1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১১:০৯ অপরাহ্ন

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের আলোকে দারিদ্র্য বিমোচন

প্রতিবেদক
  • সময় বুধবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৮
  • ১৫৬৪ পঠিত

মো. আনিসুজ্জামান:

বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, মার্ক জাকারবার্গ, অ্যামানসিও ওর্তেগা, মাইকেল ব্লুমবার্গ, কার্লোস স্লিম হেলু, জ্যাফ বেজোস ও ল্যারি অ্যালিসন তাঁরা বিশ্বের শীর্ষ আট ধনী। এ খবর বহু পুরোনো; কমবেশি সবাই জানেন। প্রতিবছরই তাঁদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়; কখনো বা কমে। এতে হয়তো ধনী মানুষদের তালিকায় নিজেদের অবস্থান ওঠানামা করে মাত্র। কিন্তু জেনে অবাক হবেন বিশ্বের শীর্ষ আট ধনীর যে সম্পদ আছে, তা বিশ্বের অর্ধেক মানুষের হাতে থাকা সম্পদের সমান। এই আট ধনী চাইলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদ কিনতে পারবেন। (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬.১.২০১৭)

পৃথিবীর আট ধনী ব্যক্তির হাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিপরীতে এশিয়া এবং আফ্রিকায় ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপদ বাসস্থানের অভাবে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে বহু মানুষ। সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা যে পরিমাণে বাড়ছে তার বিপরীতে হতদরিদ্র মানুষ বাড়ছে বহুগুণ। বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, যুদ্ধ, সন্ত্রাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। সম্পদহীন হতদরিদ্র স্বাধীন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে।

একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগেও প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে সম্পদহীন বঞ্চিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। সম্পদের অসম বন্টনের কারণেই পৃথিবীর আট ব্যক্তির হাতে অর্ধেক মানুষের সম্পদ। এছাড়া অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদ।

শ্রমজীবী মানুষ কোনো রকমে বেঁচে আছে আর মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাবানদের হাতে উদ্বৃত্ত সম্পদ জমা হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উন্নতির যুগে শ্রমদাসেরা ‘সুখী শুকরের’ মত বেঁচে আছে।

উন্নত বিশ্বে দরিদ্র মানুষ আছে। তবে তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। অনুন্নত দেশে সম্পদশালী এবং সম্পদহীন মানুষের ব্যবধান প্রকট। উন্নত বিশ্বে দরিদ্র মানুষ কষ্টে আছে। তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র মানুষের অবস্থা বর্ণনাতীত। দরিদ্রতা একটি অর্থনৈতিক সমস্যা।

গৌতম বুদ্ধ অর্থনৈতিক এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুঃখ থেকে মুক্তি গৌতম বুদ্ধের চিন্তার মূল উৎস। দরিদ্রাবস্থা দুঃখের অন্যতম কারণ। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্যই তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলেছেন। বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক দুই প্রকার দরিদ্র্যতা নিরসনের চেষ্টা তিনি করেছেন।

পট্টকম্ম, সিগালোবাদ, সপ্পুরিস, ব্যপঘপজ্ঝ, কুটদন্ত সূত্তে সম্পদ উৎপাদন, বন্টন এবং মানুষের কল্যাণে সম্পদ ব্যয় করার বিধান রয়েছে। কোসাম্বীর সূত্রে বলা হয়েছে সামাজিক অসাম্যের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বিবাদ-বিষম্বাদের অন্যতম কারণও ব্যক্তিগত সম্পত্তি। গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন সূত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাহায্য তাঁর দারিদ্র্য বিমোচনের প্রয়াসটি এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে।

মানুষের চাহিদা অসীম। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন পৃথিবীর সব সম্পদ যদি কোনো মানুষকে দেয়া হয় তবুও তার চাহিদা শেষ হবে না। এই অসীম চাহিদা পৃথিবীর সীমিত সম্পদ দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। কিন্তু সব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সম্পদ উৎপাদন, ভোগ, বন্টন এবং বিনিময় প্রয়োজন।

সীমিত সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে সুষম বন্টন করার প্রক্রিয়া এবং যে চেষ্টা তাই নিয়ে অর্থনীতি। গৌতম বুদ্ধ সীমিত সম্পদের উৎপাদন, ভোগ, বন্টন এবং বিনিময় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন সম্পদের অসম বন্টনের ফলে সৃষ্টি হয় দারিদ্র্য।

দরিদ্র বলতে সাধারণত আমরা বুঝি জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত উপাদানের অভাব। পুষ্টিহীনতা, নিশ্চিত স্বাস্থ্য সেবা, মানসম্মত শিক্ষা, নিরাপদ বাসস্থান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বস্তুগত উপদানের অভাবে রয়েছে পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত এবং মানসিক উপাদানের চরম অভাব রয়েছে।

গৌতম বুদ্ধ জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত এবং মানসিক উপাদানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্বাণ লাভের জন্য বস্তুগত এবং মানসিক উপদানের সমন্বয়ের কথা বলেছেন গৌতম বুদ্ধ। ব্যাক্তি মানুষ এবং সামাজিক মানুষের সুস্থ জীবনধারনের জন্য মানসিক এবং বস্তুগত উপাদানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

উন্নত বিশ্বে মানুষের বস্তুগত উপাদানগুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য তারা নির্ধারণ করতে পারেনি। প্রয়োজনীয় বস্তুগত উপদান যথাযোগ্যভাবে ভোক্তর নাগালের মধ্যে রেখেও উন্নত বিশ্বের মানুষের চরমপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়নি। তারা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে এগুচ্ছে। তাদের পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে। মানসিক-মানবিক সম্পর্কের বাঁধনগুলো বিপর্যস্ত।

তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র মানুষের বস্তুগত সম্পদ এবং মানসিক দুটোর অভাবে মানবিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত। লন্ডন শহরের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ভিক্ষুক আছে আবার ঢাকা শহরের গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরায় ভিক্ষুকের অভাব নেই। গ্রামে-গঞ্জেও ভিক্ষুক রয়েছে। উন্নত বিশ্ব ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তৃতীয় বিশ্বে অসম্মানের। কিন্তু দুই স্থানেই ভিক্ষাবৃত্তি চলছে।

দুই স্থানের ভিক্ষুকদের বস্তুগত এবং মানসিক সম্পদ নেই। তারা সমান দুঃখ ভোগ করেন। উন্নত বিশ্বের ভিক্ষুকদের শেল্টার হোম আছে। চিকিৎসা এবং অন্যান্য বস্তুগত সুবিধা রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে। তৃতীয় বিশ্বে তা নেই। গ্যারেট হার্ডিন, ‘Living on a Lifeboat’ প্রবন্ধে মানবজীবনকে লাইফ বোর্টের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, উন্নতবিশ্বের মানুষ লাইফ বোর্টের মধ্যে আছে আর তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সাগরের মধ্যে আছে। তারা লাইফবোর্টে উঠার চেষ্টা করছে।

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রধান বিষয় দুঃখ। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, সবই দুঃখময়। জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, হতাশা, অবসাদ, অশান্তি, যা চাই না তা প্রাপ্তি, নিন্দা, মৃত্যু সবই দুঃখ। দুঃখের কোনো শেষ নেই। দুঃখের পর আবার দুঃখ আসে। গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্য দুঃখকে কেন্দ্র করেই।

মহাপরিনির্ব্বাণ সূত্রে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘হে ভিক্ষুগণ দুঃখ, দুঃখের উৎপত্তি, দুঃখের নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের মার্গ – এই হইল চারি আর্যসত্য। এই চারি সত্যের জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাবে মানুষ পুনঃ পুনঃ জন্মলাভ করে। মানুষ জন্ম-জন্ম পরিভ্রমণ করে।’

জন্ম-জন্ম পরিভ্রমণ করাই হল জীবের দুঃখ। গৌতম বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির উপায় বের করার জন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং দুঃখ মুক্তির উপায় আবিষ্কার করে ‘বুদ্ধ’হয়েছিলেন। শিষ্যদের মাঝে দুঃখ মুক্তির উপায়ের দর্শন তিনি প্রচার করেছেন। মানবজাতির দুঃখ মুক্তির উপায় হিসাবেও তিনি এই চারটি আর্য সত্য, আটটি মার্গ এবং পাঁচটি শীল রেখে গেছেন।

চারটি আর্যসত্যের উপর নির্ভর করে বৌদ্ধ দর্শনকে অনেকে দুঃখবাদী দর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করেন। এই অভিযোগ সত্য নয়। গৌতম বুদ্ধ নিজেই পোট্ঠপাদ সূত্রে এই অভিযোগ খণ্ডন করেছেন।

হে পোট্ঠপাদ! আমি স্থূল শরীর নিবারণের জন্য উপদেশ প্রদান করি। সেই সকল উপদেশ পালনে শরীরের স্বাভাবিক ক্লেশ সকল দূর হয় ও মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়।

হে পোট্ঠপাদ! তুমি মনে করিতে পারো, এইরূপ জীবনও দুঃখের। কিন্তু তাহা নয়। এইরূপ ব্যক্তি সেই অবস্থায় প্রীতি, শান্তি ও স্মৃতিমান হইয়া সুখে বিহার করে।

হে পোট্ঠপাদ! আমি মনোময় ও ইন্দ্রিয়সম্পন্ন শরীর নিবারণের জন্যও উপদেশ প্রদান করি। সেই সকল উপদেশ পালনে রূপ শরীরের স্বাভাবিক ক্লেশ সকল দূর হয় ও প্রজ্ঞার উদয় হয়। কিন্তু মনে করিতে পার, এইরূপ জীবনও দূঃখের। কিন্তু তাহা নয়। এই অবস্থায় প্রীতি, শান্তি ও স্মৃতিসম্পন্ন হইয়া সুখপ্রাপ্ত হইবে।

গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, টীকা-টিপ্পনী নিয়ে বুদ্ধ উত্তরকালে নানা ভাগ, উপভাগ, সম্প্রদায় এবং উপসম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রধান লক্ষ্য দুঃখ থেকে মুক্তি নিয়ে সম্প্রদায় এবং উপসম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো মতভেদ দেখা যায়নি। সবাই দুঃখ মুক্তির কথা বলেছেন।

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রধান লক্ষ্য দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ বা নির্বাণ। নির্বাণ লাভের জন্য দারিদ্র্য মুক্তি অনিবার্য। গৌতম বুদ্ধ দুঃখ থেকে মুক্তির আগে দারিদ্র্য মুক্তির কথা বলেছেন। কারণ দারিদ্র্য দুঃখের অন্যতম কারণ। দরিদ্র মানুষ ধর্ম-কর্মে মনযোগী হতে পারে না। দরিদ্র মানুষের পক্ষে শীল মেনে চলাও কঠিন। তাছাড়া ধর্ম-কর্মে যথাযোগ্যভাবে মনোনিবেশ না করার ফলে মানুষ জন্ম-জন্ম পরিভ্রমণ করে এবং সে দুঃখ থেকে অধিকতর দুঃখের মধ্যে অবস্থান করে।

গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতীয় সমাজ চারবর্ণে বিভক্ত ছিল। বর্ণ অনুসারে কর্ম নির্ধারিত হতো। সমাজের নিচু স্তরের শূদ্র কখনো অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হয়নি। বৎসর বৎসর শূদ্র সমাজের নিচে থেকেছে। অভাব অনটন ও চরম দারিদ্র্য সীমা এরা অতিক্রম করতে পারেনি। জন্মসূত্রে এক শ্রেণি আরেক শ্রেণিকে শোষণ, শাসন করেছে। শূদ্র যে শুধু শোষিত তাই নয়, এমনকি প্রাচীন ভারতে শূদ্রের মৃত্যুর পর সৎকার করা হতো না। ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হতো।

ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধ প্রথম বর্ণপ্রথা বিমুক্ত করেন। তিনি বলেছেন মানুষের পরিচয় জন্মে নয় কর্মে। কর্মের দ্বারাই মানুষ নিজের পরিচয় নির্ধারণ করে। কর্ম এবং সৃজনশীল ক্ষমতাগুণেই সমাজে মানুষ নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি বর্ণ প্রথা বিলুপ্ত করেছেন। অগ্গঞ্ঞ সূত্রে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন,

সকল মনুষ্যজাতি যেমন যোনিজ, ব্রাহ্মণরাও তাই। সকল জাতির নারীদের ন্যায় তাঁহাদের নারীরাও ঋতুমতী হয়, গর্ভধারণ করে, সন্তান প্রসব করে ও সন্তানকে স্তন্যপ্রদান করে। তবে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয় কী রূপে? ব্রাহ্মণরা ব্রহ্মার মুখ হইতে নির্গত আর অন্য সকল ব্রহ্মার পদ হইতে নির্গত কথাটি মিথ্যা। কোন যোনিজ প্রাণীর পক্ষে উহা সম্ভব নয়। এই মিথ্যা কথা বলিয়া ব্রাহ্মণরা নিজেদের ও তাঁহাদের ব্রহ্মার অপমান করেন।

বর্ণপ্রথার বিলুপ্তি করে গৌতম বুদ্ধ বংশ পরম্পরায় দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। শূদ্র ঘরে জন্মালেই যে দরিদ্র থাকতে হবে এই ধারণার পরিবর্তন করেন গৌতম বুদ্ধ। সমাজে মানুষের অবস্থান নির্ধারিত হয় কর্মের দ্বারা। শূদ্র যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করে সমাজে ভাল অবস্থানে থাকতে পারে। আবার ব্রাহ্মণ কর্মগুণে সমাজে নিন্দিত হতে পারেন। গৌতম বুদ্ধ কর্মগুণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

বুদ্ধের সংঘে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সমান মর্যাদা ছিল। শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়সহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল সংঘে। চারবর্ণে বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান ছিল সবার নিচে। কি ব্রাহ্মণ কি শূদ্র কোনো নারীই সম্পদের মালিক ছিল না। গৌতম বুদ্ধ নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুণী সংঘে পুরুষের আধিপত্য ছিল।

বুদ্ধের পালিতা মা গৌতুমীর আগ্রহে এবং আনন্দের অনুরোধে আটটি শর্ত পালন সাপেক্ষে গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছিলেন। সংঘের নারীরা সবাই সমান মর্যাদা ভোগ করতেন। ভিক্ষুণী সংঘ ভিক্ষু সংঘের সমকক্ষ ছিল না। বুদ্ধের শর্তগুলোর মধ্যে নারী পুরুষের বৈষম্য প্রকাশিত হয়েছে। শর্তগুলো হলো

০১. বয়সে ছোট বা বড় পূর্বে দীক্ষিত ভিক্ষুদের সম্মান প্রদর্শন করবে;

০২. যে গ্রামে ভিক্ষুরা অবস্থান করবে না সে গ্রামে ভিক্ষুণীরা থাকতে পারবে না;

০৩. কোন দিন উপসত পালন করবে আর কোন দিন ধর্মোপদেশ শুনতে আসবে তা পূর্বে ভিক্ষু সংঘ থেকে জেনে নিতে হবে;

০৪. চর্তুমাসের পর ভিক্ষুণীরা উভয় সংঘের প্রবারণা করবে;

০৫. ভিক্ষুণী ভিক্ষুর উপদেশ নিবেন, দিবে না;

০৬. যেসব ভিক্ষুণীর হাতে সংঘাদিশেষ আপত্তি ঘটেছে তারা ভিক্ষু সংঘ ও ভিক্ষুণী সংঘ থেকে ১৫ দিন বিহারের বাইরে অবস্থান করবে;

০৭. কোনো ভিক্ষুণী ভিক্ষুকে কটু কথা বলতে পারবে না;

০৮. দুই বছর সংঘে সাধনা করার পর ভিক্ষুণীকে উভয় সংঘই উপসম্পাদনা দেবেন।

গৌতম বুদ্ধের সময়ও নারীর বস্তুগত কোনো সম্পদই ছিল না। নারী চরম দারিদ্র্য সীমায় বাস করতো। বিত্তবান ঘরের নারীদেরও বস্তুগত কোনো সম্পদ ছিল না। মানসিক অবস্থাও তাদের সঙ্কটাপন্ন ছিল। সংঘে প্রবেশের অধিকার দিয়ে নারীদের বস্তুগত এবং মানসিক দারিদ্র্যাবস্থা থেকে মুক্ত করেন বুদ্ধ।

সংঘের নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা সংঘকেই করতে হতো। ‘বৌদ্ধ সংঘে নারী সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইলে তাঁহাদের শিক্ষার দায়িত্ব সংঘকে গ্রহণ করিতে হইত। অন্যান্য ভিক্ষুর ন্যায় ভিক্ষুণীগণও আজীবন ব্রহ্মচারিণী থাকিয়া বিনয়-ব্যবহার ও ধর্ম্মশাস্ত্র চর্চায় কাল অতিবাহিত করিতেন। বৌদ্ধ সংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট প্রসার লাভ করিয়াছিল।’

গৌতম বুদ্ধ স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, সম্পদের সুষম বন্টনের নীতি প্রণয়ন করেন রাজা। সে সময় ভারতবর্ষে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল। গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন, প্রজাদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব রাজার। জনকল্যাণমুখী রাজা সমাজের সকলের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন। দরিদ্র মানুষের মাঝে রাজা শুধু দান করে দারিদ্র্যাবস্থার অবসান করতে পারেন না। পরিমিত দান সমাজকে সুস্থ করে।

আবার অপরিমিত দান ক্ষতির কারণও হতে পারে। চক্কবত্তি-সীহনাদ সূত্রে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘রাজা দরিদ্রদের জীবিকা নিমিত্ত ধন দান না করার জন্য রাজ্যে দারিদ্র্যতা বাড়িল। দারিদ্র্যতা বাড়িলে রাজ্যে চুরি বাড়িল চুরির সহিত লুণ্ঠন, দস্যুবৃত্তি বাড়িল, প্রাণী হত্যাও বাড়িল। চুরিতে ধরা পড়িলে সেই ব্যক্তি রাজাকে মিথ্যা কথা বলিল।

এইভাবে রাজ্যে মিথ্যা কথা বলার প্রবণতাও বাড়িল।’ দারিদ্র্য থেকে অন্যায় অবিচার, মিথ্যাচার এবং সকল প্রকার অনাচারের সৃষ্টি হয়। গৌতম বুদ্ধ এই সূত্রেই বলেছেন যে, রাজ্যে এইরূপ চলতে থাকলে শুধু যে সামাজিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তাই নয় কিছু মানুষের আয়ু কমে যায়।

সম্পদের অসম বন্টন নীতির ফলে কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ আর সমাজের বেশিরভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যাবস্থায় অবস্থান করে। ফলে সমাজে রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা এবং ন্যায় বিচার ব্যাহত হয়। রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কূটদন্ত সূত্রে বলা হয়েছে,

রাজ্যে যাহারা কৃষিকার্য ও পশুপালনে আগ্রহী রাজা তাহাদের বীজ ধান্য, খাদ্য ও পশু প্রদান করুন। যাহারা ব্যবসা-বাণিজ্য করিতে আগ্রহী, রাজা তাহাদের মূলধন প্রদান করুন। যাহারা রাজ কার্য করে, রাজা তাহাদের আহার্য ও বেতন বৃদ্ধি করুন। ইহাতে রাজ্যের সকলে নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত থাকিয়া অভাবহীন হইলে, রাজ্যে উপদ্রবকারী ও উপদ্রব থাকিবে না। ইহাতে রাজার আয়ও বাড়িবে। রাজ্য কন্টকহীন হইলে প্রজাদের সুখ শান্তি আসিবে।

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনে দেখা যায় সাধারণ মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য রাজার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজা প্রজাদের উপকার করবেন। প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধির উপর রাজ্যের স্বাস্থ্য নির্ভর করে।

গৌতম বুদ্ধ দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য শুধু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন নি। একজন সমাজ উন্নয়ন কর্মী হিসাবে তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বুদ্ধের সময় বৈশালীতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ শিষ্যদের নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য বিত্তবান শ্রেষ্ঠীদের ঘরে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। বুদ্ধের আহ্বানে সে সময় শ্রেষ্ঠীরা প্রচুর দান করেছিল।

কুশল রাজ্যে দুর্ভিক্ষের সময়ও গৌতম বুদ্ধ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের আহ্বানে বিত্তবান শ্রেষ্ঠীরা প্রথমে এগিয়ে না আসলেও কুশলের ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে অবশ্য বিত্তবান শ্রেষ্ঠীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

গৌতম বুদ্ধ শুধু দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য সামান্য দানের ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। মনুষ্যসৃষ্ট কারণে যেন দুর্ভিক্ষ না হয় তার চেষ্টাও করেছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য সম্পদ সঞ্চয় করার কথাও তিনি বলেছেন।

গৌতম বুদ্ধের সময় প্রকৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বন্যা, খরা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে যে খাদ্যাভাবের সৃষ্টি হয় তার-চেয়ে মানুষই বেশি কৃত্রিম খাদ্য সংঙ্কট সৃষ্টি করে। কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের চরম বিরোধী ছিলেন বুদ্ধ। বীজ সংরক্ষণের কথা গৌতম বুদ্ধ বলেছেন। ভিক্ষুদের ফসলের বীজ দান হিসাবে গ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।

অধিক মুনাফা এবং সঠিক বন্টন নীতির অভাবে খাদ্যাভাব এবং নানা ধরনের অবিচার-অন্যায়ের সৃষ্টি হয়। ফলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন, এসবের শুরু মন থেকে।

মানুষের সবকিছু শুরু হয় মন থেকে। মন থেকে পরিকল্পনা শরীরে রূপ নেয়। তাই সকল কর্মের আগে মনের বিশুদ্ধতা প্রয়োজন। এই জন্য গৌতম বুদ্ধ দুঃখময় মানবজাতির মুক্তির জন্য আটটি মার্গ এবং পাঁচটি শীল নির্ধারণ করেছেন। সম্যক দৃষ্টি বা যথার্থ জ্ঞান, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বচন, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি এই আটটি মার্গ এবং পাঁচটি শীল পালন করলে মানবজীবন ভবচক্র থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

যথার্থ জ্ঞান বা সম্যক দৃষ্টি না থাকলে মানুষের মনে কামনা, বাসনা, স্বার্থপরতা, অতিরিক্ত লোভ, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। লোভহীন মানুষ সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে না। একটি ব্যবসা থেকে আরেকটি ব্যবসা, একটি গাড়ি থাকতে আরো দুটি গাড়ি একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি এগুলো ব্যক্তি মানুষের সুখের মাত্রা নয়। বস্তুগত সম্পদ মনের চাহিদা মাত্র। বাহ্যিকভাবে মনে হয় হাজার কোটি টাকার মালিক নিঃসন্দেহে সুখে আছে। সত্যিই কি তাই?

দ্বিতীয় ও শেষপর্ব আগামীতে সমাপ্য।

মো. আনিসুজ্জামান : লেখক, প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!