জিতু চৌধুরী:
সামন্ত যুগের বংশ গৌরবের অধিকারী পূর্ণচন্দ্র সামন্ত রাজা ও সুবর্ণ চন্দ্র সামন্ত রাজা, পরবর্তীতে ধুংশাং চৌধূরী (জমিদার) বংশের গৌরবের অধিপতি ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ১৮৮৩ সালে চট্টগ্রাম জেলায়, পটিয়া উপজেলায় কতালা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন । বাল্যকালে কতালা মধ্য স্কুলের পাঠ শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয় ভর্ত্তি হন তৎকালীন বেসরকারী ন্যাশন্যাল মেডিকেল স্কুলে । চার বছর এল. এম. এফ কোর্স সমাপ্ত করে বাড়ীতে এতে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন । ব্যবসায় প্রচুর সুখ্যাতি, সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হন । পাচঁরিয়া গ্রামের স্বনামধন্য কবিরাজ প্রসন্ন কুমার বড়ুয়ার কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । বিয়ের পর ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী কিছু দিন গ্রামে থাকার পর চিকিৎসা ব্যবসা উন্নতির জন্য ১৯১৪ সালে রেঙ্গুন গমন করেন । বৃট্রিশ শাসিত ব্রহ্মদেশ সরকারের অধীনে রেঙ্গুন সেন্ট্রাল কারাগারে জেল ডাক্তারের পদে নিযুক্ত হন । সেখানে কয়েক বৎসর চাকুরী করার পর পদত্যাগ করেন । কান্দুগ্রে উপশহরে ডিসপেনসারি করে স্বাধীন ভাবে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন ।
জীবন জীবিকার জন্য রেঙ্গুনে বহু বাঙ্গালী বৌদ্ধ অবস্থান করতো । প্রবাসী বাঙ্গালী বৌদ্ধরা ধর্মীয় উৎসবাদি প্রতিপালনের সুবিধার্থে ১৯০২ সালে বাঙ্গালী ভিক্ষু প্রজ্ঞাতিষ্য মহাস্থবির (১৮৭১-১৯৩২) এর নেতৃত্বে “রেঙ্গুন ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহার” প্রতিষ্ঠা করেন । একই বছরে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উৎসবাদি, বিহারের ভিক্ষু শ্রামনদের ভরন-পোষন, বিহার রক্ষনা-বেক্ষন ও নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য ভাব বৃদ্ধির জন্য “চট্টল বৌদ্ধ সমিতি” বা “চিটাগাং বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশন গঠন করা হয় । ১৯১৮ সালে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে রেঙ্গুন ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহার বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।
সেই ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহার ও চট্টল বৌদ্ধ সমিতি সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ।
১৯২১ সালে বাল্যকাল হতে অগগমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির(১৮৭৯-১৯৭১) ধ্যান ধারনার প্রতি ছিল প্রবল শ্রদ্ধা । আরাকান অন্তগত চেরিপৌক্ত নামক নির্জন প্রদেশ পাহাড়ে ক্রমাগত ১ বছর ধ্যানসমাধির অনুশীলনে রত ছিলেন । এহেন সুর্বন সুযোগে ৮ম সংঘরাজ শীলালংকার মহাস্থবির(১৯০০-
২০০০) ১৯২১ সালে ফ্রেব্রুয়ারী মাসে বৃহস্পতিবার পূন্যতীর্থে তার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয় । পবিত্র প্রব্রজা ধর্মে তার দীক্ষা লাভে সৌভাগ্য ঘটে । ১৯২১ সালের ডিসেম্ভর মাসে তিনি তার প্রধান শিষ্য বিমল কান্তি স্থবিরকে আকিয়াব বিহারে রেখে রেঙ্গুন ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহারের অভিমুখে যাত্রা করেন । রেঙ্গুন প্রবাসী বাঙ্গালী বৌদ্ধগন ও চট্টল বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কত্তালা নিবাসী ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী আন্তরিক প্রার্থনায়, অভ্যর্থনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে রেঙ্গুন ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহারের বিহারধ্যক্ষ ও সমিতির সভাপতির পদ গ্রহন করেন ।
অতপর তিনি বিহারধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহন করে প্রবাসী বৌদ্ধদের অসার আনন্দ ও উৎসাহের নতুন বিহার ভবন নির্মান, বৌদ্ধ মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা ও বহু গ্রন্ত্র বাংলা অনুবাদ করেছেন । ব্রক্ষদেশে বাঙ্গালী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিরাট অবদান রেখে গেছেন । তাহাকে সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করতেন চট্টল বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ।
১৯২৩ সালে চট্টল বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী উচ্চতর আদর্শের চিন্তাধারা নিয়ে কলিকাতায় আগমন করেন । মধ্য কলিকাতায় ৩৩/৯ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডে “চৌধূরী ফার্ম্মেসী” নামে এক ডিসপেনসারী প্রতিষ্ঠা করেন । ডাক্তারী ও কয়েকটি নিজস্ব তৈয়ারী পেটেন্ট ঔষধের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জনের সক্ষম হন । ১৯২৬ সালে কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবিরের মহাপ্রয়ান ও ১৯২৮ সালে সমন পূর্ণানন্দ স্বামী অকাল মৃত্যুতে ঐতির্য্যবাহী কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহার সভা, বঙ্গীয় সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসেসিয়েশন সোচনীয় অবস্থায় পড়ে যায় । ১৯২৮ সালে তৎকালীন ভারত বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধিত্ব মূলক বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ।
উল্লেখ্য, সমন পূর্ণন্দ স্বামী বিহার পরিচালনা ও কঠিন রোগ গ্রস্থ হয়ে ভীষন ভাবে আর্থিক সংকটে পতিত হন । কৃপাশরণ মহাস্থবিরের মহান কীর্ত্তি আন্তজাতিক ভিক্ষু সমাগম ও মহামেলা অনুষ্টানের মাধ্যমে ধর্মাঙ্কুরের পবিত্র ভিক্ষু সীমা প্রতিষ্ঠা করা হয় ঐস্থান সহ সম্পূর্ণ খোলা মাঠ সুষমা সেনগুপ্তা নামের এক ধনী মহিলার কাছে বন্ধক দিয়ে দশ হাজার টাকা ঋন গ্রহন করেন । অন্যদিকে বিহারাধ্যক্ষ্যের পদের অধিকার নিয়ে কতিপয় ভিক্ষুর মধ্যে খুব কেলেষ্কারী শুরু হয় । সুষমা সেন গুপ্তা ঋন আদায়ের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে দিয়েছিলেন । এত বড় অংকের ঋন পরিশোধ করে বিহার ঋনমুক্ত করা তৎকালীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না বললেই চলে । এতে বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন ।
এদিকে ১৯৩০ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ । অগগমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির তিনি তার প্রতিষ্ঠিত রেঙ্গুন বৌদ্ধ মিশন প্রেস, বৌদ্ধ মিশন এবং জাতীয় মুখপত্র সংঘশক্তি পত্রিকার কার্যক্রমকে গতিশীল করার মানসে তার দ্বিতীয় প্রিয় শিষ্য আর্য্য বংশর ভিক্ষুর উপর দায়িত্ব ভার অর্পন করে চাঁদা সংগ্রহের জন্য কর্মযোগী কৃপাশরণ কতৃক ১৮৮২ বৌদ্ধ ধর্মঙ্কুর সভা এবং ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারে গিয়ে উপস্থিত হন । এ সময় প্রজ্ঞালোকের সাথে উক্ত সভায় সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী এবং কলকাতা প্রবাসী বড়ুয়া বৌদ্ধদের আন্তরিক প্রার্থনায় তিনি বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারের অধ্যক্ষ ও সমিতির সভাপতি গুরুদায়িত্ব ভার গ্রহন করেন ।
শত ব্যস্থতার মাঝে ও স্বগ্রামের প্রতি ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী অকৃত্রিম ভালোবাস ছিল। কতালা-বেলাখাইন সদ্ধামালংকার বিহার গঠনে ও সহায়তা প্রদান করতেন । তাঁহার অর্থের উপর বিহারে কঠিন চীবর দান অনুষ্টান অনুষ্টিত হতো । এই সময় বার্মা থেকে নৌকা যোগে আনায়ন করে কতালা-বেলখাইন সদ্ধামালংকার বিহারে প্রথম সীমা ঘর নির্মান করে দেন এবং মহাসমারোহে মহাসংঘদান করে নিজ গ্রামকে আলোকিত করেছিলেন । তাঁহার একক অর্থায়নে সমস্ত কার্য সম্পাদিত হয়েছিল ।
গ্রামের শিক্ষার জন্য তিনি সব সময় চিন্তা করতেন । এলাকার বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন । কতালা-বেলখাইন মধ্য ইংরেজী স্কুলকে উচ্চ বিদ্যালয় ও স্কুল নির্মানের জন্য ১২৫০ টাকা সহ প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্র লাল বড়ুয়া (এম.এ) মহোদয়কে নিজ বাড়ীতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পত্রে জানানো হয় কোন অবস্থাতেই ডোনার ছাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অনুমোধন দেওয়া সম্ভব নয় । এমতস্থা, স্বশরীরে ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কতৃপক্ষের সাথে দেখা করে ১৩০০ টাকা জমা দিয়ে অনুমোধন নিয়ে আসেন এবং এই স্কুলের “মহাবোধি” নামকরন করেন । স্কুল ভবন সম্প্রসারন হওয়ার পর, কলকাতা থেকে এসে এই উচ্চ বিদ্যালয় উদ্ধোধন করেন । সেই উদ্ধোধন অনুষ্টানে উপস্থিত গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে তাহার বতৃক্তা প্রদান করেন এবং প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে স্কুল পরিচালনা এবং মাস্টারদের বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন । ১২ টাকা বেতন ধর্য্য করেন প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্র লাল বড়ুয়া(এম.এ) মহোদয় আর ৫ টাকা বেতন ধার্য্য করেন স্বগ্রামের অতীন্দ্র লাল চৌধূরী । ডাঃ শান্ত কুমার চৌধূরী এই স্কুলের নামদাতা, অনুমতিদাতা, প্রতিষ্ঠাতা । তাঁহার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় কতালা-বেলখাইন সহ আশে পাশের গ্রাম শিক্ষা সংস্কৃতিতে প্রথম শ্রেনীর অন্যতম গ্রামে পরিনত হতে সক্ষম হয়েছিল ।
১৯৩০-৩১ সালে কার্য বিবরনীতে অন্যতম মুদ্রক ছিলেন ড. বেনী মাধব বড়ুয়া । ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ।
১৯৩৩ সালে ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহার সভার সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় এবং আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ অনুশীলন সমাজ ও মহিলা সমিতি ।
এদিকে, সুষমা সেন গুপ্তার মামলা হাইকোটে ওঠলে । কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহার সভার কর্মকর্তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন । এমতবস্থায় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী মহাত্মা দানবীর বিড়লাজির সাহায্য প্রার্থনা করতে মনস্থ করলেন, এই ব্যাপারে ড. বেনী মাধব বড়ুয়ার সাহার্য্য ও পরামর্শ একান্ত প্রয়োজন মনে করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করতে গেলেন । সঙ্গে ছিলেন সতীশ চন্দ্র বড়ুয়া মহোদয় । যথা-রীতি সৌজন্য প্রদর্শন করে ধর্মাঙ্কুরের দূরাবস্থার কথা বিবৃত করলেন এবং এই ব্যাপারে সাহার্য্য প্রার্থনা করলেন ।
উল্লেখ্য কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবিরের সহিত মতানৈক্যে ফলে ড. বেনী মাধব বড়ুয়া বিহার ও ধর্মাঙ্কুর সভা সংস্থার একেবারে সর্ম্পক ত্যাগ করে উপরন্ত কোন বৌদ্ধদের সাথে মেলামেশা ছিলনা । ধর্ম ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন (৭) ।
অতীতের এই মানসিক বেদনা ভাবাবেগে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সম্প্রদায়ের বিরদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করলেন । ইহাতে ডা: শান্ত কুমার চৌধূরীর বিবেকে আঘাত লাগলে তিনি ও তদূত্তরে কিছু কঠোর বাক্য প্রয়োগ করার ফলে উভয়ের মধ্যে তুমুল তর্ক যুদ্ধের সৃষ্টি হয় । অতঃপর তাঁহারা উভয়ে নিরাশ হয়ে অফিস কক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন । ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী তাঁহার বিখ্যাত চৌধূরী ডিসপেনসারীতে এসে বিষন্নমনে এই অপ্রিকর ঘটনার কথা ভাবছেন । তখন সন্ধ্যা ৭ ঘটিকা । শহরের আলোক মালা জ্বলে উঠেছে । রাস্তায় লোকের গমনা গমনের ভীর । এই ভীরের মধ্যে ড. বেনী মাধব বড়ুয়া রাস্তা অতিক্রমের পদক্ষেপ নিলেন ডিসপেনসারী অভিমুখে । সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া (বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সহ. সভাপতি) । ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া বললেন ড. বেনী মাধব বড়ুয়া আসছেন (৮) । ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী বসার জন্য অনুরোধ করলেন । বগলে টুপি ধীরপদক্ষেপে ডিসপেনসারীতে প্রবেশ করলেন । ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া দাড়িয়ে প্রণাম করে অভ্যর্থনা জানালেন।। টুপিটি টেবিলের উপর রেখে বললেন ডা: শান্ত বাবু আমি দুঃখিত । আসন গ্রহন করে দৃঢ়কন্ঠে বললেন আমাকে কি করতে হবে বলুন ।
নাটকীয় ভাবে বিগত দুঃখ বেদনা ভুলে শান্তি ও সৌহার্দ্দপূর্ণ খোলা মনে উভয়ে ধর্মাঙ্কুরের সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা আরম্ভ করলেন । চা পানের পর ড. বেনী মাধব বড়ুয়া আদেশ করলেন এক টুকরা কাগজ ও কলম নিয়ে তাহার সম্মুখে বসতে । ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া তাই করলেন । ড. বেনী মাধব বড়ুয়া বয়ান করে যাচ্ছেন আর ডা. রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া লিখছেন । দুইখানা আবেদন পত্রের ন্যায় চিঠি । একখানা আরাকানের বিখ্যাত ব্যবসায়ী বাবু ধীরেন্দ্র লাল চৌধূরী মহোদয়ের নিকট দ্বিতীয় খানা রামু নিবাসী মতিসিং মহাজনের নিকট প্রেরণ করতে বললেন ।
চিঠি দুই সম্পাদকের নামে প্রেরন করা হল । ধীরেন বাবু অক্ষমতা জানিয়ে উত্তর দিলেন, মতিসিং মহাজন কোন উত্তরই দিলেন না । সেই দিন থেকে রাত্রি ৭/৮ ঘটিকায় ভবানীপুর বাসায় যাওয়ার পথে প্রায় সময় ডিসপেনসারীতে উঠতেন এবং জটিল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেন । কয়েক কাপ চা ও সিগারেটের বহুি উৎসব করে বাসায় ফিরতেন । উভয় নেতার মধ্যে বন্ধুতা ও গভীর আন্তরিকতা গড়ে ওঠেছে ।
ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী, ড. বেনী মাধব বড়ুয়াকে অনুরোধ করলেন ধর্মাঙ্কুর বিহার সভা পরিদর্শনের জন্য । অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ড. বেনী মাধব বড়ুয়া ধর্মাঙ্কুুর বিহারে গিয়ে উপস্থিত হলেন । এই সময় ধর্মাঙ্কুুরের মূল মন্দিরের উপর তলায় ছিলেন মহামান্য ৮ম সংঘরাজ শীলালংকার মহাস্থবির । বহুদিন পর ধর্মাঙ্কুরে তাঁহার এই ক্ষণিকের আগমনটি ছিল ধর্মাঙ্কুরের উত্থান-পতনের ইতিহাস ।
সুষমা সেন গুপ্তার দায়ের কৃতি হাইকোর্টের মামলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কৌশলী নিয়োগ করলেন । কৌশলীর পরামর্শ অনুসারে একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সাক্ষ দিতে হবে যে জমিটির উপর বৌদ্ধ ধর্মীয় “পবিত্র সীমা” প্রতিষ্ঠিত আছে । কোন মতেই উহা হস্তান্তর বন্ধক বা বিক্রি করার কারো অধিকার থাকতে পারে না । অতপর তাঁহারা দানবীর বিড়লা মহোদয়ের সাহার্য্য প্রার্থনা করলেন।। দানবীর তাঁহাদের অনুরোধ অনুমোদন করে ধর্মাঙ্কুর বিহারে পরিদর্শনে এলেন । উঠানের এক পাশে কিছু তাজা মাছের আঁশ দেখে বললেন, আপলোক নিরামিষ ভোজন নেহি করতে হে, তদূত্তরে ড. বেনী মাধব বড়ুয়া বললেন বৌদ্ধ ধর্মে আহারে কঠোর নিয়ম বিধি নাই ।
দানবীর বিড়লা ধর্মাঙ্কুর বিহারকে ঋন মুক্ত করে দিলেন, উপরন্ত খালি মাঠে আর্য বিহার নির্মান করে সদ্ধর্মের প্রভূত উন্নতি বিধান করলেন । এই মহৎ কার্য সম্পাদন করে বিড়লাজী বৌদ্ধ ধর্মের পরম হিতৈষীর পরিচয় প্রদান করলেন । ত্রিতল ভবনের ভিত্তি স্থাপনের সময় ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী ধর্মের ও সমাজের বৃহত্তর স্থার্থের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ হস্তে ভিক্ষু সীমার “পাথরের খুটি” উৎপাদন করেছিলেন । এর জন্যে কোন কোন লোকের বিরুদ্ধ সমালোচনার সম্মূখীন ও হয়েছিলেন । তাঁহার বিচক্ষন বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর শ্রমের ফলে ড. বেনী মাধব বড়ুয়ার সহ-যোগিতা লাভ করে ধর্মাঙ্কুর বিহার ঋন মুক্ত হল এবং সম্পদ ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি হল ।
এর পর ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী তাঁহার স্বগ্রাম হতে বিনয়াচার্য বংশদীপ মহাস্থবিরকে কলিকাতায় আহবান করে ধর্মাঙ্কুুর বিহারের বিহারাধ্যক্ষ পদে ও নালন্দা পালি বিদ্যা ভবনের অধক্ষের পদে নিযুক্ত করেন । এই নালন্দা বিদ্যা ভবনের প্রতিষ্ঠাতা লগ্নে আর্থিক ভাবে সাহার্য্য করেন ড. অরবিন্দ বড়ুয়া । তিনি ছিলেন নালন্দা বিদ্যা ভবনের একনিষ্ট পৃষ্টপোষক । এই নালন্দা বিদ্যা ভবনের অন্যতম অধ্যক্ষ ছিলেন ড. বেনী মাধব বড়ুয়া । ড. বেনী মাধব বড়ুয়ার আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয় নালন্দা পালি বিদ্যা ভবন ।
সে সময় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন খুব জোরদার হয়ে চরম পর্যায়ে আসে । এই সময় বৃটিশ সরকার নতুন করে এক ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন । তালতলা বাসভবনে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর সভা, বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কতালা নিবাসী ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী, ড. বেনী মাধব বড়ুয়া, ডিষ্ট্রিকট রেজিষ্ট্রার বাবু অধর লাল বড়ুয়া, এডভোকেট ভূপেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি, ডেপুটি মেজিষ্ট্রেট বাবু রেবতী রমন বড়ুয়া, ড. অরবিন্দ বড়ুয়া, ধর্মাদিত্য ধর্মাচারিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দের বৈঠকে বৌদ্ধদের দাবি সম্বলিত এক “মেমোরেন্তাম” (স্মারক পত্র) রচনা করা হয় এবং বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রত্যেক মন্ত্রী ও সদস্যগনের নিকট প্রেরন করেন, ইহার ফলে নতুন ১৯৩৫ সানের ভারত শাসন আইন নামে খ্যাত বঙ্গীয় সভায় বৌদ্ধদের একজন প্রতিনিধি গ্রহনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । প্রথমে ড. অরবিন্দ বড়ুয়া এবং দ্বিতীয় বার রায় বাহাদূর ধীরেন্দ্র লালা বড়ুয়া এম, এ, বি, এল মনোনয়ন লাভ করে সংখ্যা লঘুতম বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার অধিকারী লাভ করেন ।
১৯৩৫ সালে ড. অরবিন্দ বড়ুয়া ভাষনে বলেন, ভারত শাসন আইনে বৌদ্ধদিগকে শাসন ব্যাপারে কোন স্বতন্ত্র অধিকার না দেওয়াতে তাঁহাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, সে বিষয়ে কাহারো কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না । সত্য বটে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সংখ্যা অতি অল্প কিন্তু তথাপি যদি ২,৮০০ এংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য চারটি সদস্য পাইতে পারে, তাহলে ৩,৩০,০০০ বঙ্গীয় বৌদ্ধরা তাহাদের সংখ্যানুরুপ সদস্য কেন পাইবে না ?
তাঁহাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী বৌদ্ধরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ।
সেই ভাষনে রাজেন্দ্র প্রসাদ, জহুরলাল নেহেরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ চন্দ্র বসু, শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রমুখ বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি আকর্ষক করতে সক্ষম হয়েছিল ।
ব্রক্ষদেশের স্বাধীনতা আন্দলনের বিদ্রোহী নেতা আরাকানের অধিবাসী ভিক্ষ উত্তমের সাথে তৎকালীন বৃটিশ সরকার কর্তৃক বহিস্কৃত হয়ে কলকাতাস্থ ব্রহমী বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করছিলেন । তিনি প্রায় সময় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরীর, চৌধূরী ডিসপেনসারীতে এসে ধর্ম ও সমাজ বিষয়ে আলোচনা করতেন ।
সর্ব ভারতীয় বিরাট রাজনৈতিক সংস্থা হিন্দু সভার সভাপতি পদে ১৯৩০-৪০ দশকের মধ্যে নির্বাচিত হন । বিহারের রাজধানী পাটনা নগরে বাৎসরীক অধিবেশনে সভাপতি উত্তমের সঙ্গে বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী মহোদয় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে যোগদান করেছিল । ভারতীয় বিরাট রাজনৈতিক সংস্থার সভাপতির পদ লাভ একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গৌরবের বিষয় এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দের মহান উদারতার পরিচায়ক ।
নেপালী বংশোদ্ভব দার্জিলিংয়ের অধিবাসী অনাগারিক ধর্মাদিত্য ধর্মচারিয়া এম, এ মহোদয় অল ইন্ডিয়া বুড্ডিষ্ট কনফারেন্স নামে এক সমিতি গঠন করেন । বাংলা গর্ভনরের এডিকং সর্দ্দার বাহাদূর লাভেনলা সভাপতি ও তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক । প্রায় সময় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী সাথে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক আলাপ আলোচনা করতেন । শুনেছি, পরবর্তীকালে তিনি নেপালের গনতান্ত্রিক সরকার কৈরলা মন্ত্রী সভার সদস্য পদ লাভ করেছিলেন । উক্ত সময়ে বিশ্ব-বিখ্যাত ডব্লি ও, এফ, বির অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
দানবীর অনাগারিক ধর্মপাল মহোদয়ের প্রতিষ্ঠিত মহাবোধি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন যুবক অনাগারিক বাবু দেবপ্রিয় বলিসিংহ প্রায় সময় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী সাথে ধর্ম, সমাজ ও সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। মহা দুঃখের বিষয় তিনি অকালে পরলোক গমন করেন ।
এদিকে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহারের নিরাপত্তার কথা ভেবে সভার সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী একটি রেজিষ্ট্রীকৃত এক ট্রাষ্ট্রি বোর্ড (Trustcc Boart) গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এক জরুরী সভার বৈঠকে সর্বসম্মতি ক্রমে ট্রাষ্ট্রি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
১৯৩৫ সালে ১১ মে-তে ধর্মাঙ্কুর বিহারের যাবতীয় সম্পত্তির নিরাপত্তা রক্ষনাবেক্ষনের জন্য ট্রাষ্ট্রি বোর্ড গঠন করা হয় । বোর্ডের সদ্যসগনের নাম যথাক্রমে-
১| প্রভুদয়াল হিম্মত সিনহা, জেনারেল ম্যানেজার বিরলা এন্ড কোং ।
২| সন্তোষ কুমার বসু, তৎকালীন মেয়র কলকাতা করপোরেশন ।
৩| ড. বেনী মাধব বড়ুয়া, অধ্যাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ।
৪| রেবতী রমন বড়ুয়া, ডেপুটি মেজিষ্ট্রেট ।
৫| ডা: শান্ত কুমার চৌধূরী, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসেসিয়েশন ।
১৯৩৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্ভর নিজের তেজোময়ী প্রতিভা বলে বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমিতি বা বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশন আজীবন সাধারণ সম্পাদক (৮ বছর) থাকাকালীন এবং কতালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি থাকা অবস্থায় পরলোক গমন করেন । তাঁহার শবানুগমনে দীর্ঘ পথ নিমতলা অন্তিমালয় পর্যন্ত এত অধিক লোকের সমাগম হয়েছিল অভূতপূর্ব বলে কথিত । কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহার ভবনে বিশাল আকারে তাঁহার সাপ্তাহিক শ্রাদ্বকর্ম সম্পাদিত হয় ।
তথ্যঃ ত্রি-ঋত্বিক
পি লোকানন্দ মহথের
১৮ ও ১৯ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ জগজ্জ্যোতি, নবপর্য্যায়
২য়-৩য় সংখ্যা ৮ম বর্ষ ১৯৫৮ সাল ।
তথ্যঃ বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি
ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া
১৪৭ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ ত্রি-ঋত্বিক
পি লোকানন্দ মহাথের
১১ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ ডা: শান্ত কুমার চৌধূরীর জীবনালেখ্য
ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়া
২ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ জগজ্জ্যেতি, নবপর্য্যায়
২য়-৩য় সংখ্যা ৮ম বর্ষ ১৯৫৮ সাল ।
তথ্য: ডা: রবীন্দ্র নাথ বড়ুয়ার লিখিত ভাষন
বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সহ: সভাপতি
১৯৮৫ সাল
৭,৮,৯,১০,১১ পৃষ্ঠা
তথ্য: ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির জাতীয় অন্তোষ্টি ক্রিয়া
জ্ঞানশ্রী স্মারক
৫২ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ ৮ম সংঘরাজ শীলালংকার মহাস্থবিরের লিখিত অভিভাষন ।
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা
২৯৭ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ ডা শান্ত কুমার চৌধূরীর জীবনালেখ্য
১৯৮১ সাল
১১,১২,১৩ পৃষ্ঠা
তথ্যঃ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক
সাংবাদিক ডি. পি. বড়ুয়া’র গ্রন্ত্র
বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
তথ্যঃ জ্ঞানতাপস সমন পূন্নানন্দ স্বামী
ড. জিনবোধি ভিক্ষু
১৯৯৫ সাল
৪৩ পৃষ্ঠা