পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
এবং বাংলাদেশে সংস্কৃত ও পালি বোর্ডের আধুনিকায়ন প্রসঙ্গ
ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী:
বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আদি শিক্ষা অর্থাৎ টোল শিক্ষা প্রথা এখন সম্পূর্নরূপে বিলুপ্ত। বৌদ্ধ ছেলে-মেয়েরা এই শিক্ষা থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত হওয়ার কারনেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম চর্চা বিঘ্নিত হচ্ছে ও সঠিক দিক নির্দেশনা হারাচ্ছে। এক্ষেত্রে পালি ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানের জন্য সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এর জন্য পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষাবোর্ড গঠন করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সরকারকে আলাদাভাবে মাদ্রাসা বোর্ডের ন্যায় পালি শিক্ষা বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। আর যদি তা না হয়, তবে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি বোর্ডের আধুনিকায়ন করা আবশ্যক। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীন দেশে এখনো পাকিস্তানি আমলের নিয়মে চলছে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি বোর্ড এবং বোর্ডের অধীন প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন পাকিস্তান আমলের নিয়মে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মাত্র ১৪৯ টাকায় এ বোর্ডের অধীন কর্মরত শিক্ষকরা চাকরি করে আসছেন বছরের পর বছর। সেই বেতন আবার প্রতি মাসে নয়, পান বছর শেষে।
সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ১২৯টি সংস্কৃত ও ৯৩টি পালি কলেজ রয়েছে। এসব কলেজে একজন অধ্যক্ষ, দুজন শিক্ষক ও একজন করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থাকেন। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকেরা একই পরিমাণ মাত্র ১৪৯ টাকা বেতন পান। আর কর্মচারীদের মাসিক বেতন ৫০ টাকা। এ অমানবিক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দেনদরবার আর আবেদন-নিবেদনের ইয়ত্তা নেই। এ পেশার অনেক গুণী শিক্ষকের উপস্থিতির অভাবে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় অনুষ্ঠান সমূহের শুরুই সম্ভব হয় না। এক বছর দুই বছর নয়, যুগের পর যুগ ধরে নীরবভাবে অবিচল চিত্তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন হাজার হাজার শিক্ষক। মান-অভিমান ভুলে সরকারি দয়িত্বেও জোগান দিচ্ছেন সমভাবে। অথচ এই বেতন দিয়ে বর্তমানে দৈনিক একবেলা চা-নাস্তা খাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমপর্যায়ের সিলেবাসে পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন ৫৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৫০০০ টাকায় উন্নীত হলেও ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি সংস্কৃত ও পালি বোর্ডের অধীন কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের। বোর্ডের চেয়ারম্যান মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি ফাহিমা খাতুন তিনি দেশের লাখ লাখ শিক্ষকের ঊন্নীত বেতন-ভাতার দেখভাল করেন অথচ এ বোর্ডের শিক্ষক কর্মচারীদের অমানবিক বেতন-ভাতার চিত্রও তার চোখে অবলোকেন করেন। একবারও কি তার চোখে এ ব্যবধানটি ধরা পড়েনি। তেলওয়ালা মাথায় তেল দেয়া আজ আমাদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বোর্ডের সচিব নিরঞ্জন চক্রবর্তী জানালেন অনেক অজানা বিস্ময়কর কাহিনী। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা যেমন অমানবিক এবং নির্মম, তেমনি বোর্ডটি চলছে অযত্ন-অবহেলয় দুই কক্ষের একটি অস্বাস্থ্যকর ভাড়া ঘরে। এ বোর্ডের অনেক সজ্জন ও সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সনাতন ধর্মের নামজাদা ব্যক্তিরা শোভাবর্ধন করে চললেও বোর্ড ও শিক্ষকের শোভাবর্ধনে এরা ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়ে উঠছেন না। আর কতকাল এতজন শিক্ষক এ তিমিরেই অবস্থান করবেন কে জানে?
প্রত্যেক দেশে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য তাদের নিজস্ব বর্ণমালা বা ভাষাতেই লিখিত থাকে। এসব বর্ণমালা বা ভাষা না জানলে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সহজভাবে জানা কখনও সম্ভব নয়। পালিও সেরকম একটি প্রাচীন ভাষা, যে ভাষাতে পালি ত্রিপিটক লিখিত হয়েছে। এই প্রাচীন ভাষাগুলোকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখতে এবং বৌদ্ধদেরকে পালি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা সুশিক্ষিত করে তুলতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে বৌদ্ধ ধর্মীয় শীর্ষ নেতাদের ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।