প্রণব বড়ুয়া অর্ণব, ভারত থেকে ফিরে
কলকাতার রাজপথে ছোটখাটো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথার উপর দেয়া হয়েছে ছাউনিও। দেখে মনে হতে পারে মানুষটিকে বন্দী করে রাখা হয়েছে কারাগারে। চলতি পথে কাউকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবনার জগতে এলোমলো নানা কথামালা আসতেই পারে। যদি জিজ্ঞাসু মনে এগিয়ে যান, ভাবনার জগতে ছেদপড়বে। রাজপথের মানুষটি আর কেউ নয়, তিনি ড. বেণীমাধব বড়ুয়া। এশিয়ার প্রথম ডি লিট ডিগ্রিধারী, চট্টগ্রামের রাউজানের মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৫ সালের ৩১ডিসেম্বর তাঁর প্রতিবিম্ব কলকাতার বউবাজার(বহুবাজার) থানা ও হেয়ার স্ট্রিট থানার পেছনেসড়কদীপে স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে তাঁর প্রতিমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে তার কাছেই ‘বৌদ্ধধর্মাঙ্কুর’। যেখানে তাঁর জীবনের বেশি সময় অতিবাহিত করেন।
যেখানে বসে নালন্দা বিদ্যাভবন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং বাংলা ভাষায় প্রথমবৌদ্ধশাস্ত্র চর্চার পত্রিকা জগজ্জ্যোতি সম্পাদনাকরতেন। ‘জগজ্জ্যোতি’ পত্রিকাটি আজো প্রকাশিত হয়। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে প্রতিমূর্তিটি স্থাপন করা হয়। সোনাঝরা রংয়ে আলোকিত এ মানুষটির দ্যুতি যেনো ছড়িয়ে পড়ছে। কৃর্তীমান এ মানুষটিকে কৃতজ্ঞতা জানাতে কার্পণ্য করেনি কালকাতা পৌরসভা। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে তুলে ধরার এটি একটি প্রয়াস।
জানা যায়, ১৮৮৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামেররাউজানের মহামুনি পাহাড়তলী গ্রাম জন্মগ্রহণকরেন ড. বেণীমাধব বড়–য়া। তাঁর পিতার নাম রাজচন্দ্র তালুকদার ও মা’র নাম ধনেশ্বরী দেবী। পিতা–মাতার এগার সন্তানের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ। মাত্র ছয়বছর বয়সে গ্রামের মডেল স্কুলে তিনি পড়ালেখা শুরু করেন। ঐ স্কুল থেকে মিডল ইংলিশ (এম ই) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন । পরবর্তীতে ঐ স্কুল থেকেদ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রাস পাস করেন। ভর্তি হন চট্টগ্রামকলেজে এফ এ পড়ার জন্য। দ্বিতীয় বিভাগে এফ এপাশ করে বেণীমাধব কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজেভর্তি হন বিএতে । কিন্তু এফএ পড়াকালীন সময়ে তাঁকে যিনি পিতার স্নেহে পড়ালেখার খরচ চালাতেন সেই ধনঞ্জয় তালুকদারের মৃত্যু ঘটে। উচ্চশিক্ষার পথে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা, বেণীমাধব বড়ুয়ার ছোট ভাই কানাই লাল রেঙ্গুনে সাঙ্গুভেলী টি কোম্পানিতে চাকুরি নিয়ে তাঁর পড়ালেখার খরচনির্বাহ করতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে পালি পড়ারব্যবস্থা না থাকায় পড়তে যেতে হত প্রেসিডেন্সি কলেজে। পালি ভাষায় অনার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিএ পাশ করেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষায় এমএ’তে ভর্তি হন। এমএ’তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েস্বর্ণপদক লাভ করেন। এমএ পাশ করার এক বছরপরে কলকাতার বউবাজারে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুরবিহারের প্রতিষ্ঠাতা চট্টগ্রামের পটিয়ার ঊনাইনপূরারকৃতি সন্তান কৃপাশরণ মহাস্থবির এবং স্যারআশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ভারত সরকারতাঁকে ‘অ্যান অ্যানুয়াল স্টেট স্কলারশিপ ফর দ্যাসায়েন্টিফিক স্টাডি অফ পালি ইন ইউরোপ’ নামক রাষ্ট্রীয় বৃত্তি মঞ্জুর করেন। তিনি সেই রাষ্ট্রীয় বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা করে লন্ডনবিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক ছাত্র হিসাবে যোগ দেন। এইবিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফি– ইটসঅরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ ফ্রম বেদাস টু দ্য বুদ্ধ নামকবেদোত্তার সংস্কৃত ভাষা ভিত্তিক একটি গ্রন্থ রচনারভার দেওয়া হয়। এই গবেষণা সমাপ্ত হলে তিনি লন্ডনবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যিনিডি. লিট উপাধি লাভ করেন।
লন্ডন থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে তিনিপালি বিভাগে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বনেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরউপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে বেণীমাধব বড়ুয়ার গবেষণাপত্রটিকে আ হিষ্ট্রি অফ প্রি– বুদ্ধিস্টিক ইন্ডিয়ান ফিলোসফি নামে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।এই গ্রন্থে অমোঘবর্মণ ও মহিদাস ঐতয়ের সম্পর্কেতিনি মৌলিক মূল্যায়ন করেন। কয়েক বছর পরতাঁবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সংস্কৃত বিভাগেওঅধ্যাপনার দায়িত্ব নেওয়া হয়। পালি বিভাগেরবিভাগীয় প্রধান সতীশচন্দ্র বিদ্যাভ’ষণের মৃত্যু ঘটলেতিনি ঐ পদ গ্রহণ করেন। কয়েক বছর পরে তাঁকেবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে উন্নীত করা হয়।পালি ভাষার বি.এ এবং এম. এ কোর্সের সিলেবাসের সংস্কার তাঁর অন্যতম কীর্তি। তিনি সংস্কৃত ও পালিভাষার সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, ভূগোল, বহির্ভারতে বৌদ্ধ শাস্ত্র, বৌদ্ধধর্ম, দর্শন, শিল্পকলা, মূর্তিতত্ত্ব ও সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন করে এক নতুন যুগোপযোগী সিলেবাস তৈরি করেন।
তিনি সংস্কৃত কলেজের আদর্শে পালি ভাষা ওসাহিত্য গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে নালন্দা বিদ্যাভবন স্থাপন করেন বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর ভবনে। এই বিদ্যাভবনেরউদ্বোধনের করেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ এবংশ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মাঙ্কুরবিহার লাগোয়া জমিতে ভিক্ষু ছাত্র ও তীর্থযাত্রীদের জন্য আর্য্য বিহার নামে এক নতুন ভবনের নির্মাণ করা হলে নালন্দা বিদ্যাভবন সেখানে স্থানান্তরিত হয়। বেণীমাধব সেখানে পড়াতেন এবং ঐবিদ্যাভবনের নালন্দা নামক মুখপত্র প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন।
বাংলা ভাষায় প্রথম বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চার পত্রিকাজগজ্জ্যোতি প্রকাশিত হয় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন কৃপাশরণ মহাস্থবির। এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ গুণালংকার মহাস্থবির ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরপালি ভাষার অধ্যাপক শ্রমন পুন্নানন্দ। পরবর্তীতে এ পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন বেণীমাধন বড়ুয়া। তিনি বাংলা ও ইংরেজী বহুগ্রন্থের প্রণেতা। দেশ–বিদেশের নানা সম্মাননা তিনিলাভ করেন।
তাকে নিয়ে রয়েছে নানা গবেষণা গ্রন্থ, প্রকাশিতহয়েছে নানা প্রবন্ধ নিবন্ধ। বাংলা একাডেমী তাঁকেনিয়ে বই প্রকাশ করেছেন। তাঁকে বই লিখেছেনদেবপ্রিয় বড়ুয়া। বিশেষ নিবন্ধে ভারতীয় শাস্ত্রবিদহরনাথ চৌধুরী লিখেছেন, ‘প্রাচীন ভারতকে বুঝতেগেলে পালি জানা আবশ্যক প্রমান করেছেন আচার্য বড়ুয়া (ড. বেণীমাধব বড়ুয়া)। প্রসঙ্গত, ১৯৪৮সালের ২৩ মার্চ আমাদের এ আলোকিত সন্তান ৫৯বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।