মন্দিরের স্বপ্নদ্রষ্টা চট্টগ্রামের সন্তান
প্রণব বড়ুয়া অর্ণব:
বিহার ভারতের একটি রাজ্য। আর এ রাজ্যে রয়েছে এক টুকরো বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ বৌদ্ধ বিহার’। বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়ায় ধর্মীয় আলো ছড়ানো প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু আশির দশকে। তবে ’৯০ দশকে বিহার, তীর্থনিবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি নয়, বিভিন্ন দেশের পর্যটন ও ধর্মপিপাসু মানুষের আস্থার প্রতিষ্ঠান এ বৌদ্ধ বিহার।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান অধ্যক্ষ হচ্ছেন ড. কল্যাণপ্রিয় থের। তিনি জানান, ভারতের পবিত্র বৌদ্ধ তীর্থ বুদ্ধগয়ায় বাংলাদেশ বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের। সে স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়েছেন সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের। ১৯৮৪ সাল ভারতের রাজধানী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সংস্কৃতি সম্মেলন, যা উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই সম্মেলনের পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, ড. সুনীথানন্দ ভিক্ষু, রতন কুমার বড়ুয়া। সরকারি দপ্তরে একান্ত আলাপচারিতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মহাসংঘনায়ককে বলেন, আপনাদের জন্য কী করতে পারি বলেন। মহাসংঘনায়ক যেন এ কথাটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তিনি বললেন, আপনি আমাদের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীও মহাসংঘনায়কের জবাবে বললেন, কী রকম? বৌদ্ধতীর্থ বুদ্ধগয়ায় বাংলাদেশি বৌদ্ধদের জন্য বিহার, তীর্থ নিবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী মহাসংঘনায়ককে আশ্বস্ত করলেন এবং জমি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এসময় সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও একটা নিবেদন আছে। সেটা হল জমি দিলে হবে না। বিহার নির্মাণের জন্য অর্থ দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর নয়। তাতেও রাজী হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী । জিজ্ঞাসা করলেন কার নামে জমি দিতে হবে। মহাসংঘনায়ক ড. প্রণব কুমার বড়–য়াকে সংগঠনের নাম লিখে দিতে বলেন। নামটি লিখে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের কাছে দেয়া হয়। কিন্তু এ সাক্ষাৎকারে ১৪ দিনের মাথায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। পরে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই সন্তান রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনিই বুদ্ধগয়াস্থ এ জমিটি বরাদ্দ প্রদান করেন। ১৯৯০ সালে গয়া জেলা কর্মকর্তা জমির দলিলসহ জায়গা বুঝিয়ে দেন। এক একর এ জায়গায় চারকক্ষ বিশিষ্ট অস্থায়ী বিহার নির্মাণ করে চারিদিকে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়। ১৯৯২ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও
থাইল্যান্ডের ওয়াট পাক নামের অধ্যক্ষ ফ্র ধর্মাধিরাজ মংগলদের মহামুনি। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘসহ দেশ বিদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তারপরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। ড. কল্যাণপ্রিয় বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদষ্টাদের দু’জনই চট্টগ্রামের সন্তান। মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের চট্টগ্রামের রাউজানের, সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের রাঙ্গুনিয়ার সন্তান।
বিহারে উপাধ্যক্ষ করুণাজ্যোতি থের বলেন, এ এক টুকরো বাংলাদেশে নির্মায়মান দ্বিতল বৌদ্ধ বিহার, পৃথক দুটি বিশাল ও সুপরিসর তীর্থ নিবাস রয়েছে। যা বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশের তীর্থ যাত্রীসহ পর্যটন পিপাসুদের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। এখানে সিনিয়র ভান্তে বোধিময় থেরসহ ২০ জনের মতো ভিক্ষু শ্রমণ রয়েছেন। ‘মহাবোধি বিহার’- যেখানে বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলো সে স্থান থেকে পায়ে হাঁটা পথ মাত্র ৪/৫ মিনিট। যে কারণে তীর্থ যাত্রীসহ পর্যটন পিপাসুদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। বিহারে দু’দিকে রয়েছে বিশাল দু’টি গেট ও মাঠে রয়েছে সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি। দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান। বুদ্ধগয়ায় বাংলাদেশি এবিহার ছাড়াও দেশ বিদেশের আরো অর্ধশতাধিক বিহার রয়েছে। তার মাঝেও আলোর দ্যুতি ছাড়ানো এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষাভাষীসহ দেশে বিদেশি মানুষের আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সম্প্রদায়, গোষ্ঠি, ধর্ম সব কিছু ছাপিয়ে বিহারের বুকে এ খন্ড বাংলাদেশ জানান দিচ্ছে হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্য বিদেশ বিভূইয়ে ধারণ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, বৌদ্ধ দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রয়াত ড. রাষ্ট্রপাল মহাস্থবির ‘বুদ্ধগয়া আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা’ কেন্দ্র নামে একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য বুদ্ধগয়ায় এপ্রতিষ্ঠানটিও আস্থার প্রতিষ্ঠান ছিল। তিনি চট্টগ্রামের রাউজানের ফতেনগর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। আনন্দ বিহার নামে আরও একটি বাংলাদেশি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে।
সুত্র: দৈনিক পূর্বকোণ