মতাপ হতে রক্ষা পেতে আগুন ব্যবহার করছেন। এসবই হল অবলম্বন। বেঁচে থাকা জন্যে এগুলোকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা। মাস খানেক গত হবার পরে আপনি বুঝতে পারলেন, এই জঙ্গলে থাকাটা বেশ কষ্টের এবং দুঃখজনক। আর এটা যখন আপনার বোধদয় হল তখনই আপনার মাঝে মুক্ত হবার ইচ্ছা উৎপন্ন হল। এই ইচ্ছাটা যত প্রবল হতে লাগলো, মুক্তির উপায় মার্গ খুঁজতে লাগলেন। পরিশেষে আপনি পৌছলেন নদীর কিনারায়। পথপ্রান্তরে নানা বাঁধা অতিক্রম করার পর নদী পাড় হওয়াটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এবার নতুন বুদ্ধি আটঁলেন। কিছু শুকনো গাছ জড়ো করে ছোট্ট একটা ভেলা বানিয়ে নিলেন। ভেলা নিয়ে নদীপথ পাড় হবার বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগুতে লাগলেন। পথিমধ্যে, প্রবল স্রোতে ভেলার গন্তব্যের বিপরীতে চলতে শুরু করলো। বৈঠাকে কাজে লাগালেন। বাতাসকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাবার জন্যে পাল উঠালেন। একটা সময় নদীর অন্যপ্রান্ত পৌছে গেলেন। চমৎকার এই পথপরিক্রমায় আপনি যেসকল অবলম্বনের সাহায্য নিয়েছিলেন সেগুলোকে স্মরণ করুন।
আপনার ক্ষুধা নিবারণে গাছের ফল খেয়েছেন। ছায়া নিয়েছেন গাছের। নিজেকে রক্ষা করতে গাছের লাঠি ব্যবহার করেছেন। তাপ নিয়ন্ত্রণে গাছের সাহায্যে আগুন জ্বালিয়েছেন। সর্বপরি নদী পাড় হতে ভেলা বানিয়েছেন গাছ দিয়ে। গাছের তৈরী বৈঠা ব্যবহার করেছেন ভেলার দিক ঠিক রাখার জন্যে। গন্তব্যে পৌছানোর জন্যে সবকিছু ছেড়ে এসেছেন ধাপে ধাপে। আপনি যদি অবলম্বনগুলোকে আকড়ে থাকতেন তবে অপরপ্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। ফলের লোভে গাছ ত্যাগ করতে না পারলে নদীর ধারে পৌছুবেন কিভাবে! ভেলার উপর আসক্তি পরায়ন হলে নদীতেই চড়তে মন চাইবে। অপরপ্রান্তে পৌছানোর কথা ভূলে যাবে। এই আসক্তিগুলোই হল জাল যেটা গন্তব্যে যাবার চিন্তাকে ভুলিয়ে রাখে। মুক্ত হবার চিন্তাকে ভুলিয়ে দেয়।
এমনি করে, আমাদের বাবা মা গাছের ন্যায় আমাদের আহার দান করে। আমাদের ছায়া দেয়। আমাদের রক্ষা করে। আমাদের যত্ন নেয়। এগিয়ে যেতে টাকা পয়সার সাহায্য করেন। সম্পদ দান করেন। এই সকল অবলম্বন আমরা প্রত্যেকেই ব্যবহার করি। কিন্তু মৃত্যুর পর কেউ তা নিয়ে যেতে পারি না। আমরা এসব অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই। আমরা কেউ সন্তান সন্ততি, বাবা, মা, অর্থ সম্পদ হারাতে চাই না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা এসব নিয়ে চিন্তিত থাকি যার ফলে আমরা যে সংসার জালে বন্দী আছি সেটা অনুভব হয় না। যতক্ষণ এই বন্দি চেতনা আমাদের মাঝে উদয় না হয় মুক্তির ইচ্ছা সেখানে সুদূর পরাহত। আপনারা যারা বয়োজৈষ্ঠ্য অবস্থায় আছেন, তাদের প্রতি আবেদন থাকবে যে আপনারা সহায় সম্পদ পুত্র কন্যাদের প্রতি অনাসক্ত হউন। একটা সময় তাদের প্রয়োজনে আপনারা ছিলেন; নিশ্চয় এখন তারা আপনাদের প্রয়োজনে থাকবে। আপনারা তাদের ব্যবহার করে ধর্মতঃ জীবনে প্রবেশ করুন। মনে রাখবেন, জায়গা জমি অর্থ সম্পদ কিছুই যাবে না সাথে। শূন্য হাতে ওপাড়ে চলে গেলে কি নিয়ে কাটাবেন পরপারে? সেই চিন্তা করুন। ভাল কর্ম করুন, সাংসারিক রাজনীতি হতে নিজেকে দূরে রাখুন। সময় খুবই সন্নিকটে কারণ মৃত্যু কখনো বয়স গুণে গুণে আসে না। যেকোন সময় যে কারো মৃত্যু হতে পারে।
মরণানুস্মৃতির উপদেশ দিয়ে উপসংহার করছি।
জমে গেছে আবর্জনা আর কিন্তু জমাইও না
ক্ষয় কর আবর্জনা, কর স্মৃতি মরণং।
আজ মরি কি মরি কাল, মরণের আছে কি কাল
তৈরী থাকো সর্বকাল, কর স্মৃতি মরণং।
লেখকঃ রাজীব বড়ুয়া, সম্পাদক-ষড়রশ্মি।