নশ্বর সুজয়:
শুধু বুদ্ধের সময়কালীন ব্রাম্মণরাই এমনটা ছিল তা নয়, বর্তমানেও বড়ুয়া তথা বৌদ্ধসমাজে গোত্রবাদ ও গুরুবাদের প্রভাব খুবই প্রকট। শুধু গৃহীসমাজ নয় সংসারত্যাগী ভিক্ষুরাইও তা অতিক্রম করতে অনেকাংশে পারেনি। এই গুরুবাদকে কেন্দ্র করে অতীতেও বৌদ্ধরাই নানান বাদে বিভাজিত হয়েছিল ;শাসনবংশ গ্রন্থে তা দৃষ্ট হয়। বর্তমানেও বাংলার বৌদ্ধরাই ক্রমাগত সেই পথে। বর্তমানের বৌদ্ধরা অতীতের তুলনায় ধর্মচর্চায় অনেকাংশে আগুয়ান। তবে এটাও ঠিক যে তা নাম-যশ প্রত্যাশী বিজ্ঞাপণ ভিত্তিক। অতীতে এমনটা মোটেও ছিল না। কি ভিক্ষু কি দায়ক সবাই নাম বিজ্ঞাপনের জন্যে নতুন নতুন কৌশলী। বুদ্ধের ভাষায়-
মমেব কতমঞ্ঞন্তু গিহী পব্বজিতা উভো,
মমোবাতিবসা অস্সু কিচ্চাকিচ্চেসু কিস্মিচি;
ইসি বালস্স সঙ্কপ্পো ইচ্ছা মানো চ বড্ঢতি। (৫ঃ৭৪ ধর্মপদ)
(গৃহী ও প্রব্রজিত উভয়ে আমার অনুগত ও বশবর্তী হউক এরূপ কামনায় মূর্খের আকাঙ্ক্ষা ও অভিমান বৃদ্ধি পায়।)
আমাদের সমাজ আজ বাবু গিরি ও নাম -যশের বন্যায় কবলিত। যারা ভাল করে পঞ্চশীল প্রার্থনাও জানে না তারা ২২৭শীল ধারী ভিক্ষুদের পরিচালনা করছে। আবার যারা নিজের ছেলে-মেয়েদেরকে মন্দিরে যাওয়া, দান-ধর্মে পূণ্যকমর্ে নিরুৎসাহিত করে তারাই আজ সমাজপতি, সমাজসেবক, ধমর্ীয় আলোচক আরো কতশত নানা উপাধিতে ভূষিত। ঠিক অনুরূপ ভাবেই ভিক্ষু সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে কিছু কিছু ভিক্ষুও তাদের নামের আগে কয়েক লাইন গুণকীর্তনীয় উপাধিতে সজ্জিত রাখে। আমি মেনে নিলাম যে দায়করা হয়তো শ্রদ্ধার বশে ভিক্ষুদেরকে এমন উপাধি দিয়ে সম্বোধন করে। এক্ষেত্রে ভিক্ষুদেরই উচিত মিথ্যা আবরণে না জড়ানো এবং এর প্রতিবাদ করা।
বুদ্ধের অগনিত ভিক্ষু শিষ্যদের মধ্যে মাত্র ৮০জন ভিক্ষুশিষ্যই তাদের স্বীয় স্বীয় গুণে অগ্র বা শ্রেষ্ঠ উপাধি গুলো পেয়েছিল। তাও স্বয়ং বুদ্ধ প্রদত্ত । (থের গাথা )
অথচ বর্তমানে একজনই ধারন করছে সে ৮০টি উপাধি। যেগুলির অর্থ বা ব্যাখ্যা এতটাই গুরুগম্ভীর যে গুপ্তযুগের দিগ্বিজয়ী বিদগ্ধ মহাপণ্ডিত অনুবুদ্ধ অভিধা মণ্ডিত পালি সাহিত্যজ্ঞ ও অট্ঠকথাজ্ঞ বুদ্ধঘোষ মহোদয়ও হিমসিম হওয়ার মত।
আসলেই শ্রেষ্ঠ কে!?
ব্রাম্মণ ও বুদ্ধের কথোপকথন —
ব্রাম্মণ – আমি জন্ম হতেই শ্রেষ্ঠ।
বুদ্ধ – কিরূপে?
ব্রাম্মণ – যেহেতু আমি ব্রাম্মণ গোত্রে জাত এবং আমি একজন ব্রাম্মণ।
বুদ্ধ -অতীবই উত্তম! আচ্ছা ব্রাম্মণ ! আপনাদের ব্রাম্মণগোত্রে মহিলারা ঋতুবতী হয় !
ব্রাম্মণ – হ্যা ঋতুবতী হয় ।
বুদ্ধ – আচ্ছা! অন্যান্য পরিবার বা গোত্রের মহিলাদের ন্যায় তারাও কি গর্ভবতী হয় ?
ব্রাম্মণ – হ্যা অনুরূপ নিয়মেই হয়।
বুদ্ধ – আচ্ছা! আপনাদের ব্রাম্মণগোত্রীয় মহিলারাও কি ঐ নিয়মে সন্তান প্রসব করে যে নিয়মে অন্যসব মহিলারা করে?
ব্রাম্মণ – হ্যা নিশ্চয়ই।
বুদ্ধ – তারাও কি অন্যদের ন্যায় সন্তান প্রসবযন্ত্রণা ভোগ করে?
ব্রাম্মণ – হ্যা!! প্রসবযন্ত্রণাও ভোগ করে ।
বুদ্ধ – ঋতুবতী হওয়া, গর্ভকাল, গর্ভব্যবস্থা, প্রসব নিয়ম সবই যদি অন্যান্য গোত্রিয় মহিলাদের মতোই হয় তাহলে ব্রাম্মণ! কোন বিষয়ে আপনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করেন। কোন আধারেরই আপনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যা দিচ্ছেন?
অতঃপর ব্রাম্মণ অবনত হয়ে বুদ্ধকে বললেন-আজ আপনি আমার দৄষ্টি খোলে দিয়েছেন। এতকাল ভ্রান্তিতে ছিলাম। আজ আমার অহংকার চূর্ণ হয়েছে। জন্ম বা বংশ বা গোত্রে কেউ শ্রেষ্ঠ হতে পারেনা। কর্মেই হীন বা শ্রেষ্ঠ হওয়ার একমাত্র আধার।
খুব ভালো লাগলো