ড. সুকোমল বড়ুয়া:
আজ শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা। ২৫৬২ বুদ্ধাব্দ শুরু হল। দিনটি মানব ইতিহাসে এক পরম পবিত্রতম তিথি। এ দিনেই মহামানব গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয় (খ্রি.পূ. ৬২৪ অব্দে) কপিলাবস্তুর নিকটবর্তী লুম্বিনী উদ্যানে।
দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন (খ্রি.পূ. ৫৮৯ অব্দে) প্রকৃতির সৌন্দর্যঘেরা গয়ার বোধিবৃক্ষ মূলে। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধর্ম প্রচারের পর ৮০ বছর বয়সে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন (খ্রি.পূ. ৫৪৪ অব্দে) কুশিনগরের মল্ল রাজাদের শালবনে।
বুদ্ধ জীবনের মহান এ তিনটি প্রধান ঘটনাকেই মানববিশ্বের ইতিহাসে ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ নামে অভিহিত করা হয়। এদিন সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধরা এবং মানবতাবাদী দার্শনিক চিন্তাবিদরা বুদ্ধের জীবনদর্শনকে গভীরভাবে অনুধাবন করেন।
বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রমণ ও গৃহীরা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাচর্চা করেন। বিশ্বের সব বৌদ্ধ এ দিনটি অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নানা কর্মসূচিতে উদযাপন করেন। আজ এ শুভ তিথিতে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শান্তিকামী ও মানবতাবাদী মানবগোষ্ঠীকে জানাই বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
মহামানব বুদ্ধ ছিলেন অহিংস, ন্যায় ও সাম্যনীতির এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তার প্রতিটি বাণী ছিল অহিংস ও সাম্যনীতির পক্ষে। তার অনুশাসনও ছিল আত্মজয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাই তার ধর্মে কোনো অলৌকিকত্ব নেই, নেই কোনো ঈশ্বরস্তুতি কিংবা ভক্তিবাদ।
আছে শুধু বুদ্ধি ও বিবেকশানিত যুক্তি ও আত্মজিজ্ঞাসা। আছে নিজকে দেখার, জানার ও বিচার করার পরম শিক্ষা। এটাই বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন। বৌদ্ধধর্মে কোনো ধরনের জাতি-বর্ণভেদ নেই, নেই কোনো ধরনের শ্রেণীবৈষম্যও। মানুষ হিসেবে তিনি সবাইকে দেখেছেন একই দৃষ্টিতে, সমজ্ঞানে। তাই বুদ্ধবাণীতে বারবার ধ্বনিত হয়েছে অহিংস, শান্তি ও বিশ্বপ্রেমের কথা। উচ্চারিত হয়েছে মহাসাম্য ও মহামৈত্রীর কথা।
আমরা জানি, শান্তি ও সুখ সব মানুষের কাম্য। এমনকি প্রাণিজগৎও সুখ-শান্তি ও নিরাপদে থাকতে চায়। কিন্তু আজকের সমাজ ও বিশ্বে যা চলছে, তা কখনও শান্তির বারতা হতে পারে না। আজকের দিনে কোথাও শান্তি ও সাম্যের পদধ্বনি শোনা যায় না। মহামানব বুদ্ধের সমগ্র জীবনের সাধনা ছিল মানুষের কল্যাণ করা।
তাই তিনি ধর্ম প্রচারের প্রথমেই তার শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের মঙ্গলের জন্য তোমরা নানাদিকে বিচরণ করবে।’ বলেছেন এমন ধর্ম প্রচার করতে, যা আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তেও কল্যাণ হয়। কী অসাধারণ বাণী বুদ্ধের!
আজ সর্বত্র মিথ্যা, প্রতিহিংসা, রাগ, দ্বেষ ও জিঘাংসার ছড়াছড়ি। এগুলো মানবিক আচরণ হতে পারে না। কোনো ধর্ম এগুলো শেখায়নি। এসব আচরণ মানুষের চিত্তকে কলুষিত করে। দেহ ও মনকে পীড়িত করে।
দেহে যেমন সুষম আহারের প্রয়োজন হয়, তেমনি চিত্তেরও। চিত্তের এ সুষম আহার হল সৎ চিন্তা করা এবং নির্লোভ, নির্মোহ ও বিদ্বেষহীন অবস্থায় চিত্তকে নিরাপদে রাখা। দেহ বা শরীরকে ধৌত করা যায়, কাপড়চোপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা যায়; কিন্তু চিত্তকে ধৌত করা যায় না, পরিষ্কারও করা যায় না।
বৌদ্ধ মতে, একমাত্র শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাগুণ দিয়েই চিত্তকে ধৌত করতে হয়। বুদ্ধ বলেছেন, ব্যক্তি সর্বদা তার চিন্তা, চেতনা ও মননে এবং সৎ চিন্তা ও কুশল ভাবনা দিয়ে চিত্তকে সজীব রাখবে। তাহলেই চিত্ত সুস্থ, সবল ও নিরাপদ থাকে। বৌদ্ধ মতে, নিজের চিত্তকে নিজকেই শাসন করতে হয়।
ব্যক্তি তার নিজের চিত্তকে শাসন করতে না পারলে পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যে তার চিত্তকে শাসন করবে। এজন্য বৌদ্ধধর্মে আত্মশাসনের কথা বলা হয়েছে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে।
আত্মশাসনই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন, আত্মজয়ই বড় বিজয়। তাই ধর্মপদে বলা হয়েছে, ‘যিনি হাজার হাজার সৈন্যকে যুদ্ধশিবিরে পরাজিত করে তিনি বিজয়ী নন; যিনি আত্মজয়ী এবং যিনি নিজের ইন্দ্রিয় ও রিপুকে জয় করতে পেরেছেন তিনিই প্রকৃত বিজয়ী।’ বর্তমান বিশ্বে মানবতার জন্য বুদ্ধের এ উক্তি অসাধারণ।
বুদ্ধ আরও বলেছেন, ‘শান্তি-সুখ বাইরে খুঁজে লাভ নেই, খুঁজতে হবে নিজের মধ্যেই, অনুসন্ধান করতে হবে নিজের ভেতরেই।’ এমনকি বুদ্ধ এও বলেছেন, বুদ্ধকে পূজা করে লাভ নেই, নিজের আত্মশুদ্ধিতে নিজকেই পূজা করো।
যদি নিজকে কেউ পরিশুদ্ধ করতে না পারে, তাহলে জীবন বৃথা, জীবনের সব সাধনাই বৃথা। অপরের দোষত্রুটি দেখে কিংবা অনুসন্ধান করে লাভ নেই। নিজের দোষত্রুটি দেখাই উত্তম। ধর্মপদে বুদ্ধ বলেছেন, ‘যিনি ন্যায়, ধর্ম ও সাম্যের সঙ্গে সবাইকে পরিচালিত করেন তিনিই ধর্মের অভিভাবক, তিনিই পণ্ডিত এবং তিনিই সুবিচারক।’ এজন্যই বৌদ্ধধর্মে মানবিক মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ এবং মানুষের চরিত্র কিংবা মানুষের আচরিত ধর্মকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা হয়েছে।
বৌদ্ধ মতে, ‘ধর্ম’ হল সুনীতি, সুআদর্শ এবং মানবিক মূল্যবোধের জীবনাচরণ। ধর্ম হল বিশুদ্ধ এক জীবন পদ্ধতি, যেখানে মানবিক গুণগুলো বিকশিত হয়। মানুষ যদি জীবনাচরণে, কর্মে ও চিন্তায় এবং জ্ঞান ও মননশীলতায় বড় না হয়, তাহলে সে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। এজন্যই বৌদ্ধধর্মে শীলাচার জীবন ও সুনৈতিকতার কথা বারবার বলা হয়েছে। ব্যক্তি তার শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ভাবনার মাধ্যমেই একটি উন্নত ও উৎকৃষ্ট জীবন তৈরি করতে পারে।
বৌদ্ধধর্ম শুধু আধ্যাত্ম সাধনার জন্য মুক্তি বা নির্বাণ লাভের কথা বলেনি, বরং জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে মন্দ বা অসৎ প্রবণতা থেকে মুক্তির কথা বলেছে। জীবনের সব কার্যকলাপে সৎ, নির্লোভ, নির্মোহ, সচ্চরিত্র এবং বিত্তবৈভব-তৃষ্ণামুক্ত নির্বাণ লাভের কথাও বলেছে।
ব্যক্তি মনের নানা রকম কুমানসিকতা, হিংসা, বিদ্বেষ, জিঘাংসা, বৈরিতা ব্যক্তির চিত্তকে মলিন করে ফেলে। এ মলিন চিত্তে কখনও প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা এবং দান, সেবা ও পরোপকারিতার মতো সৎ গুণ আসতে পারে না। এমনকি শ্রদ্ধাবোধ, সৌজন্যবোধ এবং হৃদয়ের উদারতাও উৎপন্ন হতে পারে না।
বুদ্ধ বলেছেন, প্রার্থনায় কখনও মুক্তি আসে না, যদি সৎ চিন্তা ও সৎ কর্ম না করা হয়। প্রার্থনা ও কর্ম এক হলেই সাধনা সিদ্ধি হয়। এজন্যই বৌদ্ধধর্মে আটটি প্রার্থনার পথ ও কর্মের কথা বলা হয়েছে, যাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটটি বিশুদ্ধ পথ।
এগুলোর অনুশীলন ও চর্চায় জীবন সুন্দর, মাধুর্যময় ও পরিপূর্ণ হয়। যেমন- সৎ বাক্য বলা, সৎ চিন্তা করা, সৎ কর্ম করা, সৎ জীবিকা নির্বাহ করা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি, সৎ সমাধি করা ইত্যাদি।
মানুষের প্রতি মানুষের অনাবিল, অকৃত্রিম, শর্তহীন প্রেম ও মৈত্রী যেখানে থাকবে সেখানেই সামাজিক সংহতি ও পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে। অতএব ব্যক্তির সৎ-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নিজের ভালো-মন্দ নির্ভর করে।
একজন ব্যক্তির সৎ চিন্তা, সৎ মননশীলতা ও সুকর্ম শুধু নিজকে নয়, পরিবারকে নয়; সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের চেহারা বদলে দিতে পারে। এজন্যই বুদ্ধ বলছেন, প্রথমে নিজে শুদ্ধ, প্রদীপ্ত হও, পরে অন্যকে শুদ্ধ ও প্রদীপ্ত করো- অত্তদীপ বিহরথ, অত্ত সরণ অনঞঞো সরণো।
অতএব এ পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধধর্মকে সামগ্রিক মূল্যবোধে এবং মানবিক গুণ দিয়ে বিচার করতে হবে। বৌদ্ধধর্মে কতগুলো নীতিগুচ্ছ কিংবা নিয়ম-নীতির কথা বলা হয়েছে, যা প্রত্যেক মানুষেরই অনুসরণ করা উচিত।
যেমন বৌদ্ধ পঞ্চশীলে বলা হয়েছে প্রাণী হত্যা, চৌর্যবৃত্তি, অবৈধ ব্যভিচার না করা; মিথ্যা কথা না বলা এবং কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন না করা। এসব কাজে কাউকে কোনো রকম উৎসাহিত না করার কথাও বলা হয়েছে।
এছাড়া ঘুষ, উৎকোচ, যৌন নিপীড়ন, দুর্নীতিসহ নানা ধরনের সামাজিক অত্যাচার-অনাচারকেও বৌদ্ধধর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মহামতি বুদ্ধের এই পঞ্চনীতি পালনে ব্যক্তি যেমন উপকৃত হয়, নিরাপদে থাকে; তেমনি সমাজ ও দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে অবস্থান করতে পারে।
বুদ্ধের নীতি ও অনুশাসনগুলো আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আপন কর্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বুদ্ধ নিজ কর্মগুণকেই বড় করে দেখেছেন, অদৃষ্ট বিধিলিপিকে নয়। বুদ্ধের এ দর্শন ও যুক্তিবাদ মানুষের আপন কর্মশক্তিকে আস্থাবান করে তুলেছে। মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তির জন্য, স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য এর চেয়ে অভিনব দর্শন আর কী হতে পারে?
বুদ্ধপূর্ণিমার এ শুভদিনে বৌদ্ধধর্মের এ মানবিক শিক্ষা, উদার নীতি ও সর্বজনীনতা আমাদের মানবিক গুণে উদ্বুদ্ধ করুক। আমাদের সব ধরনের সংকীর্ণতা, জাতি-ধর্মবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এবং সংঘাত ও সহিংসতা দূরীভূত করুক।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে মানবতাবোধ, মৈত্রী, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধ রচিত হোক। চলুন আমরা আজ সবাই এই আদর্শে উজ্জীবিত হই এবং দেশ, জাতি ও বিশ্বমানবতাকে উপকৃত করি।
মহান বুদ্ধপূর্ণিমা সার্থক হোক। সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু‘- জগতের সব জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সবাই মঙ্গল লাভ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার