1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪১ অপরাহ্ন

ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ

প্রতিবেদক
  • সময় শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১৮
  • ৩৫১৯ পঠিত
স্বামী বিবেকানন্দ: প্রত্যেক ধর্মে আমরা এক এক প্রকার সাধনার বিশেষ বিকাশ দেখিতে পাই। বৌদ্ধধর্মে নিষ্কাম কর্মের ভাবনাটাই বেশ প্রবল। আপনারা বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে ভুল বুঝিবেন না, এদেশে অনেকেই ঐরূপ করিয়া থাকে। তাহারা মনে করে, বৌদ্ধধর্ম সনাতনধর্মের সহিত সংযোগহীন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে, ইহা আমাদের সনাতন ধর্মেরই সম্প্রদায় বিশেষ। গৌতম নামক মহাপুরুষ কতৃক বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত। তৎকালিন অবিরত দার্শনিক বিচার, জটিল অনুষ্ঠান পদ্ধতি, বিশেষতঃ জাতিভেদের উপর তিনি অতিশয় বিরক্ত ছিলেন। কেহ কেহ বলেন, ‘আমরা এক বিশেষ কূলে জন্মিয়াছি; যাহার এরূপ বংশে জন্মে নাই, তাহাদের অপেক্ষা আমরা শ্রেষ্ট।’ ভগবান বুদ্ধ জাতিভেদের এইরূপ ব্যাখ্যার বিরোধী ছিলেন। তিনি পুরোহিত-ব্যবসায়ীদের অপকৌশলেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এমন এক ধর্ম প্রচার করিলেন, যাহাতে সকাম ভাবের লেশমাত্র ছিল না, আর তিনি দর্শন ও ঈশ্বর সম্বন্ধে নানাবিধ মতবাদ আলোচনা করিতে চাহিতেন না; ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। অনেক অনেক সময় তাঁহাকে ঈশ্বর আছেন কি না জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তর দিতেন, ‘ও-সব আমি কিছু জানি না।’ মানবের প্রকৃত কর্তব্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিতেন, ‘নিজে ভাল কাজ কর এবং ভাল হও।’
 
একবার তাঁহার নিকট পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহাকে তাঁহাদের তর্কের মীমাংসা করিয়া দিতে বলিলেন। একজন বলিলেন, ‘ভগবান্, আমার শাস্ত্রে ঈশ্বরের স্বরূপ ও তাঁহাকে লাভ করিবার উপায় সম্বন্ধে এই কথা আছে।’ অপরে বলিলেন, ‘না, না, ও-কথঅ ভুল; কারণ আমার শাস্ত্র ঈশ্বরের স্বরূপ ও তাঁহাকে লাভ করিবার সাধন অন্য প্রকার বলিয়াছে।’ এইরূপ অপরেও ঈশ্বরের স্বরূপ ও তৎপ্রাপ্তির উপায় সম্বন্ধে নিজ নিজে শাস্ত্রের দোহাই দিয়া ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তিনি প্রত্যেকের কথা বেশ মনোযোগ দিয়া শুনিয়া প্রত্যেককে এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কাহারও শাস্ত্রে কি এ কথা বলে যে, ঈশ্বর ক্রোধী হিংসাপরায়ণ বা অপবিত্র?’
 
ব্রহ্মণেরা সকলেই বলিলেন, ‘না, ভগবান্, সকল শাস্ত্রেই বলে ঈশ্বর শুদ্ধ ও কল্যাণময়।’ ভগবান বুদ্ধ বলিলেন, ‘বন্ধুগণ, তবে আপনারা কেন প্রথমে শুদ্ধ, পবিত্র ও কল্যাণকারী হইবার চেষ্টা করুণ না, যাহাতে আপনারা ঈশ্বর কিবস্তু জানিতে পারেন?’
 
অবশ্য আমি তাঁহার সকল মত সমর্থন করি না। আমার নিজের জন্যই আমি দার্শনিক বিচারের যথেষ্ট আবশ্যকতা বোধ করি। অনেক বিষয়ে তাঁহার সহিত আমরা সম্পূর্ণ মতভেদ আছে বলিয়াই যে আমি তাঁহার চরিত্রের, তাঁহার ভাবের সৌন্দর্য দেখিব না, ইহার কি কোন অর্থ আছে? জগতের আচার্যগণের মধ্যে একমাত্র তাঁহারই কার্যে কোনরূপ বাহিরের অভিসন্ধি ছিল না। অন্যান্য মহাপুরুষগণ সকলেই নিজদিগকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন, আর ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, ‘আমাকে যাহারা বিশ্বাস করিবে, তাহারা স্বর্গে যাইবে।’ কিন্তু ভগবান বুদ্ধ শেষ নিঃশ্বাসের সহিত কি বলিয়াছিলেন, তিনি বলিয়অছিলেন, ‘কেহই তোমাকে মুক্ত হইতে সাহায্য করিতে পারে না, নিজের নিজে কর, নিজের চেষ্টা দ্বারা নিজের মুক্তিসাধন কর।’ নিজের সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, ‘বুদ্ধ-শব্দের অর্থ আকাশের ন্যায় অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। আমি গৌতম সেই অবস্থা লাভ করিয়াছি; তোমরাও যদি উহার জন্য প্রণপণ চেষ্টা কর, তোমরাও উহা লাভ করিবে।’ তিনি সর্ববিধ কামনা-ও অভিসন্ধি-বর্জিত ছিলেন, সুতরাং তিনি স্বর্গগমনের বা ঐশ্বর্যের আকাঙ্খা করিতেন না। তিনি রাজসিংহাসনের আশা ও সর্ববিধ সুখে জলাঞ্জলি দিয়া ভারতের পথে পথে ভ্রমণ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা উদরপূরণ করিতেন এবং সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয় লইয়া নরনারী ও অন্যান্য জীবজন্তুর কল্যাণ যাহতে হয়, তাহাই প্রচার করিতেন। জগতের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি যজ্ঞে পশুহত্যা-নিবারণের উদ্দেশ্যে পশুগণের পরিবর্তে নিজ জীবন বিসর্জনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি একবার জনৈক্য রাজাকে বলিয়াছিলেন, ‘যদি যজ্ঞে ছাগশিশু হত্যা করিলে আপনার স্বর্গ গমনের সহায়তা হয়, তবে নর হত্যা করিলে তাহাতে আরও অধিক উপকার হইবে, অতএব যজ্ঞস্থলে আমায় বধ করুণ।’ রাজা এই কথা শুনিয়া বিস্মৃত হইয়াছিলেন। অথচ এই মহাপুরষ সর্ববিধ – অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন। তিনি কর্মযোগের আদর্শ; আর তিনি যে উচ্চাবস্থায় আরোহন করিয়াছিলেন, তাহাতেই বেশ বুঝা যায়, কর্ম দ্বারাও আমরাও আধ্যাত্মিকাতার চরম শিখরে আরোহন করিতে পারি।
 
অনেকের পক্ষে একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতে পারিলে সাধনার পথ খুব সহজ হইয়া থাকে। কিন্তু বুদ্ধের জীবনালোচনায় স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, যদি কোন ব্যক্তি আদৌ ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হয়, তাহার যদি কোন দার্শনিক মতে বিশ্বাস না থাকে, সেযদি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়, অথবা কোন মন্দিরিতেও না যায়, এমন কি প্রকাশ্যে নাস্তিক বা জড়বাদীও হয়, তথাপি সে সেই চরম অবস্থা লাভ করিতে সমর্থ। তাঁহার মতামত বা কার্যকলাপ বিচার করিবার অধিকার আমাদের কিছুমাত্র নাই। আমি যদি বুদ্ধের অপূর্ব হৃদবত্তার লক্ষভাগের একভাগের অধিকারী হইতাম, তবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করিতাম। হইতে পারে বুদ্ধ ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতেন, অথবা হয়তো বিশ্বাস করিতেন না, তাহা আমার চিন্তনীয় বিষয় নয়। কিন্তু অপরে ভক্তি, যোগ বা জ্ঞানের দ্বারা যে পূর্ণ অবস্থা লাভ করে, তিনিও তাহাই লাভ করিয়াছিলেন। কেবল ইহাতে উহাতে বিশ্বাস করিলাই সিদ্ধিলাভ হয় না। কেবল মুখে ধর্মের কথা, ঈশ্বরের কথা আওড়াইলেই কিছু হয় না। তোতা পাখীকেও যাহা শিখাইয়া দেওয়া যায়, তাহাই সে আবৃত্তি করিতে পারে। নিষ্কামভাবে কর্ম করিতে পারিলেই তাহা দ্বারা সিদ্ধিলাভ ইহয়া থাকে।
 
-(আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে প্রদত্ত ভাষণ অনুসারে)
Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!