1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন

গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মমত

প্রতিবেদক
  • সময় বুধবার, ২ মে, ২০১৮
  • ১৭৪১ পঠিত

নূহ-উল-আলম লেনিন: 

প্রাচীন ভারতে অসংখ্য ধর্ম ও শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হলেও কোনো ইতিহাস- গ্রন্থ রচিত হয়নি। পৌরাণিক কাহিনিতে সমকালীন সমাজ- ইতিহাসের উপাদান ইতিহাসনির্মাণ সহায়ক হলেও, সঙ্গত কারণেই তা ইতিহাস নয়। ফলে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তির জীবন ও কর্মকাণ্ডের স্থান-কাল নির্ধারণ নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এসব মতান্তরের কথা মনে রেখেও বলা যায়, গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ।
গৌতমের জন্ম কপিলাবস্তু রাজ্যের ক্ষত্রিয় রাজা শাক্ষ্য বংশে । ক্ষত্রিয় ওককের পুত্র অঞ্জন খ্রিস্টজন্মের ৬৯১ বছর আগে ‘অঞ্জনাব্দ’ ‘কোলি’ জনপদের রাজা নামে সাল গণনার প্রচলন করেন। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্বোধনের ওরসে মায়াদেবীর (অঞ্জনের কন্যা) গর্ভে ৬৮ অঞ্জনাব্দের বৈশাখী পূর্ণিমায়-মঙ্গলবাসরে ভগবান শাক্য সিংহ জন্ম গ্রহণ করেন।
প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ পূর্ণচন্দ্র মুখোপারদ্ধায়… শাক্য সিংহের আবির্ভাবকাল ৬৮ অঞ্জনাব্দ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দকে যথার্থ বলে মনে করেন। তবে এনসাইক্লপিডিয়া ব্রিটানিকায় বুদ্ধের জন্মসাল ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গৌতম বুদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। মহাবীরের জন্ম ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই হিসেবে মহাবীরের চেয়ে গৌতম বুদ্ধ ছত্রিশ বছরের কনিষ্ঠ। তবে উভয়েই বেশ কয়েক বছরের জন্য একই সময়ে জীবিত ছিলেন।
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর অবস্থান নিয়ে মতান্তর রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের উত্তর প্রদেশ ও নেপাল সীমান্তবর্তী তরাই অঞ্চলে এই কপিলাবস্তু জনপদ ও তাঁর রাজধানী অবস্থিত ছিল। শাক্য রাজপুত্র গৌতম বা শাক্য সিংহের জন্ম হয়েছে পথিমধ্যে, লুম্বিনী নামক বনে। সন্তানসম্ভবা মায়াদেবী শাক্য রাজগৃহ থেকে পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে শালবনে (মতান্তরে অশোকবনে) শাক্য সিংহ ভূমিষ্ঠ হন।
বুদ্ধের এই জন্মস্থানটিতে একটি অশোক স্তম্ভ আবিষ্কৃত হওয়ায় ‘লুম্বিনী’ গৌতমের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে।
বংশগত নাম শাক্য সিংহের গৌতম নামের পাশাপাশি আরেকটি মিথোলজিকাল নাম হচ্ছে সিদ্ধার্থ। শাক্য সিংহ শৈশবেই মাকে হারান, বিমাতা গৌতমের কাছে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। গৌতমির নামানুসারেই শাক্য সিংহ নামের সাথে ‘গৌতম’ যুক্ত হয় বলে কথিত আছে। পক্ষান্তরে শাক্য সিংহের জন্মের পর কপিলাবস্তু রাজ্যের প্রজাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় রাজা শুদ্বোধন নবজাত পুত্রের নাম রাখেন সিদ্ধার্থ।
সিদ্ধার্থ নামের অর্থ সিদ্ধিলাভ বা সব কাজে সফলকাম হওয়া। বৌদ্ধ সাহিত্যে তাকে ‘শাক্যমুনিও’ বলা হয়েছে। শাক্যমুনি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘শাক্যকূলের প্রাজ্ঞ’ । তবে বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব পর্যন্ত বুদ্ধ ‘সিদ্ধার্থ’ গৌতম নামেই পরিচিত ছিলেন।
জাগতিক ব্যাপারে উদাসীন রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে রাজা শুদ্বোধন মাত্র ষোল বছর বয়সে (মতান্তরে ১৯ বছর) ৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিয়ে দেন। সুন্দরী গোপা-র গর্ভে সিদ্ধার্থ এক পুত্র রাহুল জন্মগ্রহণ করে ৫৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। স্ত্রী-সন্তান ও রাজকীয় বিলাসী জীবন সিদ্ধার্থকে ঘরে ধরে রাখতে পারল না । ৫৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি গৃহত্যাগ করেন।
প্রাচীন ভারতীয় ঋষি অথবা বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মগুরুর মতোই কোন অরণ্য, পাহাড়, অথবা লোকালয় থেকে দূরবর্তী কোন নির্জনস্থানে ধ্যানমগ্ন হয়ে সত্যানুসন্ধানে ব্রতী হন সিদ্ধার্থ।
তিনি জাগতিক সকল আরাম আয়েশ সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। প্রথমে একাধিক ধর্মগুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তাদের কাছে শাস্ত্রপাঠ ও দুঃখ নিরাকরণের পথানুসন্ধানে কঠোর সাধনায় ব্রতী হন। এভাবে কাঙ্ক্ষিত সত্যের সন্ধান না পাওয়ায় প্রাচীন ঋষিদের মতো নিভৃত বনের ছায়ায় অথবা পর্বতের পাদদেশে কঠোরতম কৃচ্ছ্রসাধনায় মগ্ন হন।
রাহুল সাংকৃতায়ন বলেছেন, গিরিরাজ হিমালয়ের পাদদেশে যেমন তার আবির্ভাব হয়েছিল, তেমনি তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন গয়া, রাজগৃহ , ইসিপতম মৃগদার, মৃৎকুল–পর্বত (বিহার), পরিলেয় বন (মিজাপুর), সুংসুমার গিরি (চুনার) , চালিয় পর্বত (বিহার), শ্রাবন্তির জেতবন প্রভৃতি স্থানসমূহে।
বর্তমান বিহার রাজ্যের গয়া শহর থেকে ৭ মাইল দূরবর্তী প্রাচীন মগধ রাজ্যের উরুবিশ্ব নামক স্থানের নিরঞ্জনা নদীতীরের একটি বিশাল অশথ গাছের নীচে তিনি কঠোর সাধনায় ব্রতী হন। ছয় বছর নিরবচ্ছিন্ন তপশ্চর্যার পর সিদ্ধার্থ তার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এক পূর্ণিমা তিথিতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ‘সম্বোধি’ লাভ তথা বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। এই স্থানটি পরবর্তীকালে বুদ্ধ গয়া ও অশথ গাছটি বোধিদ্রুম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।
বুদ্ধ অর্থ অবগত, জ্ঞাত, বিদিত, অথবা প্রাজ্ঞ, জ্ঞানী, জ্ঞানপ্রাপ্ত, জাগরিত কঠোর সাধনা ও কৃচ্ছ্রতার ভেতর দিয়ে যিনি জীব জগতের দুঃখ- কষ্ট, লোভ- লালসা- মোহ এসব থেকে পরিত্রাণের তথা নির্বাণ লাভের পথ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন তিনিই বুদ্ধ। বোধি অর্থ ‘জ্ঞান’ আর বুদ্ধ অর্থ ‘জ্ঞানী’। যার মধ্যে বোধি বা জ্ঞানের পরিপূর্ণতা রয়েছে তাকে বুদ্ধ বলা হয়।
গৌতম সিদ্ধার্থ বা শাক্য বংশ ‘বন্ধুত্ব’ অর্জনের ভিতর দিয়ে ‘গৌতম বুদ্ধ’ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন ।ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সূচিত ধর্মন্দোলন ‘বৌদ্ধধর্ম’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
‘বৌদ্ধ’ শব্দটির অর্থ (স. বুদ্ধ+ অ অণ) অর্থ বুদ্ধদেবের মতাবলম্বী, বুদ্ধদেব সম্পর্কিত, বুদ্ধদেব কতৃক প্রবর্তিত বা প্রচারিত।অর্থাৎ এশিয়ার আলোকবর্তিকা। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত বাণী ও জীবনাদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে এ ধর্মমত।আগেই উল্লেখ করেছি, বৈদিক ব্রাহ্মণধর্ম একদিকে বিদ্যমান চাতুবর্ণ ` প্রথার কঠোরতা এবং ভারতীয় বৈশিষ্ট্যর দাসশ্রম উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল: অন্যদিকে যাগযজ্ঞ,পশুবলি,নানা ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব অচলায়তনে পরিণত হয়েছিল।
ধর্মের নামে যুদ্ধ, কলহ-বিবাদ, এবং অর্ন্তমুখীনতা ভারতীয় সমাজের চলচ্ছক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের বিকাশকালে ভারতীয় সমাজ উচ্চ-নীচ, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত হিসেবে পরিপূর্ণ রূপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজে শূদ্র,দাস এবং এমনকি অস্পৃশ্য একদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নীচ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এরা সমাজের উৎপীরিত মানুষ।তার পরবর্তীকালে অত্যাচারিত ও শোষিত মানুষের হতাশা এবং উৎপীড়নের ফলে অসহায়তার এক বিশেষ মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। জীবনের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তি এবং পরবর্তী জীবনে সুখের স্বাদ এবং এমনকি জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে মুক্তি বা পরিপূর্ণ আনন্দের আশ্বাস সৃষ্টি করেছিল এই ধর্মমত।
গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর, উভয়েই বিদ্যমান এই ধর্মমতকে, তার সর্বগ্রাসী বিশ্বাস, রীতিপ্রথাকে আঘাত করে। গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর উভয়েই ছিলেন অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী এবং নিরীশ্বরবাদী । `মহাবীর নিজেকে যেমন নতুন কোনো ধর্মের প্রবক্তা বলে ঘোষণা করেন নি, বরং বলেছেন যে, তিনি তার পূর্বতন ২৩ জন তীর্থংকরের মতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছেন মাত্র সেই রকম গৌতম বুদ্ধ ও নিজেকে কোনো নতুন ধর্মমতের প্রবক্তা বলে ঘোষণা করেন নি, বরং বলেছেন যে তার পূর্বে বহু বুদ্ধ এসেছেন এবং পরেও আসবেন। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী এ বিষয়ে আরেকটু এগিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মতামত দিয়েছেন।
তার মতে ` বুদ্ধ কখনো নতুন ধর্মমত প্রবর্তবনের দাবি করেন নি। বরং বুদ্ধ সমাজের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে অনুধাবন করেছিলেন এবং তিনি সমাজের দুঃখ দূর্দশার কারণ বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং এর থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেছিলেন কেশাম্বী যুদ্ধের এ ভয়াবহতাকে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও এ দুটি ধর্ম আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত দুটি পৃথক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠত হয়। নানা ঐতিহাসিক কারণে জৈনধর্ম ব্যাপক জনগণের মধ্যে স্থায়ী হতে পারেনি। বৌদ্ধধর্ম একসময় সর্বভারতীয় রূপ নেয় এবং ভারতের সীমানা পেরিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্র : লেখাটি নূহ-উল-আলম লেনিনের লেখা বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ বই থেকে নেওয়া।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!