সৃজন ভট্টাচার্য: সম্পদের বৈভব ভারতকে ‘সোনার পালক যুক্ত পক্ষী’ বলে পরিচিতি দিয়েছিল। ভৌগলিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্রও লক্ষণীয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পথচলা শুরু এই ভারতবর্ষেই। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার বিভিন্ন সময়ে হয়েছে, বেশ কয়েকটি সুসময়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তেমনি বিভিন্ন ওঠা পড়ার মধ্যে দিয়েও গেছে। বৌদ্ধধর্মের ওঠা পড়ার এক নীরব সাক্ষী পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের মোগলমারি বৌদ্ধ বিহার।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর অশোক দত্তের হাত ধরে পরিচিতি পায় মোগলমারি বৌদ্ধবিহার। কিন্তু তার অনেক আগে নগেন্দ্রনাথ বসু ১৮৭৩ সালে এই বৌদ্ধবিহার আবিষ্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন। নগেন্দ্রনাথ বসুর লেখা ‘The Archaeological Survey Mayurabhanja(1911)’ থেকে এই বৌদ্ধবিহার আবিষ্কারের কথা জানা যায়। চীনা বৌদ্ধ পর্যটক হিউয়েন সাং র ভ্রমণ বৃত্তান্তেও উল্লেখ আছে এই বৌদ্ধবিহারের, তিনি দীর্ঘ সতেরো বছর ভারতে ছিলেন।
আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে তৈরি হয় এটি, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছিল এই বৌদ্ধবিহার। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এটি অনেকবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ও পুনরায় নির্মিত হয়েছে। বৌদ্ধবিহারটি নির্মাণ করেন স্থানীয় রাজা। তবে অনেকের মতে কণিষ্কই মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের প্রতিষ্ঠাতা, বন্দর শহর তাম্রলিপ্তের (তমলুক) কাছে হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও থাকতে পারে। সুবর্ণরেখার বাঁ তীরে অবস্থিত এই মোগলমারি গ্রাম।
২০০৩-০৪ সালে প্রফেসর দত্তের তত্ত্বাবধানে খননকার্য শুরু হয়, মোগলমারি গ্রামের দুটি জায়গা বেছে নেওয়া হয়। এই প্রোজেক্টের নাম MGM1, এই জায়গায় ইঁটের তৈরি ভাঙা আবর্জনা ভরা একটা স্ট্রাকচার দেখা যায় মাটির উপর থেকেই, যা স্থানীয় ভাবে ‘সখীসেনের ঢিপি’ বা ‘শসীসেনের ঢিপি’ নামে পরিচিত। MGM2 প্রোজেক্টের জন্য গ্রামের মানুষের বসবাসের জায়গার একটা অংশে খননকার্য চলে, যেখানে বৌদ্ধ স্তূপের ইঁটের তৈরি বৃত্তাকার স্ট্রাকচার দেখা যায়। নানান জিনিসপত্র উদ্ধার হয়, যেগুলি ষষ্ঠ কিমবা সপ্তম শতাব্দীর বলে অনুমান করা হয়। প্রথমবার মাটি খুঁড়ে বিহারটির পশ্চিমদিকের দেওয়াল, প্রাচীর প্রভৃতি দেখা যায়।
MGM1 র স্থলেই ২০০৬-০৭ শালে শুরু হয় MGM3, আবিষ্কার হয় লম্বা দেওয়াল, দেওয়ালে নানা ফুল, পশু-পাখি ও মানুষের স্টাকো মূর্তি।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো ২০১২ সালের পাওয়া প্রাচীরের গায়ে স্টাকো মূর্তিটি, মাঝে বুদ্ধের মূর্তি।
মাঝে বড় বৌদ্ধ মন্দির, চারপাশে স্কোয়ার কোর্ট ইয়ার্ড। সারী সারী ছোটো ছোটো কুঠি- এটাই এই বিহারের নির্মাণশৈলী। এখানে ‘বজ্রযান যুগে’র বেশ কিছু স্থাপত্য আছে বলে বিশেষজ্ঞ রজত স্যানাল মনে করেন। কারন এই সময়েই বৌদ্ধধর্মে মূর্তিপুজো শুরু হয়, দেওয়ালে জম্বালা ও সরস্বতীর মূর্তিই এর প্রমাণ। এছাড়া খননকার্যে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্রে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রভাব দেখা যায়। এবং খননকার্যের শেষ দিকে উদ্ধার হওয়া ৪০ টি ব্রোঞ্জের জিনিস ষষ্ঠ শতাব্দীর বলেই অনুমান।
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে The State Archaeological Directorate র তত্ত্বাবধানে বিস্তর খননকার্য শুরু হয়, পাওয়া যায় নানান গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জিনিস।
এটি স্থাপত্যের দিক থেকে বিক্রমশীলা, নালন্দা ও পাহাড়পুর বিহারের সমতুল্য। দাঁতন রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাঁচ কিমির মধ্যে এই মোগলমারি বৌদ্ধ বিহার, নেকুরসেনি স্টেশন থেকে আরও কাছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট দেখে আসুন, বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসের অনেককিছু জানতেও পারবেন।