পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহিদ আব্বাসি ১২ ডিসেম্বর ‘পাকিস্তান সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সিবিশন’ উদ্বোধনকালে ভিডিও বক্তৃতায় একটি আকূল আবেদন জানিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানকে এড়িয়ে না যেতে এবং পাশ্চাত্য মিডিয়ার চিত্রিত ভাবমূর্তিতে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শ্রীলংকার ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
আব্বাসি বলেন, ‘সিএনএনে যা দেখেন, আসল পাকিস্তান তা নয়। আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছি, আমরা শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি, আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বিশাল অগ্রগতি হাসিল করেছি।’
আব্বাসি যা বলতে চাচ্ছিলেন, তা সহজেই বোঝা যায়। পাকিস্তান এখন তার আরেকটি দিক থেকে তার ভাবমূর্তি উন্নত করতে চাইছে। তা তারা করতে চায় গান্ধারা আর্ট হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধ ঐতিহ্য আবিষ্কার, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনীর আয়োজনের মাধ্যমে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই চলতি মাসের প্রথম দিকে শ্রীলংকার রাজধানীতে আয়োজন করা হয় ‘সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সিবিশন’। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে এ ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে পাকিস্তান।
গান্ধারা বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলোর প্রতিলিপি প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা না হলেও গান্ধারা শিল্পকলার ওপর সুলিখিত ও চমৎকারভাবে ছাপানো কফি টেবিল বুক, ডিভিডি দিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের এ দিকে নজর ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।
কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের বৌদ্ধ চিত্র দেখার সুযোগ নষ্ট করতে চায়নি বৌদ্ধপ্রধান দেশ শ্রীলংকার লোকজন। তাই তারা প্রদর্শনীতে ব্যাপকভাবে ভিড় করে। এই প্রথমবারের মতো শ্রীলংকায় পাকিস্তানি বৌদ্ধ স্মারক প্রদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পাকিস্তান তার গৌরবজ্জ্বল প্রাক-ইসলামিক অতীত সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে বেশ আগ্রহী। এসবের মধ্যে রয়েছে মহেনজোদারো, তক্সশিলার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, গান্ধারা শিল্প ও বৌদ্ধ স্তুপ।
গান্ধারা শিল্প
বর্তমানে পাকিস্তানের ৯৫ ভাগ লোক মুসলিম। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে ১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমানে পাকিস্তান হিসেবে অভিহিত এলাকাটিতে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল প্রসার। সেখানে যে বৌদ্ধ শিল্পের জন্ম হয়েছিল, সেটিকে বলা হয় গান্ধারা আর্ট। এই শিল্পের আবাসভূমি হলো উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান তথা পেশোয়ার উপত্যকা থেকে কাবুল ও সোয়াত নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা।
প্রাচীনকালে গান্ধারা অঞ্চলটি ছিল ভারতবর্ষ, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যকার বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্মিলন স্থল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ট ও ৫ম শতকে স্থানটি ছিল আচেমেনিয়ান পারসিয়ার অন্তর্গত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডার দি গ্রেট তা জয় করেন। এরপর ভারতের মৌর্য রাজবংশ হয় এর শাসক। এই আমলেই আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে।
গান্ধারা পর্যায়ক্রমে ইন্দো-গ্রিক, শক্য, পার্থিয়ান ও কুশানদের মাধ্যমে শাসিত হয়। ১১ শতকে গজনির মাহমুদ জয় করার পর বিভিন্ন রাজবংশ এর শাসনভার গ্রহণ করে।
তক্সশিলা ও পেশোয়ার তখন ছিল গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে ৬ষ্ট-৭ম শতক পর্যন্ত গান্ধারা ছিল ভারতীয় বৌদ্ধ ও গ্রেকো-রোমান প্রভাবের মিশ্রণ। গান্ধারা শিল্পের মূলধারা ছিল বৌদ্ধ ও বোধিসত্তার চিত্রণ।
সময় ও নানা বৈরি অবস্থার মধ্যেও অনেক ভাস্কর্য এখনো টিকে রয়েছে। তারাই এখন ওই সময়ের বৌদ্ধ সমৃদ্ধির কথা বলছে।
পাকিস্তানি প্রত্মতত্ত্ববিদেরা ২০১৬ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত জেলার ভামালায় প্রাচীন একটি বৌদ্ধ স্থান আবিষ্কার করে। এখানে ‘ঘুমন্ত বৌদ্ধ’ মূর্তি পাওয়া যায়। এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের। এটিই বিশ্বের প্রাচীনতম ঘুমন্ত বৌদ্ধ মূর্তি।
এই আবিষ্কারের কথা শুনে খাইবার পাখতুনখাওয়ার নেতা ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খান মন্তব্য করেছিলেন, এটি হলো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশবিশেষ। লোকজন এখানে ধর্মীয় পর্যটনে আসবে, তারা এসব স্থান দেখবে। পাকিস্তানের বেশির ভাগ লোক চায় এসব স্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।
পাকিস্তান সরকারই নয়, পাকিস্তানের বিভিন্ন মানুষও ব্যক্তি এখন বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে মনোযোগ দিচ্ছে। নানাভাবে এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসছে। তবে এই হারটি খুব বেশি নয়।