২৭তম সংঘনায়ক এস. ধর্মপাল মহাথেরোর ৭ম প্রয়াণবার্ষিকী স্মরণে:
সর্বজন নন্দিতের চলে যাওয়া : বিপন্নতার অজস্র নিপীড়ন
শ্যামল চৌধুরী ……………………….
“জীবনেরে কে রাখিতে পারে
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে
তাঁর নিমন্ত্রণ লোকে লোকে
নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে”
মানবের কল্যাণমিত্র, জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, সত্যপথের দিশারী, মহান ত্যাগী দার্শনিক, শিক্ষানুরাগী, বৌদ্ধ চিন্তাবিদ, সুবিনয়ের আদর্শে উজ্জীবিত, সুবক্তা-সুদেশক, প্রজ্ঞাবান ইত্যাদি যে বিশেষণই বিশেষায়িত করা হোক না কেন। এক কথায় সংঘনায়ক ধর্মপাল ছিলেন সর্বজননন্দিত মহান ব্যক্তিত্ব। শুধু এ উপমহাদেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বিচরণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাত বৌদ্ধ সাংঘিক মনীষা। তাঁর পাণ্ডিত্য যতটুকু না গভীর ছিল তাঁর চেয়ে গভীর ছিল তাঁর বিনয় ও প্রজ্ঞা। তাঁর প্রতিটি ধর্মদেশনায় বৌদ্ধদর্শনের পাশাপাশি দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির জন্য নৈতিক শিক্ষা দেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছেও তিনি ছিলেন নন্দিত। কারণ তিনি বৌদ্ধদর্শনকে বিভিন্ন উপমা প্রয়োগের দ্বারা সহজবোধ্য করে তাদের কাছে উপস্থাপন করতেন। আদর্শ জীবন যাপনের আহ্বান জানাতে গিয়ে পরিচয় দিয়েছেন তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের পরিধি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, প্রগতিশীল ভাবধারা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে।
এই বরণীয় ব্যক্তিত্বের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সংঘনায়ক ভান্তের সাথে আমাদের পরিবারের একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সম্পর্কে তিনি আমার দাদু ভান্তে। আত্মীয়তার সূত্রে হোক বা ধর্মীয় কার্যাদির সুবাধে হোক তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়াটা আমার সহজ ছিল। তজ্জন্য আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান ও গর্ববোধ করি।
ঊনার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গেলে অনেক কথার অবতারণা করতে হয়। আমার ছাত্রজীবন থেকে দেখেছি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেছেন কিছুটা। অনেক স্মরণিকা-সাময়িকীতে তাঁর ধর্ম-দর্শন বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণে তিনি অন্যতম সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। ২৬তম সংঘনায়ক দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথের ও সংঘনায়ক ধর্মপাল যৌথভাবে একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। “বাংলাদেশে স্থবির-মহাস্থবিরদের অবদান” নামীয় বইটি এদেশের থেরবাদী ভিক্ষুসংঘের বিকাশের ধারা সমুন্নত রাখতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। এতে যথার্থভাবে সন্নিবেশিত ছিল ভিক্ষুদের পরিচিতি ও বিভিন্ন অবদানের কথা। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রামাণিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
সংঘনায়ক ধর্মপাল ভিক্ষু মহাসভার দায়িত্বে থাকাকালীন বিভিন্ন স্মরণিকায় আশীর্বাণী স্বহস্তে লিখতেন। আমি নিজেও আমার সম্পাদিত ‘অমিতাভ’ পত্রিকায় এবং বেশ কয়েকবার কাতালগঞ্জ নব পণ্ডিত বিহারের স্মরণিকায় আশীর্বাণী চেয়ে আবেদন করি। প্রতিবারই আমি দেখেছি ঊনি নিজে হাতে লিখে বাণী দিতেন। একটা বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি- উনি কোন কাটাছেঁড়া ছাড়াই একবারই লিখতেন। বয়সের ভাড়ে নূয়ে পড়া তাঁর কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা হলেও বুঝে নিতে কোন কষ্ট হতো না। তবে তাঁর মধ্যে লেখালেখির একটা বিপুল সম্ভাবনা ছিল। তাঁর কিছু কিছু লেখা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ হলেও তা খুবই নগণ্য। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার লেখা চেয়ে আদায় করতে পারিনি। যে কয়টি আমার চোখে পড়েছিল তা নিতান্তই দায়সারা গোছের লেখা নয়। হয়তো বা তিনি হালকা মেজাজের ফরমায়েশী লেখার অভ্যাস করেননি বলে সাহিত্যচর্চায় খুব বেশি এগুতো পারেননি। তবে যেটুকু লেখালেখি তিনি করেছেন তা সংগ্রহ বা সংরক্ষণে তাঁর উদাসীনতা ছিল। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়- সংঘনায়কের পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে নানা সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান-আচরণাদিতে তাঁর সময় দেওয়াটা আরেক দায়বোধ হয়ে দাঁড়ায়। নানা ব্যস্ততায় দম ফেলার ফুরসত যেন তাঁর ছিল না। এক সময় তাঁকে আমি বললাম- ভান্তে দাদু, আপনি সংঘনায়ক না হলেই ভালো হতো। কেন যে আপনি সংঘনায়ক হলেন..?
আপনি শুধু সংঘদানের ফাং খেয়ে খেয়ে সময়ক্ষেপন করছেন। কাজের কাজ কিছুই করছেন না। উত্তরে তিনি বলতেন, ‘কী করবো বলো, সবার ডাকে সাড়া দিতে হয়, না গিয়ে তো আর পারি না।’ এতো কথা বললেও ঊনি কোন সময় রাগান্বিত হতেন না, বা উচ্চস্বরে কিছু বলতেন না, সবসময় মিষ্টভাষায় ঠান্ডা মেজাজে কথা বলতেন।
সংঘনায়ক ধর্মপাল ভান্তের আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল- তিনি শুদ্ধ পালি ভাষায় সুকণ্ঠে সুত্রপাঠ করতেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠের সুত্রপাঠের জন্য আমার আমন্ত্রণেও তিনি একাধিকবার সাড়া দিয়েছেন। ২০০০ সালে আমার প্রথম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরুর সময় ঊনি সুত্রপাঠ করেছেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে নতুন স্থানে প্রতিষ্ঠান শুরুর সময় আবারো তাঁকে আমি ফাং করি সুত্রপাঠের জন্য। একটা ব্যাপার আমি উপলব্ধি করলাম, কোন সময় তিনি দ্বিমত বা আপত্তি করেননি। শুধু নাতি হিসেবে ঠাট্টার ছলে বলতেন, বেশি বেশি দান-দক্ষিণা দিলে যাবো আর কি..! বলাবাহুল্য একজন সংঘনায়ক ভান্তেকে দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সুত্রপাঠের আয়োজন সত্যিই দুর্লভ। এজন্য আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করি।
ভান্তেকে নিয়ে একটা বিশেষ পরিকল্পনা আমার মাথায় চেপেছিল। তাঁকে আমি জানিয়েও ছিলাম। একবাক্যে তিনি রাজী হয়েছেন। তবে ঐ যে সংঘনায়ক, বিভিন্ন জায়গায় সংঘদানাদি, এটা-ওটা..? সময় তো আর হয় না। এই করবো করবো বলে আর করা হলো না। যেটা করা সম্ভব হলে অন্ততঃ একটা দালিলিক সম্পদ হতো। তাঁর সুললিত কণ্ঠের সুত্রের অডিও (সম্ভব হলে ভিডিওসহ) সিডি করার প্রস্তাব আমি তাঁকে দিয়েছিলাম। বললাম ভান্তে, আমাকে এই কাজটা করার সুযোগ দিবেন। আগ্রহের ঘাটতি ছিল না মোটেও তবে সময় তাঁকে তাড়া করতো। বুঝতে পেরে আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব শ্রদ্ধেয় বোধিমিত্র মহাথেরর সাথে বিষয়টি শেয়ার করলাম- বললাম কাউকে বলার দরকার নাই। আপনি শুধু ভান্তেকে নিয়ে সময়টা করে নেন। তিনি আমাকে অভয় দিলেন আমিও সেটা করার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এভাবে বছরখানেকের মধ্যেও যখন এর কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না এক সময় সংঘনায়ক ভান্তেকে আমি বললাম- দাদু আপনি সময় কিভাবে পাবেন? আপনার তো নানা জায়গায় ফাং থাকে। একটা কাজ করেন, আমার বাসায় একদিন আপনাকে ফাং করবো এবং ঐদিনই স্টুডিওতে আপনার সুত্রপাঠের অডিও রেকর্ড হবে। কিন্তু চরম আক্ষেপ, আমার সেই আকাঙ্খা আর পূরণ হলো না। ফাং করাও হলো না, অডিও রেকর্ডও করা হলো না।
একজন ব্যক্তির মুখাবয়বেই বুঝা যায়, তার মধ্যে কতটুকু প্রজ্ঞাবান, কতটুকু বিনয়ী বা কতটুকু বাৎসল্য বিদ্যমান। সংঘনায়ক ধর্মপালের মুখাবয়ব দেখলেই তা অনুমান করতে যে কারো মনে শুভ্র উপলব্ধি হতো। তিনি তো অনেক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি ছিলেন; কোন নির্দিষ্ট ছকে তাঁকে অনুমান করা দুঃসাধ্য। এ মহান সাংঘিক ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়ার শূন্যতা কোনকালেই পূরণ হবার নয়’ এ যেন মহাজগতে বিপন্নতার অজস্র নিপীড়ন। আমরা যদি সংঘনায়ক ধর্মপালের আদর্শ ও জীবনের অর্জনকে অনুসরণ করতে পারি তবেই তাঁর জীবন, কর্ম ও বাণী অনন্য প্রেরণায় অভিষিক্ত হবে।