ভিক্খু প্রজ্ঞাশ্রী:
মূর্খকে করো না সেবা
পণ্ডিতকে সেবিবে;
ইহাই সত্যধর্ম
নিশ্চয় জানিবে।
-মঙ্গল সূত্র
উক্ত আছে, এক ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিকট এসে বলে- “অমুক লোকটি আপনাকে গালি দিচ্ছে”। তখন তিনি অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলেন- “আমি তো ঐ ব্যক্তির কোন উপকার করেছি বলে মনে পড়ছে না। সে আমাকে কেন গালি দেবে?” বৌদ্ধ সাহিত্যে এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন উপদেশ এবং বাণী রয়েছে, তন্মধ্যে একটি বাণী হল-
“নিচ্চং খীরোদপানেন বড্ঢিতোসীবিসো যথা
বিসং ব পরিবত্তেন্তি এবং বালুপসেবনা।”
অর্থাৎ, নিত্য ক্ষীরোদক পানের দ্বারা বিষাক্ত সর্পের উপকার করলে যেমন তার দংশন যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তেমনি মূর্খের উপকার করার ফল ফলে।
সমাজে কৃতজ্ঞ ব্যক্তির চেয়ে অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন ব্যক্তিদের সংখ্যায় বেশী। যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে উপকারী ব্যক্তি সমাদৃত হবার স্থলে হচ্ছে লাঞ্ছিত! অভিনন্দিত হবার স্থলে হচ্ছে নিন্দিত! প্রত্যুোপকার পাবার স্থলে পাচ্ছে অবজ্ঞা। এসব দৃষ্টিকোণকে কেন্দ্র করে বুদ্ধের উপদেশ-
ন ভজে পাপকে মিত্তে ন ভজে পুরিসাধনে,
ভজেথ মিত্তে কল্যাণে ভজেথ পুরিসুত্তমে।
অর্থাৎ, পাপী মিত্রের সংসর্গ করবে না, নরাধম ব্যক্তির সংসর্গ করবে না; কল্যাণমিত্রদের ও পুরুষোত্তমদের সংসর্গ করবে। -ধর্মপদ ৮৮
প্রচলিত প্রবাদে এ বাণীটি দাঁড়ায় এমনি- সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। নরঘাতক, দস্যু অঙ্গুলিমাল ছিলেন মানবত্রাস, যার ভয়ে জালিবন দিয়ে যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় নগরবাসী। অথচ সেই অঙ্গুলিমাল ছিলেন মেধাবী-বিনয়ী তরুণ, অহিংসক। কিন্তু তার এমন পরির্বতনের কারণ কী? উত্তর সেই একটাই, অসৎ সঙ্গ, অসৎ গুরু, অসৎ পরামর্শক। আলোকোজ্জ্বল জীবনটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল বিভৎস। পরবর্তীতে, সে দিন তিনি পরমার্থ-মহাত্ম্যা, সৎ সঙ্গ, সৎ গুরু মহাকারুণিক বুদ্ধের সাক্ষাত পেয়েছেন বলে নিজেকে আবার নতুনরূপে আবিষ্কার করলেন। নৈর্বাণিক ধর্মরস আস্বাদে চির নিবৃত্তি লাভে সমর্থ হলেন।
তবে জীবনের চলার পথটি বেশিরভাগই কাঁটা দিয়ে মোড়ানো। পদে পদে বাধা, কন্টক। কল্যাণমিত্র এখানে বিরল। অধিকাংশই মিত্রের ভান ধরে সুযোগ সন্ধানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই কারো সাথে কদমে কদম ফেলার পূর্বে সম্যকভাবে বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক। উন্নত-সমমনা বা নিচুমনা বন্ধু, মিত্রামিত্র সনাক্ত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সর্বজ্ঞ বুদ্ধ স্পষ্টভাবে দেশনা করেছেন-
চরংচে নাধিগচ্ছেয্য সেয্যং সদিসমত্তনো,
একচরিযং দল্হং কযিরা নত্থি বালে সহায়তা।
অর্থাৎ, (জীবনযাত্রায়) যদি নিজের মত কিংবা উন্নততর সঙ্গী লাভ না হয় তবে দৃঢ়তার সাথে একা চল; মূর্খের সাথে সাহচর্য হয় না। -ধর্মপদ ৬১
মূর্খ বা অসৎ সংসর্গ এতটাই ভয়ানক যে, প্রবল পূণ্যপ্রভাও বিনষ্ট হতে পারে। উর্দ্ধগামী হবার পারমী বা লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও নিম্নগামীই হতে হয়! বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে তারই নিদারুণ উদাহরণ মগধরাজ অজাতশত্রু। পরাক্রমশালী মগধরাজ বুদ্ধের নিকট “শ্রামন্য ফল সূত্র” শ্রবণ পূর্বক নির্বাণ মার্গে প্রবেশের প্রথম সোপান স্রোতাপন্নে প্রতিষ্ঠিত হবার হেতু ছিল। কিন্তু সে সৌভাগ্য হল আর কই! শেষ পর্যন্ত নিম্নগামীই হতে হল। কারণ সেই অসৎসঙ্গ। দেবদত্তের সংসর্গে এবং কু-পরামর্শে পিতৃহত্যারূপ অকুশল গুরুকর্ম সম্পাদন করায় তার সেই প্রবল পুণ্যপারমী বিনষ্ট হয়ে তাকে নরকে পতিত হতে হয়। তাই বুদ্ধের উপদেশ মতে দুষ্টের সাথে চলার চেয়ে, একাকী বিচরণই শ্রেয়।
মনে রাখতে হবে, জীবনটা নিজের। যেকারণে জীবনকে সর্বোত্তম সুন্দর ও আলোকোজ্জ্বল করার দায়িত্বও বর্তায় নিজ কাঁধের উপর। পারিপার্শ্বিক সহায়তা সম্মুখ চলার পাথেয় মাত্র। এক্ষেত্রে বুদ্ধবাণীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে কীভাবে অভিষ্টতম জীবন গঠন করতে হয় তার উপদেশ পায়।
অত্তদত্থং পরত্থেন বহুনাপি ন হাপযে,
অত্তদত্থমভিঞ্ঞায সদত্থপসুতো সিযা।
অর্থাৎ, বহু পরার্থের প্রয়োজনেও স্বীয় পরমার্থ বিনষ্ট করবে না; আত্মহিত পরিজ্ঞাত হয়ে পরমার্থসাধনে তৎপর থাকা সকলের উচিত। -ধর্মপদ ১৬৬
আমরা যখন উড়োজাহাজ যোগে ভ্রমণ করি তখন বেশ কিছু সতর্কীকরণ নির্দেশনা আমাদেরকে দেওয়া হয়। তন্মধ্যে একটি নির্দেশনা হচ্ছে, উড়োজাহাজে অক্সিজেনের সমস্যা দেখা দিলে ছাদে রাখা অক্সিজেন মাক্স নিচে নেমে আসবে, আগে নিজের মাক্সটি যথাযথভাবে লাগানো নিশ্চিত করে অতঃপর পাশের জন্যকে সহায়তা করুন। বিষয়টি স্বার্থপরতা নয়, নিজের জীবন সুরক্ষা করা গেলে অন্য অনেকের উপকার করা সম্ভব। মহাকারুণিক বুদ্ধও আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, নিজের কল্যাণ সাধন নিশ্চিত করে অপরের কল্যাণ সাধনে। এতে করে আপনি যেমন আপনার সর্বোচ্চটুকু দিতে পারবেন তেমনি উভয়েই উপকৃত হবেন।
সৎ-কল্যাণমিত্রের সাথে হোক আমাদের বসবাস,
জ্ঞান আর সত্য আহরণে প্রতিমুহুর্ত হোক স্বর্গবাস।