আসল নাম ননীবালা বড়ুয়া, জন্ম ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ, চট্টগ্রামে। লেখাপড়াটা এগোয়নি, ১২ বছর বয়সেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বর রজনী বড়ুয়া, চট্টগ্রামেই বাড়ি। কিন্তু প্রকৌশল কাজে বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থাকতেন। স্বামীর সঙ্গে ননীবালাকেও পাড়ি জমাতে হয় সেখানে। বিয়ের মোটে ছয় বছর-মারা যান ননীর মা। দেড় বছরের ছোট ভাই বিজয় বড়ুয়ার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। ঘরকন্নায় দিন কাটে। ৩৫ বছর বয়সে কোলজুড়ে আসে ছোট্ট এক মেয়ে। কিন্তু সুখ যে কপালে নেই। তিন মাস বয়সেই মেয়েটি মারা যায়। প্রথম সন্তানের মৃত্যুর দুঃখে মন খুবই চঞ্চল হয়ে ওঠে। ননীবালার ৩৯ বছর বয়সে জন্ম নেয় দীপা। আর এই থেকেই সবাই তাঁকে ডাকে দীপার মা। শেষে এই নামের কারণে আসল নামটি ধীরে ধীরে আড়াল পড়ে যায়।
দীপার জন্মের দুই বছর পর এবার ছেলের মা হন ননীবালা। কিন্তু জন্মের কিছুদিন পরই ছেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পুত্রশোকে কাতর হন মা। ১৯৫৭ সাল, আরো একটি বড় আঘাত। এবার ওপারে চলে যান স্বামী। এক বছরের মধ্যে স্বামী ও পুত্রকে হারিয়ে সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে মা যেন শোকের সাগরে ভাসেন। রোগে-শোকে একেবারে চলাচলও বন্ধ হওয়ার অবস্থা। হাঁটার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন অনেকটা। একদিন ডাক্তার তাঁকে বললেন, আপনি যদি মানসিক অবস্থার উন্নতি না ঘটান তবে মারা যাবেন।
সে সময় চট্টগ্রাম থেকে ধ্যানশিক্ষার জন্য বার্মায় গিয়েছিলেন অনাগারিক মুনিন্দ্রজী। সেখানকার চট্টগ্রামবাসী বড়ুয়া সম্প্রদায়ের কাছে জানতে পারেন দীপার মা মানে ননীবালার কথা। সব শুনে তিনি দীপার মাকে দেখতে যান। তিনি তাঁকে অনুরোধ করলেন সেখানকার মহাসী সেয়াড বৌদ্ধবিহারে যেতে। সেখানে গেলে তাঁর দুরবস্থা লাঘব হতে পারে। মুনিন্দ্রজীর কথা রাখলেন দীপার মা। যথাক্রমে মুনিন্দ্রজী ও মহাসী সেয়াডর কাছে বিদর্শন ভাবনা (বৌদ্ধদের সাধনপদ্ধতি) শিক্ষা নিলেন। তিনি ধ্যান-সমাধিতে নিজেকে প্রশান্তিতে মনোনিবেশ করলেন। ধীরে ধীরে মনকে শান্ত করতে পারলেন। এরপর সেখান থেকে চলে গেলেন ভারত। ভারতে একজন প্রতিবেশীকে ধ্যানচর্চা শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া শুরু। এরপর দেশ-বিদেশের অনেক শিক্ষার্থী জুটে যায়। ইউরোপ-আমেরিকার অনেকে তাঁর কাছ থেকে ধ্যানশিক্ষা লাভ করেন।
এই প্রাচ্যে ড. রাষ্ট্রপাল মহাথের দীপার মায়ের বড় শিষ্য। রাষ্ট্রপাল মহাথের ১৯৬৯ সালে পিএইচডি করার পর বিদর্শন ভাবনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যোগ্য গুরুর সন্ধানে ভারত-বার্মার বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করছিলেন। এরই মধ্যে বাংলার খ্যাতনামা বিদর্শনাচার্য্য অনাগারিক মুনিন্দ্রজীর মাধ্যমে তিনি বিদর্শনাচার্য্যা দীপা-মা-র সঙ্গে পরিচিত হন। উল্লেখ্য, এর আগে ড. মহাথের বার্মার বিশ্ববিখ্যাত বিদর্শনাচার্য্য মহাসী সেয়াডসহ পাঁচজনের সান্নিধ্যে বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন করলেও বিদর্শনাচার্য্যা ননীবালা বড়ুয়ার পরিচালিত প্রশিক্ষণে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন বলে অকপটে স্বীকার করতেন। তবে বলতে গেলে ড. রাষ্ট্রপাল মহাথের দীপা-মাকে গুরু বলে দেশ-বিদেশে প্রচার করায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। ডক্টরেট করার পর রাষ্ট্রপাল যখন একজন প্রায়-নিরক্ষর মহিলার কাছে ধ্যান প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁকে গুরু বলে প্রচার করছেন, তখন অনেক ভিক্ষু ও গৃহীরা কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। ড. মহাথের আন্তর্জাতিক সাধনাকেন্দ্র-বুদ্ধগয়ায় ননীবালা বড়ুয়ার ৭৭তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন ও ‘বিদর্শনাচার্য্য ননীবালা বড়ুয়া-দীপা-মা’ নামে একটি বই রচনা করেন। বর্তমান বিশ্বে অনেক মেডিটেশন শিক্ষকই দীপা-মা-র শিষ্য। তিনি ইংরেজি জানতেন না, বাংলায় সব কিছু বলে দিতেন আর অন্য একজন সেটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতেন। অনেকেই তাঁর বিদর্শন ভাবনায় বিশদ জ্ঞান লাভ করে তাদের জীবনদর্শন পরিচালিত করছে। তিনি গত হন ১৯৮৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। যাঁর নামে ননীবালা বড়ুয়া দীপার মা হিসেবে পরিচিত, সেই দীপাও এখন মেডিটেশনের শিক্ষক। তিনি বর্তমানে ভারতে আছেন।
দীপা-মা বলে গেছেন –
* তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ। স্বামী-সন্তান হারানোর পর আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম এবং রোগে পড়েছিলাম। ঠিকমতো হাঁটতে পর্যন্ত পারতাম না। কিন্তু এখন দেখো, আমাকে কী দেখতে পাচ্ছ? আমার সব রোগ চলে গেছে। আমি একেবারে নতুন জীবন পেয়েছি এবং সেসব কিছুই মনে নেই আমার। কোনো দুঃখ নেই, যন্ত্রণা নেই। তুমি যদি মেডিটেশন করো, তুমিও সুখী হবে। বিপাস্সনে (প্রাচীন ভারতের একটি সাধনপদ্ধতি) কোনো জাদু নেই, তুমি শুধু অনুসরণ করো।
* প্রতিদিন ধ্যান করো। এখনই করো। পরে করবে এমনটি ভেবো না।
* পুরুষদের তুলনায় মহিলারা দ্রুত ভাবনায় মনোনিবেশ করতে পারে, কারণ মহিলাদের মনটা স্বভাবত কোমল-নরম প্রকৃতির।
* মনকে মুক্ত করে দাও। তোমার মনেই সব আছে।
* মেডিটেশন হলো পরিভ্রমণ। এটি সবাইকে পরিপূর্ণ করে।
গুরু অনাগারিক মুনিন্দ্রজী –
অনাগারিক মুনিন্দ্রজীর সঙ্গে দীপা-মার পরিচয় মিয়ানমারে। তাঁর কাছ থেকেই ধ্যান শিখেছিলেন দীপা-মা। বিদর্শন ভাবনায় জ্ঞান লাভ করে কিভাবে রোগশোক থেকে মুক্তি পেতে হয় সেগুলোই প্রিয় শিষ্যকে শিখিয়েছিলেন গুরু। ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বৌদ্ধগয়ায় ছাত্রদের ধর্মশিক্ষা ও ধ্যান প্রশিক্ষণ করিয়েছেন। বুদ্ধের বাণী প্রচারে ভ্রমণ করেছেন কয়েকটি দেশ।
* বিশ্বখ্যাত শিষ্য
ড. রাষ্ট্রপাল মহাথের – তিনি দীপা-মাকে গুরু বলে দেশ-বিদেশে প্রচার করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাড়িয়ে দেন। তিনি বিশ্ব বৌদ্ধদের প্রাণকেন্দ্র বুদ্ধগয়ায় আন্তর্জাতিক সাধনাকেন্দ্রে ‘বিদর্শনাচার্য্যা ননীবালা বড়ুয়া ভবন’ নামে একটি ভবনের নামকরণ করেন।
জোসেফ গোল্ডস্টাইন – আমেরিকায় তিনিই প্রথম ‘বিপাস্সনা’ শিক্ষক। ইনসাইট মেডিটেশন সোসাইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা। সমকালীন বুদ্ধবাদের ওপর লেখা তাঁর বইও আছে।
জ্যাক কর্নফিল্ড – আমেরিকান লেখক ও শিক্ষক। আমেরিকায় ‘বিপাস্সনা’ আন্দোলন ‘থেরাভাদা বুদ্ধিজম’-এর অন্যতম ব্যক্তি। তিনি থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভারত ঘুরে বুদ্ধিজমের ওপর ধ্যানচর্চা করেছেন।
শ্যারন সাল্জবার্গ – নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লেখক। প্রাশ্চাতে বুড্ডিস্ট মেডিটেশন চর্চাকারী হিসেবে খ্যাতি আছে। তিনিও ইনসাইট মেডিটেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ।