1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
  3. wp-configuser@config.com : James Rollner : James Rollner
সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০২ অপরাহ্ন

মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে

প্রতিবেদক
  • সময় রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮
  • ১৮২৬ পঠিত

মহামানব বুদ্ধ

মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: 

তৎকালীন ভারতীয় সমাজের চারপাশ হিংসা, বিদ্বেষ, কুসংস্কার, ক‚পমন্ডূকতা, জাগতিক নানা বৈষম্য, নানা প্রতিক‚লতায় ক্লেদাক্ত পঙ্কিলে নিমজ্জিত ছিল। তামসিক উল্লাসে মানবিক মূল্যবোধ ধুলায় লুণ্ঠিত। মানুষের স্খলন-পতন-বিভেদ-বিপর্যয়-বীভৎস কার্যকলাপ প্রচন্ডভাবে শুভচেতনাকে ব্যাহত করেছিল। প্রাক ও প্রাথমিক বৈদিক জনগোষ্ঠীর একমাত্র ‘ধর্মীয়’ আচার ছিলো যজ্ঞ অনুষ্ঠান। সেই বিপন্ন সময়ে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের জন্ম এক দেদীপ্যমান বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে। বুদ্ধ জীবনের ত্রয়ী ঘটনার সমারোহে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি সমগ্র বিশ্বে স্মরণীয়। রাজপুত্র সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিজ্ঞান লাভ, মহাপরিনির্বাণ সংঘটিত হয়েছিল এ বৈশাখী পূর্ণিমাতেই। বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও সিদ্ধার্থ গৌতম রাজপ্রাসাদের বিত্ত-বৈভব, সুখ এবং স্বজনের মায়া ত্যাগ করে দীর্ঘকালীন জড়ত্বকে ভেঙে চুরমার করে আত্মপ্রকাশের উন্মুক্ত আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল এ ধরণী ।
২৯ বছর বয়সে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের মার্গে বিচরণের সংকল্পে সিদ্ধার্থ গৌতম আষাঢ়ী পূর্ণিমায় গৃহত্যাগ করেন। সিদ্ধার্থ গৌতম গেরুয়া বসনে দুঃখ মুক্তির অন্বেষণে প্রাচীন ঋষি, মনীষীর সান্নিধ্যে যান। কিন্তু কেউ সংসার চক্রের আবহমান জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণায়মান চক্রব্যূহের আদি-অন্তের সন্ধান ও মুক্তির পথের দিক নির্দেশনা তাঁকে দিতে পারেনি। তাঁদের কাছে ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় জানতে পারলেন বটে, সর্বজ্ঞান লাভের উপায় কারো জানা ছিল না। তিনি গহীন বনের অভ্যন্তরে ছয় বছর কঠোর সাধনা করেন। অবশেষে নিরঞ্জনা নদী তীরবর্তী অশ্বত্থ তরুতলে ৩৫ বছর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমার জোছনাতে রাতে আত্মউপলব্ধির সর্বোচ্চপর্যায়ে জগত আলোকিত করে মানবমুক্তির পথ আবিষ্কার করেন মহামতি গৌতম। লাভ করলেন বুদ্ধত্ব। অবগত হন জন্ম-মৃত্যুর তত্ত¡, দুঃখরাশির উদয়-বিলয়। অবিদ্যা বা অজ্ঞান ও তৃষ্ণাকে মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করে তার থেকে পরিত্রাণের জন্যে তিনি উদ্ভাবন করেন আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। হৃদয়ের গভীর গহন তলদেশ থেকে উঠে এসেছে ঢেউ জাগানিয়া এক অকৃত্রিম আবেশ- একটি স্নিগ্ধ আলোর উষ্ণতা এবং তাঁর উৎসারিত চেতনা- দুঃখ মুক্তির মহাসত্যের সন্ধান। বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোই ছিল তার অভিলাষ। জীবের কল্যাণে স্বোপার্জিত সম্বোধীর স্ফ‚রিত বাণী ছড়িয়েছেন বিশ্বময়। কপিলাবস্তু থেকে শ্রাবস্তী, বৈশালী, চুনার, কৌশাম্বী, কনৌজ, মথুরা, বর্তমান নেপাল, ভারত, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি বহু জায়গায় তিনি ৪৫ বছর ধর্মপ্রচার করেন। বুদ্ধের কল্যাণের অমিয়বাণীর বহমান স্রোতধারায় মানুষ দুঃখ মুক্তির পথের দিশা খুঁজে পায়। তাঁর বাণী মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল পরিশুদ্ধ এবং শান্তিময় জীবন প্রতিষ্ঠায়। তাঁর মৈত্রী, করুণা আর অহিংসা মন্ত্রের প্রতীতিতে মানুষের চেতনার সম্প্রসারণ ঘটে। পশুত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ, মনন ও প্রজ্ঞায় উত্তরণ ঘটে। উদ্বেলিত ভাবনার সমৃদ্ধিতে, চিন্তার ঐশ্বর্যে, উদ্দীপনায় মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাসের জাগরণ ঘটে।
জীবনের শেষ বেলায় বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে কুশীনগর গমন করেন। কুশীনগরের কাছে পাবা নগরে উপস্থিত হয়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মল্লদের শালবনে শালগাছের নিচে শয়ন করেন। তখন আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। অনন্ত আকাশের তলে যুগ্ম শালবৃক্ষের নিচে সমবেত শিষ্যগণ। তিনি উচ্চারণ করেন মহাবাণী, উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য স¤পাদন কর। বৈশাখী পূর্ণিমাতেই ৮০ বছর বয়সে বুদ্ধ লাভ করেন মহাপরিনির্বাণ।
সম্বোধীর জ্যোতির্ময় আলোয় বুদ্ধের দুঃখ মুক্তির মহাসত্যের পথ আবিষ্কার এবং বুদ্ধের দর্শন বৈপ্লবিক। তাঁর দেশিত মূলনীতিগুলোতেই আমরা বাস্তবভিত্তিক দর্শনের নির্যাস খুঁজে পাই। তাঁর দর্শন আমাদের চিন্তাজগত নাড়া দেয় এবং সমৃদ্ধ করে। বুদ্ধের আবিষ্কৃত মহাসত্য- দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের পথও আছে এটা বিশ্বজনীন এবং ধ্রæব সত্য। বুদ্ধের দর্শনের মূল সূর হচ্ছে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্না। নিত্য বলে কিছুই নেই। উপনিষদীয় ঋষির আত্মাকে নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, অজর, অমর ও অক্ষয়- এই বিশ্বাস বুদ্ধের কাছে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। বুদ্ধের মতে পৃথিবীর সবকিছুই অনিত্য, অনাত্না, অধ্রুব। তাই জীবন দুঃখময়। বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি যেখানে বলে, সবকিছুই ক্ষণিক, অনিত্য, সেখানে অজর, অমর, নিত্য ঈশ্বরের স্থান থাকতে পারে না। বুদ্ধের মতে, পরমাত্মা, ব্রহ্মা বা ঈশ্বর নামক কাল্পনিক সত্তা মানুষকে শান্তি দেবেন, এটা ভাবা একান্তই অজ্ঞতা। অবিচল আত্ম -প্রত্যয়, অসাধারণ প্রজ্ঞায় বুদ্ধ নিজেকে মধ্যমপন্থায় স্থির রেখেছিলেন। তিনি গতিশীল জীবন গড়ে তোলার জন্য গতিশীল দর্শনের সৃষ্টি করেছিলেন। কোন ভ্রান্ত মতবাদের অনড় গোঁড়ামির দ্বারা যেন মানব মননে কোন সংশয় না জাগে তারজন্য তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে উদাত্ত কণ্ঠে আহŸান জানিয়েছেন। বৌদ্ধ দর্শনের মৌলিক বিষয় ‘চতুরার্য সত্যে’ বিধৃত হয়েছে। একটি চাকার চারপাশের ব্যাসার্ধ থেকে তার বাহুগুলি চাকার কেন্দ্রে কেন্দ্রীভ‚ত হয়, তেমন বৌদ্ধদর্শনের সকল বিষয়ের মূল বক্তব্য ‘চতুরার্য সত্যে’ কেন্দ্রীভ‚ত। চতুরার্য সত্য শব্দটির ‘চতু’ আর্যসত্যের চার ‘আর্য’ পরিশীলিত জ্ঞান, আর ‘সত্য’ অর্থ জীবনমুখী বাস্তবতা। যিনি ‘চতুরার্য সত্য’ হৃদয়ঙ্গম করেছেন, তিনি জীবনে জ্ঞানের মহিমায় ঋদ্ধ হয়েছেন। চারি আর্য সত্যের জ্ঞানকে যদি ধারণ করা না যায় তাহলে জন্ম মৃত্যুর, চক্রাবর্তনে পুনঃপুনঃ ঘূর্ণিত হবে। এ মহাজ্ঞানীর জীবন দর্শনে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার আলোয় অহিংসা, সাম্য ও বিশ্বমানবতার অপরিমেয় মৈত্রীর হিরন্ময় প্রকাশ, যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত সত্য আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রের মাধ্যমে গৌতমবুদ্ধ বুদ্ধদর্শনের আলোকপ্রাপ্তির উদ্ভোধন করলেন সারনাথে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের কাছে। বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় জাগতিক সমস্ত দুঃখ মুক্তির লক্ষ্যে প্রথাগত চেতনার বিরুদ্ধে অনন্য বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাই এ দর্শনকে দুঃখ মুক্তির দর্শন বলা হয়। কারণ নিরলস গতিশীল সাধনার মাধ্যমে পার্থিব দুঃখ হতে মুক্তির উপায় অনুসন্ধানই হচ্ছে এই দর্শনের মূল সুর। বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো প্রাণীকুলকে কীভাবে দুঃখের হাত থেকে বাঁচানো যায়। গৌতম বুদ্ধ দুঃখের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাননি, তিনি দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেন। দুঃখের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৌতম বুদ্ধ কারো কাছে সাহায্য না চেয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, এ জগৎ দুঃখের সরোবর। দুঃখই আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় সুখ অকল্পনীয় ও অসম্ভব বস্তু। যতই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, ততই আমাদের দুঃখ বাড়ে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ দুঃখের কথা বললেও দুঃখ মুক্তির আর্য সত্যের মাধ্যমে বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধবর্ণিত দর্শনের নীতিবাক্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। বুদ্ধের দার্শনিক আবিষ্কারকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছেন। তাই তাঁর অন্তরের মধ্যে বসবাসরত সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধদেবকে, যিনি নিজের মধ্যে মানুষকেই প্রকাশ করেছিলেন। নিজের মধ্যে প্রকৃত মানুষের প্রকৃতিকেই প্রকাশ করেছেন।
মানুষ মোহান্ধকারে আবিষ্ট। তাকে জ্যোতিতে প্রকাশ করো। মানুষ মৃত্যুর দ্বারা আবিষ্ট, তাহাকে অমৃতে প্রকাশ করো। এটাই বুদ্ধের পরম প্রার্থিত চাওয়া। সাম্প্রতিক সময়ে হিংসা, হানাহানি,অমানবিকতার যে দাপট পৃথিবীজুড়ে তা প্রতিনিয়তই পদদলিত করছে অহিংসার যত শুভ্র কমল। হীনস্বার্থবাদীর লোলুপতা, নিষ্ঠুরতা-বর্বরতা-পৈশাচিকতার মর্মন্তুদ ঘটনা বিশ্বকে প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করে চলেছে। বিশ্বের চলমান দুর্যোগ, বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবতার মর্মন্তুদ চিত্র মানবিকতার সকল সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং বিপর্যয়কর অমানবিক পরিস্থিতির উদ্ভব করেছে। বুদ্ধের দার্শনিক দৃষ্টিতে জগতে শত্রæতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রæতার উপশম হয়। বুদ্ধের মানস যেভাবে জগতের মঙ্গলসাধন করতে চেয়েছিলো, সকল প্রাণীর কল্যাণ চেয়েছিলো তা আড়াই হাজার বছর পূর্বের মতো আজো প্রাসঙ্গিক। অহিংস চেতনার বুদ্ধের এ বাণী, চিরকালীন শুভ্র মানস-ভাবনা হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ুক সর্বজীবের কল্যাণে। মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মানবিক পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে বুদ্ধের মৈত্রী, কল্যাণ এর প্রকৃত চর্চায় আবার জেগে উঠবে মানবকুল অহিংসার মন্ত্রে এবং উজ্জীবিত হবে প্রজ্ঞার মঙ্গলালোকে এ প্রত্যাশা। গৌতম বুদ্ধ নিজের জীবন গড়ে তুলেছিলেন কঠোর তপস্যায়, কৃচ্ছ্রসাধন এবং মধ্যমপন্থায় এক মহৎ জীবনবীক্ষণের আত্মশক্তিতে। তাঁর কর্মযজ্ঞ সবাইকে শুদ্ধ চেতনায় জাগ্রত করবে অনাদিকাল। মৈত্রীর মেলবন্ধনে হিংসা নয় প্রেম, যুদ্ধ নয় শান্তির মঙ্গলধ্বনি অনুরণিত হবে পৃথিবীময় । বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীপূর্ণ অভিবাদন সবাইকে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক : রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত), ইউএসটিসি।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!