যে সময়ের কথা বলা হইতেছে, তখন জম্বুদ্বীপের নগরদ্বারে ও সভাগৃহে বহুলোক সম্মিলিত হইয়া বিবিধ বিষয়ে আলোচনা করিতেন। এক-এক বারের আলোচনা চারিমাস ব্যাপী চলিতে। তাহাদের মধ্যে একদিন মঙ্গল সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত হইল। মঙ্গল কি? দর্শনে মঙ্গল, না শ্রবণে মঙ্গল, না ঘ্রাণ নেওয়াতে মঙ্গল? মঙ্গল সম্বন্ধে কে ভালরূপে জানেন?

অতঃপর এক দৃষ্টমাঙ্গলিক ব্যাক্তি বলিলেন- “মঙ্গলের বিষয় আমি, জানি, জগতে দর্শনেই মঙ্গল সাধিত হয়। যেমন- যদি কোন ব্যক্তি প্রত্যুষে উঠিয়া পক্ষী, বেণুযষ্টি, গর্ভিনী, সজ্জিত কুমার, পূর্ণকলসী, রোহিত মৎস্য, সৈন্ধব ঘোটক, সৈন্ধব অশ্বেও রথ, বৃষভ, গাভী, কপিলগরু এবং ইহা ছাড়া অন্যান্য বহুবিধ মঙ্গলসম্মত বস্তু দর্শন করে, ইহাতে তাহার মঙ্গল হয়।” তাঁহার কথা কেহ কেহ বিশ্বাস করিলেন, কেহ কেহ বিশ্বাস করিতে পালিলেন না। অবিশ্বাসীরা বিবাদ করিতে লাগিলেন।

অনন্তর এক শ্র“তমাঙ্গলিক বলিলেন-“ওহে, চোখে শুচি-অশুচি, সুন্দর-অসুন্দর, মনোজ্ঞ-অমনোজ্ঞ সবই দেখা যায়। দর্শনে যদি মঙ্গল হইত তাহা হইলে দৃষ্টবস্তু মাত্রই মঙ্গলজনক হইত। কাজেই দর্শনে মঙ্গল হইতে পাওে না। শ্রবণেই মঙ্গ।। যেমন- যদি কোন ব্যক্তি প্রত্যুষে উঠিয়া বৃদ্ধি; বর্ধনশীল, পূর্ণ, স্থূল, সুমন, শ্রী, শ্রীবর্ধন, সুনক্ষত্র, সুমুহূর্ত্ত, শুভদিন, সুমঙ্গল প্রভৃতি নানা প্রকার মঙ্গলসম্মতশব্দ শুনিতে পায়, ইহতে তাহার মঙ্গল হয়। ইহা শ্র“তিমঙ্গল।” তাঁহার কথাও কেহ কেহ বিশ্বাস করিলেন, কেহ কেহ করিলেন না। অবিশ্বাসীরা বাক্-বিতন্ডার সৃষ্টি করিলেন।

অপর এক ব্যক্তি বলিলেন- “শ্রুতি মঙ্গলজনক নহে। শ্রবণশক্তি সাধু-অসাধু মনোজ্ঞ অমনোজ্ঞ শ্রবণ কওে মাত্র। কাজেই শ্রবণের দ্বারাই মঙ্গল হয়। যেমন- যদি কোন ব্যক্তি প্রত্যূষে উঠিযা পদ্ম পুষ্পাদিও গন্ধ পায়, দন্ত মার্জন করে, মাটি স্পর্শ কওে, হরিৎবর্ণ শস্য ও ভিজা গোময় ইত্যাদি স্পর্শ করে, ইহাতে মঙ্গল হয়।” তাঁহার অভিমতও কেহ কেহ গ্রহণ করিলেন, কেহ কেহ করিলেন না। কিন্তু যাঁহারা যে মত গ্রহণ করিলেন তাঁহারা সেইরূপ আচরণ করিতে লাগিলেন। এই প্রকারে মঙ্গলকথা ক্রমে সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়াইয়া পড়িল। তখন জম্বুদ্বীপবাসী বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ স্থানে স্থানে মিলিত হইয়া “কিসে মঙ্গল হয়? এই বিষয় আরও চিন্তা করিতে লাগিলেন। এইভাবে পরস্পরের নিকট শুনিয়া আকাশবাসী দেবতা, চতুর্মহারাজিক, সুদর্শী এবং অকনিষ্ঠবাসী দেবগণও স্থানে স্থানে সম্মিলিত হইয়া মঙ্গলচিন্তা করিতে লাগিলেন। এই প্রকারে দশসহস্র চক্রবালের মধ্যে সর্বত্র মঙ্গলচিন্তা ব্যাপকতর হইল। কিন্তু ত্রিবিধ মঙ্গলের মধ্যে যর্থাথ মঙ্গল কিসে তাহা কেহই ঠিক করিতে পারিলেন না।

দেব-মানবগণ এভাবে মঙ্গলচিন্তা করিতে করিতে বার বৎসর অতিবাহিত করিলন। তবুও প্রকৃত মঙ্গলবিষয় নিধারিত হইল না। অতঃপর তাবতিংস স্বর্গবাসী দেবগণ সম্মিলিত হইয়া এরূপ কথোপথন করিতেছিলেন, “মারিস, গৃহস্বামী যেমন পরিবারের কর্তা, গ্রামের মোড়ল যেমন গ্রামবাসীর কর্তা, সেইরূপ এই শত্র“ দেবরাজ ইন্দ্র আমাদের চেয়েও পুণ্যতেজে ঐশ্বর্যবলে এবং পুণ্যপ্রভাবে অতিশয় শ্রেষ্ঠ। তিনি দুই দেবলোকের অধিপতি, কাজেই আমরা শত্রু দেবরাজকে এই বিষয় জিজ্ঞাসা করিব।” অনন্তর তাঁহারা দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট গিয়া বলিলেন- “প্রভু, বর্তমানে মঙ্গল সম্বন্ধে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে তাহা আপনি জানেন কী? কেহ কেহ বলেন দর্শনে মঙ্গল, কেহ কেহ শ্রবণে মঙ্গল, ঘ্রাণে, অস্বাদনে ও স্পর্শেকরণে মঙ্গল বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিতেছেন। তাহাতে একমত হইতে পারিতেছি না। আপনি যদি প্রকৃত মঙ্গলবিষয় ব্যক্ত করেন বড়ই উত্তম হয়।”

দেবরাজ স্বভাবত প্রজ্ঞাবান। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই মঙ্গলকথা কোথায় উত্থাপিত হইয়াছে অবশ্য আমরা চতুর্মহারাজিক দেবগণের নিকট হইতে শুনিয়াছি বটে, কিন্তু এই প্রশ্ন প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যলোকেই উত্থাপিত হইয়াছে। তথা হইতে ক্রমান্বয়ে এই বিতর্ক দেবলোকে বিস্তার লাভ করিয়াছে।”

অতঃপর ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “সম্প্রতি ভগবান বুদ্ধ কোথায় আছেন?” ‘দেব! তিনি মনুষ্যলোকেই আছেন। তোমরা তাঁহার নিকট গিয়া এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছ কী ? দেব! আমরা কেহই তাঁহাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি নাই।

‘বুদ্ধগণ, তোমরা অগ্নিকে হেয় মনে করিয়া জোনাকীকে বড় মনে করিতেছ! নিখিল জগতের যিনি মঙ্গলদাতা সেই ভগবান বুদ্ধকে অবহেলা করিয়অ আমাকে জিজ্ঞাসা করা উপযুক্তমনে করিয়াছ! বন্ধুগণ, চল ভগবান বুদ্ধের নিকট গিয়া ঐ বিষয় জিজ্ঞাসা করি। তাঁহার নিকটেই ইহার সদুত্তর আমরা পাইব। ইন্দ্র দেবগণকে এভাবে উঃসাহিত করিয়া একজন দেবপুত্রকে আদেশ করিলেন, ‘বৎস, তুমি যাইয়া ভগবান বুদ্ধকে এ বিষয় জিজ্ঞাসা কর।’ দেবপুত্র ইন্দ্রের আদশে দিব্যভূষণে বিভূষিত হইয়া বিদ্যুতের ন্যায় দিব্যজ্যোতি বিচ্ছুরিত করিতে করিতে পরিবৃত দেবগণের সহিত জেতবন বিহারে পৌঁছিয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া একটি গাথায় মঙ্গলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে ভগবান বুদ্ধ দেব-মানবের হিতের জন্য আটত্রিশ প্রকার মঙ্গলবিষয় ব্যাখা করিয়াছিলৈন। সেই আটত্রিশ প্রকার মঙ্গলই এই মঙ্গল সূত্রে উপদিষ্ট হইয়াছে।