অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া:
বিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা-ভারত উপমহাদেশে থেরবাদী বৌদ্ধ আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ়প্রত্যয়ে এদেশের বৌদ্ধ সমাজে যে ক’জন ক্ষণজন্মা মনীষী জন্ম নেন তাদের মধ্যে শান্তপদ মহাথেরোর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার (বর্তমান লোহাগাড়া) অন্তর্গত চেঁদিরপুনি গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে তার জন্ম। জন্মতিথি ২৭ ফাল্গুন ১৯১৪ সন। পিতা পীতাম্বর বড়ুয়া ও
মাতা ভারতেশ্বরী বড়ুয়ার ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তার বাল্যনাম ছিল সুশান্ত। সেই কিশোর মাত্র ১৪ বছর বয়সেই প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষা নেন তারই নিজ বিহারের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ধর্মানন্দ মহাস্থবিরের কাছে। তখনই তার ধর্মীয় নাম রাখা হয় শান্তপদ। সেই কিশোর
শান্তপদ ১৯৩৫ সালে ভিক্ষু-উপসম্পদা লাভের পর
সেদিনের সেই বিপন্ন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন গভীর আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে। তিনি ছিলেন রাজধানী ঢাকার মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের রূপকার ও স্বপ্নদ্রষ্টা।
জীবনব্যাপী তার শ্রম, মেধা, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও
আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি সদ্ধর্মকে করেছেন
উজ্জীবিত ও উদ্ভাসিত। স্থবির ও বিভক্তিময়
সমাজের ঐক্য, শান্তি, সংহতি ও জাগৃতি আনয়নের
লক্ষ্যে তার অসামান্য অবদানকে আমরা আজ শ্রদ্ধার
সঙ্গে স্মরণ করছি তার মৃত্যুর দীর্ঘ দু’দশকেরও অধিক
পর। ঢাকার মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ
বিহার, তার সুদীর্ঘজীবনের সাধনস্থল মির্জাপুর
গৌতমাশ্রম বিহার এবং সেখানকার পালি কলেজ ও
ধ্যান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমবঙ্গের মহেশতলা,
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িসহ দেশ-
বিদেশে নানা ধরনের ধর্মীয়, শিক্ষা, সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও স্থাপনের
ক্ষেত্রে তার অসামান্য সৃষ্টিশীলতা আমাদের
অভিভূত করে।
তিনি একাধারে ২৯ বছর বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু
মহাসভা ‘দি সুপ্রিম সংঘ কাউন্সিল অব
বাংলাদেশ’-এর সেক্রেটারি জেনারেল ও ভাইস
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যোগ্যতার
সঙ্গে। তাছাড়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ‘এশীয় বৌদ্ধ
শান্তি সংস্থা (এবিসিপি)-বাংলাদেশ আঞ্চলিক
শাখা’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন শান্তির
অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে। এছাড়াও শতাব্দীর প্রাচীন
বৌদ্ধ সংগঠন ‘বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি’ ও
‘বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘে’র ভাইস
প্রেসিডেন্টসহ দেশ-বিদেশের নানান ধর্মীয় ও
সামাজিক সংস্থার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
তার মধ্যে কোনো রকম সংকীর্ণতা ছিল না।
সমাজের বহু হতদরিদ্র ও অবহেলিত ছাত্র-ছাত্রী তার
সান্নিধ্য লাভে জীবনকে ধন্য ও সার্থক করেছে। তার
সময়ে বৌদ্ধ গৃহী ও ভিক্ষু সমাজে তেমন
কোনো বিরোধ ও বিভাজন ছিল না। নিকায়গত
দূরত্বকে তিনি কখনও প্রাধান্য দেননি।
এগুলোকে ঘোচানোর জন্য তিনি সার্বক্ষণিক
চিন্তা করতেন এবং নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন
বেশ উদারতার সঙ্গে।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রধান
সেদিনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মহামান্য
মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর সঙ্গে ছিল
তার গভীর যোগাযোগ ও সখ্য। অনুজ মাননীয় শুদ্ধানন্দ
মহাথেরোর সঙ্গেও ছিল তার সহৃদয় বন্ধুত্ব ও নিবিড়
সম্পর্ক। সত্যিকার অর্থে তা আজকের দিনে ভাবার
মতো। কী অসাধারণ সম্পর্ক ছিল ধর্মরাজিক বৌদ্ধ
বিহারের সঙ্গে, তাদের দায়ক-দায়িকা ও
ভিক্ষুসংঘের সঙ্গে, না দেখলে বোঝার মতো নয়।
কর্মজীবনে শান্তপদ মহাথেরোর ছিল এক বলিষ্ঠ
নেতৃত্ব। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা—ব্রহ্মব
িহারের এ চারটি গুণধর্ম ছাড়াও তার
মধ্যে আমরা আরও দেখেছি শীলগুণ, জ্ঞান ও
বিদ্যাগুণ, আর অসাধারণ দূরদর্শিতা।
আমরা দেখেছি সমাজের জন্য তার কল্যাণব্রত
ভাবনা আর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা যা সমাজের
ঐক্য ও নিরঙ্কুশ ভাবনাগুলোকে আরও উদ্দীপন
করে তুলত। সেই সঙ্গে আছে যুক্তি ও বৌদ্ধ
কার্যকারণভিত্তিক চিন্তা-চেতনাও।
সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা তো আছেই। এজন্য
তিনি দার্শনিক নাগার্জুনের মতো বাস্তবতাকে সামনে রেখে নিজের বিবেক,যুক্তি আর বোধ দিয়ে সবকিছুকে সমাধান করার সিদ্ধান্ত খুঁজতেন। তাই চিরাচরিত সমাজের
সনাতনী প্রথা ও নিয়মগুলোকে ঢেলে সাজানোর
একটি অভিজ্ঞান তাকে চালিত করত প্রতিটি কর্মে,
প্রতিটি মুহূর্তে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মৃদুভাষী ও নিরহঙ্কারী।
ছিলেন বেশ উদার, বিনয়ী ও কোমল স্বভাবের।নির্লোভ ও নির্মোহতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আতিথেয়তা ও বাত্সল্যপূর্ণ আলাপচারিতায় তাকে আমরা সবসময় প্রাণবন্ত দেখেছি। এ গুণগুলোই ছিল তার চরিত্রের অমিয়
কর্মশক্তি। মানবিক এসব গুণের কারণেই তিনি তার
জীবনের সব কাজে সফল হয়েছেন এবং সে সময়কার
ভিক্ষু ও গৃহী সমাজের সব ধরনের বাধা, সঙ্কট ও বন্ধুর
পথকে উত্তরণ ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন।
তার কর্ম-কৃতিত্বের উল্লেখযোগ্য সফলতা হলো ১৯৬৭
সালে আন্তর্জাতিকভাবে সংঘরাজ শতবার্ষিকী উদযাপন, ১৯৭৩ সালে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালি বৌদ্ধদের গৌরব, ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহামান্য সংঘরাজ, ভারত সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত, বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন গ্রন্থ প্রণেতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক মহাপণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের ৭২তম সুবর্ণজয়ন্তী ও পরিবাসব্রত অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। তাছাড়া ১৯৬৩ সালে এদেশের প্রথম সারির সমাজসংস্কারক থেরবাদী আদর্শে উজ্জীবিত প্রয়াত
সংঘরাজ গুণালঙ্কার মহাস্থবিরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও পরিবাসব্রত সুসম্পন্নও তার অসামান্য কর্মদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
মাননীয় শান্তপদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়
ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে পণ্ডিত
জ্যোতিপাল মহাথেরোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ দেশগুলোর জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর সঙ্গেও শান্তির সপক্ষে এবং এদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের বাঁচানোর জন্য
নানা পরামর্শ গ্রহণ করেন।
এ মহান সংঘ মনীষা আজ আমাদের মাঝে নেই।
তিনি আজ থেকে দু’দশকেরও বেশি সময় আগে অর্থাত্
১৯৮৭ সালের ১৯ আগস্ট রাজধানী ঢাকার ৮ নং মোমিনবাগস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের অস্থায়ী কার্যালয়ে বিগত বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খানের ভাড়া করা বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
আমরা মনে করি, তিনি আজ আমাদের
সামনে না থাকলেও তার আদর্শে বৈরিতাপূর্ণ
সমাজের অনৈক্য দূরীকরণের লক্ষ্যে আমরা পারস্পরিক
কাছাকাছি আসতে পারব। পরস্পর বন্ধু হব,
সহযোগী হব। নিরাপদে বাঁচতে হলে আমাদের
স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবার মধুর ও
প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত এবং কোনো রকম
ভেদাভেদ ও বৈষম্য না রেখে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও
আমাদের সহাবস্থান আরও সুদৃঢ় এবং আরও অনিবার্য
করা উচিত। কামনা করি আচার্য শান্তপদ অমর হোন।
তার আদর্শ আমাদের অন্তরে চিরস্থায়ী হোক।