অনির্বাণ বড়ুয়া:
‘অনিচ্চা’ শব্দটির অর্থ অনিত্য- যা নিত্য নয়। বুদ্ধের দর্শনের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনিত্যবাদ। সকল জীবের জীবন বা অস্তিত্বের অপর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘দুঃখ’ এবং ‘অনাত্ম’ এর মূল ভিত্তি। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এই ত্রি-লক্ষণ একই সূত্রে গ্রথিত। অনিত্যসত্যের প্রকৃত অর্থ হলো বিশ্বজগত স্থির নয়; নিয়ত গতিশীল। বিশ্বব্রহ্মা-ের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আধুনিক বিজ্ঞানীরাও দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বজগতের এই মৌলিক প্রকৃতিকে মেনে নিয়েছেন। গতিশীল জগৎ-সংসারের সবকিছুই অনিত্যÑ তথাগত বুদ্ধ এ শিক্ষা মানবজাতিকে দিয়েছেন। সত্যটি আজ প্রত্যেক মানুষের উপলব্ধি করা উচিত। এই পরম সত্যের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্রহ্মা- তার আপন গতিপ্রবাহে চলমান। মানব-সভ্যতার কথা ধরলেও এ সত্য উপলব্ধ হয়। তবে মানুষের বস্তুগত অর্জনের ক্ষেত্রে তথা বস্তুজগতের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনশীলতা বেশি কার্যকর। জগতের এ পরিবর্তন-ধর্মই মানুষকে একের পর এক সফলতা, সমৃদ্ধি ও উন্নতি-অগ্রগতি এনে দিচ্ছে।
পরিবর্তনশীলতাই অনিত্যতা। ইহা বস্তুজগতের সকল সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। জীব-জড়-জৈব-অজৈব কোনো কিছুকেই আমরা চিরস্থায়ী বলতে পারি না। সকলের ক্ষেত্রে ইহা সত্য। মানুষের ক্ষেত্রেতো বটেই। মানুষের জন্য ইহা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান যা কিছু আছে প্রত্যেকটি বস্তুর জন্যও তা সমানভাবে সত্য। কোনো জিনিসই চিরকাল স্থায়ী হয় না। সবকিছুই নশ্বর। ফুলের সৌন্দর্য, পাখির গান, সূর্যাস্তের রক্তিম আভা, মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রকৃতির বিচিত্র ঘটনা, জড়পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা-কোনো কিছুই স্থায়ীভাবে স্থির থাকে না। ঘরবাড়ি, মঠ-মন্দির, প্রাসাদ-অট্টালিকা, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, বড় স্থাপনা এমনকি সৌরশক্তি পর্যন্ত কোনো কিছুই অনন্তকাল ধরে টিকে থাকে না, থাকবেও না। সবকিছুই নিয়ত অন্যরূপে রূপান্তরিত হচ্ছে কিংবা ধ্বংস হচ্ছে। হয়তো ধ্বংসের পর পুনরায় সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে জগতের কোনো কিছুই নিত্য নয়- সবকিছুই অনিত্যতার অধীন।
জীবনের তিনটি অপ্রতিরোধ্য সত্য হলো অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম। এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে আপাতভাবে দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এগুলোর প্রকৃত স্বরূপ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এই তিনের সম্যক উপলব্ধিতে প্রকৃত মুক্তি অর্জন সম্ভব। এই তিনের প্রকৃত অনুধাবনই হচ্ছে বুদ্ধের মহান শিক্ষা। অনিত্যদর্শন বুদ্ধের ধর্মদর্শন তথা বৌদ্ধদর্শনের মৌলিক বিষয়াবলির অন্যতম। বুদ্ধ বলেছেন:
সব্বে সংখারা অনিচ্চা’তি যদা পঞঞায় পস্সতি
অথ নিব্বিন্দতি দুক্খে এস মগ্গো বিসুদ্ধিয়া।
কার্য-কারণ এর অধীন এ জগতের সকল সংস্কার অনিত্য- একথা যদি প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। বস্তুত অনিত্যদর্শন বিশুদ্ধির মার্গ। ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দৃষ্টিকোণেই ইহা বাস্তব। আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোনো জিনিসেরই শাশ্বতকাল ধরে স্থায়িত্ব নেই। সব অস্তিত্বের পরিবর্তন ঘটছে নিয়ত। মানুষ, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষ-গুল্ম, লতাপাতা, তৃণ, জড়-চেতন সব সত্তাই প্রতি মুহূর্তে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছে। একটি বৃক্ষ বীজ থেকে চারা, চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ গাছ, গাছ থেকে ফুল ও ফল ধরা পর্যন্ত কত ধরনের পরিবর্তন হয়! তবে সে পরিবর্তন আমরা তাৎক্ষণিক বুঝতে পারি না। পরিবর্তন কিন্তু থেমে নেই। ইহা প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে। জগতের সকল বস্তু বা জিনিসের ক্ষেত্রে অনিত্যতা প্রযোজ্য হলেও বুদ্ধ প্রাণীর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ এবং উপলব্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন বেশি। প্রাণীর জীবনের ক্ষেত্রে অনিত্যতার প্রয়োগ নিয়ে বেশি তৎপর হয়েছেন। বিশ্বচরাচরের সবকিছুই বিলয়ধর্মীÑ এ সত্য আবিষ্কার করতে গিয়ে বুদ্ধ উদ্ঘাটন করেছেন মানবজীবনের আসল রহস্য। বুদ্ধের মতে মানবজীবন পঞ্চস্কন্ধ নিয়ে গঠিত। পঞ্চস্কন্ধ হলো রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। বুদ্ধ বলেছেন- এই পঞ্চস্কন্ধই অনিত্য। দীঘনিকায়ের ‘মহাসতিপট্ঠান সূত্রে’ ইহা উল্লিখিত হয়েছে। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান উৎপন্ন হয়ে বিলীন হয়। মহাপরিনির্বাণের সময় বুদ্ধের অন্তিম বাণী ছিল- ‘হে ভিক্ষুগণ, সংস্কার সমূহ ক্ষয়শীল (অনিত্য), অপ্রমাদের সাথে অর্থাৎ জ্ঞানযুক্ত সম্যক স্মৃতির সাথে সব কাজ সম্পাদন করবে।’ দীঘনিকায়ের ‘মহাসুদর্শন সূত্রে’ উল্লেখ আছে- ভগবান তথাগত বুদ্ধ কুশীনগরে মল্লদের শালবাগানে যুগ্মশালবৃক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে মহাপরিনির্বাণশয্যায় অবস্থান করছিলেন। তখন আনন্দ বুদ্ধকে ঐ স্থানে পরিনির্বাপিত না হয়ে আরো উন্নত কোনো এক নগরে পরিনির্বাপিত হতে অনুরোধ করেন। বুদ্ধ আনন্দকে কুশীনগরের অতীত অবস্থা বর্ণনা করেন। অতীতের কুশীনগরের সকল জিনিস এখন অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। এটিই বিশ্বজগতের অতি স্বাভাবিক নিয়ম। অশাশ্বত সকল সংস্কারে আসক্তি উপশম করতে হবে। সব সংস্কারে বিরাগ উৎপাদন করতে হবে। এখান থেকে বিমুক্ত ও বিবিক্ত হলেই মুক্তি। তাই অন্তিম সময়ে বুদ্ধ উচ্চারণ করলেন জগৎসত্যের শাশ্বত বাণী:
অনিচ্চা বত সংখরা, উপ্পাদবয়ধম্মিনো
উপ্পজ্জিত্বা নিরুজ্ঝন্তি তেসং বূপসমো সুখো’তি।
[মহাপরিনির্বাণ সূত্র]
সংস্কার সমূহ উৎপত্তি ও বিনাশশীল। উৎপন্ন হয়ে তারা নিরুদ্ধ হয়। তাদের উপর আসক্তি ও মোহকে উপশম করতে পারলেই প্রকৃত সুখ। অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ বলেছেন, ‘হে ভিক্ষুগণ!, কিছুই চিরস্থায়ী নয়, সংস্কারসমূহ অনিত্য, অধ্রুব, অসুখ- এটা জেনে এতে বিরাগ উৎপাদন করা উচিত, উহা হতে বিবিক্ত ও বিমুক্ত হওয়া উচিত।’ আপাতদৃষ্টিতে কোনো কিছুকে স্থায়ী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা উদয় ও বিলয়ধর্মী। সবকিছুই প্রতীত্যসমুৎপন্ন- কার্যকারণ শৃঙ্খলায় দ্বারা যুক্ত। কারণ বিনা কার্য হয় না। কোনো কারণই ধ্রুব নয়। অনিত্যদর্শন তথা অনিত্যতার তত্ত্ব অনুসারে এই বিশ্বব্রহ্মা-েরও শেষ আছে। সংযুক্ত নিকায়ে বলা হয়েছে- ‘যং ভূতং তং নিরোধ-ধম্মং’- যা উৎপন্ন হয়েছে তা নিরোধধর্মী। জড়-জীব কেউ এ নিয়মের বাইরে নয়।
গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস পৃথিবীর অন্তহীন পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। তাঁর পরিবর্তনশীলতার একটি মতবাদও রয়েছে। হেরাক্লিটাস এর মতে বিশ্বজগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তিনি মনে করেনÑসবকিছুই প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁর মতবাদ ব্যাখ্যা করার সময় দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, ‘তুমি একই নদীতে দুবার অবগাহন করতে পার না, কারণ প্রতি মুহূর্তেই তোমার উপর দিয়ে নতুন পানি প্রবাহিত হচ্ছে।’ ‘সূর্য প্রতিদিনই নতুনরূপে উদিত হয়।’ বুদ্ধের অনিত্যদর্শনের সাথে হেরাক্লিটাসের মতবাদের যথেষ্ট সাযুজ্য লক্ষণীয়। জগতের নশ্বর ধর্মের কথাই গ্রিক দার্শনিকের মতবাদে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। হেরাক্লিটাসের লেখা কবিতায়ও ফুটে উঠেছে- মানুষের অত্যন্ত প্রিয় জিনিসকে এমনকি জীবনকে মহাকাল (ঞরসব) ধ্বংসের দিকে ঠেনে নিয়ে যায়। ইহাই জগতের শাশ্বত বিধান। মরমীবাদী দার্শনিকগণ (গুংঃরপং) স্বীকার করেন- কালের মধ্যে বিদ্যমান অর্থাৎ সময়ের আবর্তে বিরাজমান সবকিছুই নশ্বর-অনিত্য। এগুলো বৌদ্ধদর্শনের অনিত্যবাদেরই নামান্তর। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, ‘ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানও চন্দ্র সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রকে চিরন্তন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। গ্রহ-উপগ্রহের উৎপত্তি হয়েছে সূর্য থেকে, সূর্যের উৎপত্তি হয়েছে নীহারিকা থেকে। দীর্ঘকাল যাবৎ এগুলো টিকে আছে এবং আরো দীর্ঘকাল এগুলো টিকে থাকবে; কিন্তু অদূরভবিষ্যতে-সম্ভবত লক্ষ লক্ষ বছর পর এগুলো বিস্ফোরিত হবে। এই বিস্ফোরণ সব গ্রহ-উপগ্রহকে ধ্বংস করে ফেলবে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ অন্তত একথা বলেন যে, সেই নিয়তি নির্ধারিত দিনটি যেন তাঁদেরকে এমন এক দিনের কাছাকাছি নিয়ে আসছে যেদিন তাঁরা তাঁদের হিসাবে কিছু ভুল খুঁজে পাবেন।’ [পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস; অনুবাদ: ডক্টর প্রদীপ রায়, পৃষ্ঠা ৪৬-৪৭]
বুদ্ধ শিষ্যদেরকে ব্যাখ্যা করেছেন- পঞ্চস্কন্ধ অনিত্য; যা অনিত্য তা দুঃখময়; যা দুঃখময় তা আত্মবিহীন, অনাত্ম। যা আত্মহীন তা আমার নয়। ইহা আমার সত্তা নয়। একে সত্যিকারভাবে বুঝতে হলে প্রজ্ঞার দরকার। প্রকৃষ্ট জ্ঞান তথা প্রজ্ঞা দ্বারা যথার্থরূপে একে দর্শন করতে হয়। প্রজ্ঞা ছাড়া এর প্রকৃত অবস্থা বুঝা যায় না। প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে যথার্থভাবে দর্শন করতে পারলে চিত্ত যাবতীয় ক্লেশ-অকুশল থেকে মুক্ত হয়। তখন উপলব্ধি আসে- জগতে ‘আমি’ কিংবা ‘আমার’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আপাদৃষ্টিতে এগুলোকে অস্তিত্বশীল মনে করা হলেও বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণে এসবের অস্তিত্ব নেই। নাগার্জুনও বুদ্ধের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেন, যখন আত্ম এবং আত্মার ধারণা তিরোহিত হয়, ‘আমার’ ধারণা তিরোহিত হয় তখন ‘আমি’ ও ‘আমার’ ধারণাসমূহ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ‘অনিত্য’ ধারণাটি যদিও জগতের জড়-চেতন সকল পদার্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বুদ্ধ এ ধারণাকে জীবের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করতে বেশি আগ্রহী। একজন অঙ্গসংস্থানবিদের মতো করে তিনি সত্ত্ব বা জীবকে বিশ্লেষণ করেন পাঁচটি স্কন্ধে। পঞ্চস্কন্ধকে ‘সংখারা পুঞ্জ’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। পঞ্চস্কন্ধের ক্ষণস্থায়ী বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুদ্ধ পাঁচটি চমৎকার উপমা দিয়েছেন। প্রথম স্কন্ধ ‘রূপ’কে তুলনা করেছেন ফেনার স্তুপের সাথে। দ্বিতীয় স্কন্ধ বেদনাকে তুলনা করেছেন জলবুদ্বুদ্ এর সাথে, সংজ্ঞাকে মরীচিকার সাথে, সংস্কারকে কদলী বৃক্ষের কা-ের সাথে এবং বিজ্ঞানকে বিভ্রমের সাথে তুলনা করেছেন। শিষ্যগণকে বুদ্ধ প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে ভিক্ষুগণ ফেনার পি-, জলবুদ্বুদ্, মরীচিকা, কদলী গাছের কা- আর বিভ্রান্তির অস্তিত্ব কতক্ষণ থাকে?’ বুদ্ধ বলেন, ‘অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এর; অন্তর্গত কিংবা বহির্গত, ভিতরের বা বাইরের; সম্পূর্ণ বা সূক্ষ্ম; উচ্চ বা নীচ; দূরের বা কাছের যে ধরনের বস্তু হোক না কেন তাকে সাধকগণ যদি ধারাবাহিকভাবে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেন বা অনুধ্যানের মাধ্যমে দেখেন তাহলে এখানে সারাৎসার বলে কিছু দেখা যাবে না। তাই বুদ্ধ পুনরায় প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে ভিক্ষুগণ! রূপ স্কন্ধে কোন্ সারবস্তু আছে?’ একইভাবে আবারো বুদ্ধের প্রশ্ন, ‘হে ভিক্ষুগণ! বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার আর বিজ্ঞানে কী সারবস্তু আছে?’
পঞ্চস্কন্ধ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার পরিধি বিস্তৃত হয়; প্রসারিত হয় জ্ঞানের দিগন্ত; চেতনা হয় উন্নত ও পরিশীলিত। পঞ্চস্কন্ধ ভাবনার দ্বারা অনিত্যদর্শনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। তখন জগতে সবকিছুর অনিত্যতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। অনিত্যজ্ঞানের মাধ্যমে সম্যক চিন্তা তথা সম্যক সংকল্প সম্পর্কে জানা যায়। অনিত্যভাবনা থেকেই ত্রি-লক্ষণের আরো দুই বৈশিষ্ট্য দুঃখ ও অনাত্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম সম্বন্ধে ধারণা জন্মলে বিদর্শনভাবনা বা অন্তর্দৃষ্টি ভাবনা শুরু হয়। মূলত পঞ্চউপাদান স্কন্ধের প্রকৃত স্বরূপ জানতে হলে বিদর্শন জ্ঞান অপরিহার্য। বিদর্শন ভাবনার মাধ্যমেই যে-কোনো জিনিসকে বাস্তবরূপে দর্শন করা যায়। বিশ্বজগতের সকল জিনিসকে যথারূপে দেখার মানে হচ্ছে জগতের সকল সংস্কার বা বস্তু-উপাদান বা স্কন্ধের অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম অবস্থা সম্পর্কে জানা। মোদ্দা কথা, বিশ্বজগৎ পঞ্চ উপাদানস্কন্ধ দ্বারা গঠিত।
আমাদের দৃষ্টি, চিন্তা-চেতনা যখন মায়া-মোহ-বিভ্রান্তি-সন্দেহের মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন আমরা যে-কোনো জিনিসকে যথারূপে দেখতে পাই না। আর এর ফলে অনিত্যদর্শন যথার্থরূপে হয় না। লোভ-দ্বেষ-মোহ, পছন্দ-অপছন্দ এগুলোর কারণে আমরা ইন্দ্রিয়-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বন্তুসমূহকে যথার্থভাবে দেখতে পাই না। এগুলোর কারণেই আমাদেরকে বিভ্রান্তি আর মরীচিকার দিকে ছুটতে হয়। সত্যের আলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। চিত্তের বিভ্রান্তি অবস্থায় অনিত্যদর্শন হয় নাÑ ত্রি-লক্ষণ অনুধাবন হয় না। বুদ্ধ তিন ধরনের বিভ্রমের কথা বলেছেন: ধারণার বিভ্রম, চিন্তার বিভ্রম ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম। বৌদ্ধদর্শনের পরিভাষায় এগুলো মূলত মিথ্যাদৃষ্টি। মিথ্যাদৃষ্টি মানুষের চিত্তকে চঞ্চল, বিচলিত ও মোহাবিষ্ট করে। ভ্রান্তিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে মন। ভ্রান্তির গ্যাড়াকলে পড়লে মানুষ ভুল ধারণা পোষণ করে- ভুল চিন্তা করে- ভুল দৃষ্টিভঙ্গিতে চলে। এতে মানুষ বিপথে যায়, বিভ্রান্ত হয়, আসল জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়। একাগ্র মনোযোগের অভাবেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথম মার্গ সম্যক সংকল্প তথা বিদর্শন ভাবনা অনুশীলনই পারে সেই মিথ্যাদৃষ্টি বা বিভ্রান্তি দূর করতে। বিদর্শনই পারে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে। জগৎসত্যের প্রকৃত অন্বেষণে যথার্থ মার্গ এই সম্যক সংকল্প। মানুষ মায়া-মোহ-বিভ্রম মিথ্যাদৃষ্টির কালো মেঘ থেকে মুক্ত হয়ে প্রজ্ঞাদৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত হতে সক্ষম হয় ঐ বিদর্শনচর্চার দ্বারাই। এ যেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সত্যের পূর্ণচন্দ্রিমার আলোক-উজ্জ্বল এক অনন্য সুষমা। সকল ঈশ্বরবাদী ধর্মে আত্মার ধারণা আছে যা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। ইহা নিঃশেষ হয়ে যায় না। আবার বস্তুবাদীদের মতে মৃত্যুর সাথে সাথেই আত্মা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বৌদ্ধদর্শনে আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মার ধারণা পোষণ করা হবে ততক্ষণ সবকিছু অনিত্য, অশাশ্বত- এ ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করবে না। অনাত্ম ধারণা আত্মার ধারণাকে তিরোহিত করতে পারে।
আমার নিজেদের জীবনের দিকে লক্ষ করলে জগতের সকল জিনিসের মধ্যে অনিত্যতার স্বরূপ জানতে পারি। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সময় তথা বয়সের সাথে সাথে আমাদের দেহের যেমন পরিবর্তন ঘটে চলেছে তেমনি মনেরও অবস্থান্তর হচ্ছে। মানবশিশু বা অন্য প্রাণীর বাচ্চা যে আকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তা কিছুদিন পর বা পরবর্তী সময়ে সে অবস্থায় থাকে না। অন্য আরেক আকৃতি ও রূপ পরিগ্রহ করে। আরও কিছুদিন পর তার অধিকতর পরিবর্তন হয়। দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, বৃদ্ধি ঘটে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। আচার-আচরণ, প্রকাশভঙ্গি, চালচলন, অঙ্গভঙ্গি সবকিছুর ক্রমাগত পরিবর্তন হয়। আস্তে আস্তে সে কথা বলতে শেখে। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন অভিব্যক্তির লক্ষণ দেখা যায়। বয়স বাড়তে থাকে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ে, প্রৌঢ় অবস্থায় থেকে বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয়। বার্ধক্য আস্তে আস্তে তাকে জরাগ্রস্ত করে। দীর্ঘ এই পরিক্রমায় তার শরীরের অনেক পরিবর্তন হয়- মনেরও পরিবর্তন হয়- ক্ষয় হয় নানা অঙ্গের। এভাবে একসময় মৃত্যুকে বরণ করতে হয়। শারীরিক ক্রিয়াকা-ের মধ্যেও ঘটে বিচিত্র পরিবর্তন। সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে থাকে। অন্যদিকে জড় বস্তুসমূহের অণু-পরমাণু বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এ বস্তুকণিকাগুলোও গঠনগতভাবে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান থেকে অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে অবস্থান্তরিত হয়ে অস্তিত্বশীল। প্রাকৃতিক নিয়মেই হচ্ছে এ পরিবর্তন। বস্তুর বা বস্তুকণার এই পরিবর্তনশীলতাই হচ্ছে জগতের নিয়ম-জগতের সত্য। এ সত্য শাশ্বত- এ বিধি চিরন্তন।
বৌদ্ধদর্শন মতে, বিশ্বজগৎ দুই ভাগে বিভক্ত- নাম ও রূপ। জীব ও জড়ের যে নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে তা রূপের অধীন। রূপের যেমন স্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি নামেরও পরিবর্তন ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। ইহা অত্যন্ত অনিবার্য সত্য- জাগতিক নিয়ম। ‘নাম’ হলো চিত্ত ও চৈতসিকের সমষ্টি। খুব দ্রুত মনের অবস্থান্তর ঘটে; ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয় চিত্ত। কোনো মুহূর্তেই স্থায়ী হয় না। একইভাবে চৈতসিকেরও পরিবর্তন ঘটছে প্রতি ক্ষণে। এক এক ক্ষণে এক এক চৈতসিক উৎপন্ন হয়। এই মুহূর্তে আমরা হয়ত সুখী, আবার পর মুহূর্তে দুঃখী হয়ে পড়ছি। এখন হয়ত এটা ভালো লাগছে, আবার কিছুক্ষণ পর ওটা ভালো লাগছেনা, আরেকটা ভালো লাগছে। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এটি অত্যন্ত বাস্তব কথা। শৈশবকালে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি না, অল্প বুঝি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেক কিছু বুঝতে শিখি। পরিণত বয়সে অনেক কিছু জানি, বুঝি ও শিখি। আবার বার্ধক্যে আমাদের বোধশক্তি কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আবার সেই শিশুদের মতো অবস্থা চলে আসে। বৃদ্ধরাও এক সময় শিশুদের মতো হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পাহাড় সমুদ্রে পরিণত হয়ে গেছে আবার সমুদ্র পরিণত হয়েছে পাহাড়ে। প্রকৃতির যা কিছুই আমরা দেখি না কেন একদিন সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে। আবার নতুন কিছু সৃষ্টি হবে। প্রকৃতির নিয়ত এই বিলয়ধর্মিতা থেকে কেউ মুক্ত নয়। ব্যবহারিক জীবনে এর প্রভাব সর্বত্র বিরাজমান। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, প্রতিবেশী সবার ক্ষেত্রে অশাশ্বত অবস্থার এই শাশ্বত বিধি প্রযোজ্য। পার্থিব জীবনে দেখা যায়- মিত্র শত্রু হচ্ছে, শত্রু মিত্র হচ্ছে। শত্রু পরম আত্মীয় হচ্ছে, আবার পরম আত্মীয় শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। সংসারে প্রেম-প্রীতি, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, ¯েœহ-মমতা, শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ কোনো কিছুই একই রূপ ও অবস্থায় স্থায়ী থাকছে না। কিছু সময় পরেই আরেক রকম অবস্থা বা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এক সময়ের চরম অপছন্দের বিষয় আরেক সময় পছন্দের বিষয় আবার এক সময়ের পছন্দের জিনিস আরেক সময় অপছন্দের বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। অনেক দিনের প্রিয় কোনো জিনিস নিমিষেই হারিয়ে যেতে পারে বা নষ্ট হতে পারে। কত কিছুকে আমি আমার বলে দাবি করছি। অথচ যে কেনো সময় ইহা আমার নিয়ন্ত্রণ কিংবা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। তাহলে আমার বলে দাবি করি কীভাবে? আমার দেহ বা মনটাই আমার নয়। আমার হলে তো আমার কথামতো চলতো- আমার নিয়ন্ত্রণে থাকতো। মৃত্যুর পর এই ‘আমার’জিনিসগুলো কি আমার সাথে শ্মশানে যাবে? না যাবে না। তাহলে এগুলো কীভাবে আমার? কত দামী জিনিস, পছন্দের দ্রব্যসামগ্রী, সোনা-গহনা, অলংকার, আসবাবপত্র, মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ, এসি, ঘরবাড়ি, অট্টালিকা, গাড়ি, অফিস-আদালত, টাকা-পয়সা, জমিজমা, অর্থবিত্ত, ব্যাংক ব্যালেন্স, রাজপ্রাসাদ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবারদাবার সবকিছু মুহূর্তের মধ্যেই আমি হারাতে পারি কিংবা অন্য কেউ নিয়ে নিতে পারে বা ধ্বংস হতে পারে। অনেক কষ্টে অর্জিত নাম-যশ-খ্যাতি-সুনাম-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-প্রতাপ-প্রভাব-অর্থবিত্ত-ভূসম্পত্তি এক নিমিষেই বিলুপ্ত হতে পারে। কত বড় বড় সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে! ইতিহাস পাঠ করলেই জানা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। আবার একজন সাধারণ মানুষ অনেক বড় ক্ষমতা ও বিত্তশালী হতে পারে। রাজা ভিখারী হতে পারে, ভিখারী আবার রাজা হতে পারে। অনেক প্রত্যক্ষ ঘটনার অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মনে থাকে না। সবকিছু আমরা একই সময়ে মনে ধারণ করতে পারি না। সময়ের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় প্রতি মুহূর্ত, প্রতি ক্ষণ, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস, বছর হিসেবে এক এক করে চলে যাচ্ছে। অতীত হয়ে যাওয়া মুহূর্ত আর কখনো ফিরে আসছে না। এই পরিবর্তনশীলতা ও নশ্বরতাকে রুখবার সাধ্য কারো নেই। কাজেই আমরা সবাই অনিত্যতার অধীন। ইহা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়- জড়ৎ ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনিত্যতা বিরাজমান। সব সত্তাই অশাশ্বত- সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী- সবকিছু একটা নির্দিষ্ট সময়কালের। জড় জীব সবার জন্যই এ সত্য প্রযোজ্য।