1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩, ০২:২৬ পূর্বাহ্ন

মানবপুত্র বুদ্ধ

প্রতিবেদক
  • সময় রবিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৮
  • ১৩০২ পঠিত

আবুল ফজল:

আড়াই হাজার বছর মানুষের ইতিহাসে বেশ সুদীর্ঘ কাল। এত সুদীর্ঘ যে তাকে প্রাগৈতিহাসিক বলা চলে। বুদ্ধ এ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ।

ধর্মের সঙ্গে যাঁদের জীবন ও ব্যক্তিত্ব একাত্ম হয়ে গিয়েছে, তাঁদের সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলেই তুলনার লোভ এড়াতে পারে না কেউই। অথচ বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ ও ভিন্নতর ঐতিহাসিক প্রয়োজনে মহাপুরুষ তথা বিরাট ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে থাকে। তুলনা যাঁরা করেন তাঁরা দেশ-কাল-পাত্রের এ দুস্তর ব্যবধান প্রায় ভুলে যান! যে কোন ব্যক্তিত্বের মূল্য বিচারের জন্য নির্ভুল ঐতিহাসিক বোধের অভাব ঘটলে লেখা ও বলা আবেগসর্বস্ব হতে বাধ্য। বুদ্ধি ও বিচারহীন অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যুগে যুগে বহু অনর্থের কারণ হয়েছে।

বর্তমান যুগকে আমরা বৈজ্ঞানিক যুগ বলি। বিজ্ঞানকে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক জীবনে স্বীকার করে নিয়েছি। অথচ ভাব ও আবেগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে আমরা কোন আমলই দিই না। বিশেষতঃ ধর্ম সম্পর্কীয় ব্যাপারে আমরা দিবান্ধ বল্লেই চলে। অনেকেই হয়ে পড়ি আবেগের স্রোতে ভাসমান তৃণখণ্ড মাত্র।

গৌতম বুদ্ধ মানুষ ছিলেন। এ সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে তিনি বেঁচে আছেন মানুষের ধ্যান-ধারণা ও মানসে নিছক মানুষ হিসেবে। কারণ মানুষের অতিরিক্ত কোন দাবী তাঁর ছিল না। তিনি অবতার ছিলেন না, ঈশ্বরের পুত্রও না__ নবী বা ঈশ্বরের বাণীবাহক বিশেষ দূতও ছিলেন না। তাঁর সাফল্য ও সাধনার জন্য কোন অ-পৌরুষেয় শক্তির মুখাপেক্ষী তিনি হননি, নির্ভর করেননি কোন রকম অলৌকিকতার উপর। এখানেই তাঁর গৌরব ___এখানেই এ মানবপুত্রের মহিমা। এ দিক দিয়ে আধুনিক মানুষের কাছেও তিনি সর্বাধুনিকতার আদর্শ।

প্রাচীন মানুষ ও প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশেষ লক্ষণ___ রূপকের ব্যাপক ব্যবহার। জীবন ও জ্ঞানের যে-কোন গভীর তত্ত্ব ও তথ্য বুঝতে ও বোঝাতে তখনকার যুগে পদে পদে রূপকের আশ্রয় নেওয়া হত। তাই বাইবেল, কোরাণ, বেদ-বেদান্ত সর্বত্রই আমরা রূপকের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। বুদ্ধের জীবন ও বৌদ্ধ সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং অধিকতর প্রাচীন বলে এসবে রূপকের ব্যবহার অত্যধিক লক্ষ্যগোচর। ধর্ম-প্রবর্তক ও ধর্মগ্রন্থ আলোচনার সময় এসব রূপককে রূপক হিসেবে না নিয়ে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে বিড়ম্বিত হতে হয়। এ বিড়ম্বনা আমাদের। জীবনে বহু অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে। এরই ফলে ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা পেয়েছে ব্যাপক প্রশ্রয়__সব দেশে, সব যুগে ও সব সম্প্রদায়ে।

মহাপুরুষের প্রতি যত বেশি অলৌকিকতার আরোপ আমরা করব তত বেশি তিনি আমাদের পর হয়ে যাবেন। তাঁকে গ্রহণ না করার ফন্দি হিসেবে এটা মন্দ উপায় নয়, কিন্তু নিজেরা থেকে যাব বঞ্চিত। আলোর স্বরূপ বুঝতে হলে চন্দ্র-সূর্যের দিকে চোখ খুলে তাকাতে হয়। মহাপুরুষেরাও চন্দ্র-সূর্যের মত___তাঁদের বুঝতে হলে বুদ্ধির চোখ খোলা রাখতে হয়। ভাবাবেগে অভিভূত হলে মহাপুরুষদের স্বরূপ উপলব্ধি ও সত্য পরিচয় লাভে বিঘ্ন ঘটে। একমাত্র মুক্তবুদ্ধি মানুষেরাই মহাপুরুষদের বুঝতে পারেন, গ্রহণ করতে পারেন। তাঁরাই রূপককে পেরিয়ে পৌঁছতে পারেন রূপে, অলৌকিকতার আবরণ ভেদ করে সন্ধান পান লৌকিকের। বুদ্ধ সম্বন্ধে এটি অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ তিনি নিজেই এ পথ রেখেছেন খোলা। তাঁকে মানুষ হিসেবে বুঝতে ও গ্রহণ করতে কোন রকম শাস্ত্রীয় অনুশাসন ও সংস্কারকে ডিঙোবার দুঃসাহসের প্রয়োজন হয় না। সহজাত বুদ্ধি দিয়েই তাঁকে গ্রহণ করা যায়।

অন্ধভক্তির আতিশয্যই ভক্ত ও ভক্তিভাজনের মাঝখানে নানা অলৌকিকতার কৃত্রিম অথচ দুর্ভেদ্য আবরণ রচনা করে। অন্ধভক্তির হাত থেকে বুদ্ধও নিষ্কৃতি পান নি। বলা বাহুল্য পরবর্তীকালে তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করেও বহু কিম্বদন্তী গড়ে উঠেছে। অতিভক্তি বা অন্ধভক্তি বাস্তব ও যুক্তি নিয়ে তৃপ্তি পায় না। তাই সে রচউচনা করে অবাস্তব ও অযৌক্তিক কল্পনারা বিচিত্র মায়াজাল। এসব না হলে সাধারণ মানুষের মন ও মানস খোরাক পায় না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের মত বৌদ্ধরাও এ খোরাক যথেষ্ট পরিমাণে যোগান দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও মানব-পুত্র বুদ্ধ এ সবের নীচে বিশেষ চাপা পড়েন নি। তাঁর জীবন ও বাণীর লক্ষ্য ও পরিধি পরিপূর্ণভাবে মানুষ ও মনুষ্যত্ব এবং মানুষের মনোভূমি।

আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে ক্ষুদ্র লুম্বিনীকাননে এক সামন্ত পরিবারে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল তিনি সর্বোতভাবে মানব-পুত্রই ছিলেন। সেই দূর অতীতে তিনি যে শুধু সামন্ততন্ত্রের মায়া কাটিয়েছিলেন তা নয়, জীবনের বহু সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়াসের লোভও জয় করেছিলেন। মানুষের শোক-দুঃখে তিনি যে কঠোর ও সুদীর্ঘ সাধনায় লিপ্ত হয়েছিলেন তারও রূপ ও রূপায়ণ ছিল মানবিক। আশ্চর্য, তাঁর সাধনালব্ধ শিক্ষা ও বাণী প্রচারের জন্য তিনি স্বর্গের প্রলোভন ও নরকের ভীতি___এ দুই আশু-ফলপ্রদ ও সহজ অস্ত্রের প্রয়োগ করেননি কখনো। মানবসভ্যতা ও মানব-বুদ্ধির সেই শৈশবকালে এ প্রলোভন জয় করাও কম কথা নয়। মানুষের মধ্যে যেটুকু জন্তুভাব আছে তা দূরর করে মনুষ্যত্বের উদ্বোধনের জন্য তিনি যে পথ বাৎলিয়েছেন তাতে দৈববশক্তির কোন দোহাই নেই এবং সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছরেও তা কিছুমাত্র ম্লান হয়নি এবং দিন দিনই তার সত্য উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এখানেই তাঁর মহামানবত্ব।

আড়াই হাজার বছর পরেও এ মানব-পুত্রকে আমরা আবার স্মরণ করছি। একদিন মানবতার যে মহাসমুদ্রেরর সন্ধান তিনি মানুষকে দিয়েছিলেন, সেই মহাসমুদ্রের হাওয়া আবার দিকে দিকে বয়ে যাক__ তার ফলে দুনিয়া থেকে চিরতরে দূর হোক ধর্ম-সম্প্রদায়, দেশ ও জাতিগত বিদ্বেষ। তা হলেই এ মানব-পুত্র মহামানবের স্মরণোৎসব পালন সার্থক হবে।

লেখক: আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!