আবুল কালাম বেলাল: অমিত বড়ুয়া আপাদমস্তক একজন শিশুসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ কম বেশি লক্ষ্য করা গেলেও মূলত তার ধ্যান–জ্ঞান কিশোর কবিতা। তিনি স্বল্পভাষী, ভালো মনের মানুষ। কিছুটা প্রচারবিমুখও বটে। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তিনি যেভাবে কাব্য চর্চায় নিবিষ্ট থেকেছেন তাতে আমরা চমকিত হই। লিখেছেন যত না তার চেয়ে ঢের পড়েছেন। কম লিখেও পাঠক–মনে অতি সহজে ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন এ কবি। দৃঢ়চেতা, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ঘরানার এ মানুষটির সৃজনশীলতা অনন্য। চলনে বলনে অত্যন্ত সাদাসিধে তবে কথনে তিনি স্পষ্টভাষী। বৈষয়িক, আভিজাত্যে এতটুকু মোহ নেই। আবার না পাওয়ার হাহাকারও তাকে স্পর্শ করে না। তিনি ভালোবাসার কাঙাল। তার চাওয়া পাওয়া কেবল মানব হৃদয়ে ঠাঁই। তাই তিনি জীবনবোধের গভীরে ডুব দিয়ে কাব্য সৃষ্টির মাধ্যমে মানব–মন জয়ে সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর কাব্য তিনি সংযত আবেগ, অপার কল্পনা, ছন্দ বিভায় শব্দ চয়নে পঙক্তিমালা রচনা করে চলেছেন। রসগ্রাহী, শিল্পমানসম্পন্ন কবিতার বই বের করে জয় করে নিয়েছেন পাঠক–হৃদয়।
মন–জয় করা তেমনি একটি গ্রন্থ ‘ছুটির বাঁশি’। এটি একটি কিশোর কবিতার বই। কিশোর কবিতা আন্দোলনে দেশের যে ক’জন কবি সরব তাদের মধ্যে অন্যতম একজন অমিত বড়ুয়া। শিশুসাহিত্যে নিবেদিত একজন নিষ্ঠাবান লেখক। তিনি তিন সন্তানের জনক। এক সন্তান ‘ছুটির বাঁশি’। অন্য দু’সন্তান ‘যখন বাজে ছুটির ঘন্টা’ (কিশোর কবিতাগ্রন্থ) ও ‘ভরদুপুরে বাঁশির সুরে’ (ছড়াগ্রন্থ) । তাঁর প্রতিটি বই–ই সুখপাঠ্য ও নান্দনিক। আমরা এখানে ‘ছুটির বাঁশি’ গ্রন্থটি আলোচনার চেষ্টা করব।
ছুটির বাঁশি মানে আনন্দ। যেমনণ্ড গোঁফ খেজুরে বললে আমরা বুঝি অলস কিংবা আমড়া কাঠের ঢেঁকি বললে অপদার্থ। ঠিক তেমনি ছুটির বাঁশি মানে আনন্দ। শিশু–কিশোররা মূলত আনন্দপ্রিয়। তারা খেয়াল খুশির রাজা–রানি। তাদেরকে আনন্দের মধ্য দিয়ে বোঝাতে হয়, শেখাতে হয়। কবি অমিত বড়ুয়া তাই আনন্দ ভোজের মধ্য দিয়ে শিশু–কিশোরদের জ্ঞানের আলোয় রাঙাতে চেয়েছেন। তাই গ্রন্থে ভুক্ত করেছেন আনন্দধর্মী ১৯টি কবিতা। মোট ২১টি কবিতার মধ্যে কেবল দুটিণ্ড লাশের মিছিল ও আজও ডেকে যাইণ্ড বেদনার। বাকি কবিতাগুলো রঙিন ও জমকালো। প্রতিটি কবিতাই নন্দনশৈলীতে নির্মিত, সহজপাঠ্য ও সাবলিল। কয়েকটি কবিতাতো একেবারে অনবদ্য। ছন্দের ঝংকারে এতটুকু খাদ নেই। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ তাঁর কবিতা বিষয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘নিখুঁত ছন্দ ও অন্ত্যমিল, অনুপম শব্দ–কুশলতা ও সহজ–সরল প্রকাশভঙ্গি তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।’
আলোচ্য গ্রন্থে গ্রন্থিত কবিতার মধ্যে আমাদের বাড়ি, বাংলা ভাষা, টইটম্বুর ও আমার দেশ– এ চারটি কবিতা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। স্বরবৃত্তে তৈরি বাকি কবিতাগুলো– লাশের মিছিল, দুপুর রাতে, একটু দেখে যা, বর্ণমালা, মেঘের মতো, আজও ডেকে যাই, যুদ্ধ শেষে, রান্নাবাগিশ, কর্ণফুলী, রঙের তুলি হাতে নিয়ে, ইচ্ছেঘুড়ি, ছুটির দুপুর, বর্ষা দুপুর, সবুজ নিমন্ত্রণ, ইচ্ছে আমার,আনবে বলে এবং ছুটির বাঁশি। আঙ্গিকগত বৈচিত্র্য আহামরি না হলেও গঠনশৈলীতে মুন্সিয়ানায় থাকায় কবিতাগুলো মনোগ্রাহী ও মনস্পর্শী। বিষয় বৈচিত্র্যে নতুনত্বের ছোঁয়া পাই। তাঁর শব্দ চয়ন আরোপিত নয়, অন্ত্যমিল নিখুঁত, চিত্রকল্পে রয়েছে প্রচণ্ড কল্পনাশক্তি। তিনি কবিতায় কিছু গ্রামীণ ও প্রাচীন শব্দের আধুনিকায়ন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
যেমন–
‘কলাপাতা দোলে যেন মা’র ডুরে শাড়ি
হাজারো স্বপ্নঘেরা আমাদের বাড়ি
মিঠে রোদ হাওয়া এসে
কথা বলে ভালোবেসে
উঠোনের এক কোণে ফুটে আছে জুঁই
স্বপ্নেরা খেলা করে এখানে নিতুই।’ (আমাদের বাড়ি)
এখানে নিতুই শব্দটি গ্রাম্য। অথচ কী চমৎকারভাবে তিনি শব্দটি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। আরেকটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘তটিনী’ কিভাবে প্রয়োগ করেছেন দেখে নেওয়া যাক।
‘এই ভাষা পাখিদের এই ভাষা গানের
এই ভাষা বাঙালির জাগরিত প্রাণের
মধুর এ ভাষা
আশা ভালোবাসা
এই ভাষা তটিনীর সুললিত তানের।’ (বাংলা ভাষা)
শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে
সচেতন না হলে কবিতা অনেক সময় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষিতে অমিত বড়ুয়া সফল। তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ যুক্তিযুক্ত, স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। ব্যবহৃত উপমাগুলোও মজার এবং যুতসই। যেমন–
‘দুপুর দুপুর তপ্ত দুপুর
বাইরে আগুন জ্বলে,
সূর্যটা মোমবাতির মতো
স্বর্ণ হয়ে গলে।’ (ছুটির দুপুর)
এখানে সূর্যকে মোমবাতি আর রোদকে স্বর্ণের উপমায় চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন। আবার চিত্রকল্প অঙ্কনেও তিনি পারঙ্গম। তার শক্তিমত্তা কতটুকু উদাহরণ দেয়া যাক–
‘ইচ্ছে আমার ইচ্ছেগুলো
ছোট্টবেলার কিসসেগুলো
অমূল্য সব হীরে মানিক
নয় তো মোটেই পথের ধুলো।’ (ইচ্ছে আমার)
ছোট্টবেলার যে গল্প আমরা শুনি তা মোটেই পথের ধুলো নয়। সব অমূল্য হীরে মানিক। এমন দর্শন বা পর্যবেক্ষণ কবির অসম্ভব কল্পনা শক্তিকেই পরিচয় করিয়ে দেয়।
কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় মন যেমন আনন্দে আলোড়িত হয়, কাঁঠালচাপার গন্ধে বুক যেমন ভরে ওঠে অমিত বড়ুয়ার কবিতাগুলোও তেমন। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো আমাদের রঙধনুর মতো বর্ণিল আনন্দে মুগ্ধ করে। কখনো গ্রামের বাড়িতে মন ছুটে গেছে, কখনো বুবুর স্মৃতি কাতরতায় ভারাক্রান্ত হয়েছি, কখনো বা শৈশবের দুরন্ত বালক। আবার কখনও আন্দোলন সংগ্রামের সাহসী ছেলে। স্বজন হারানোর ব্যথায় শোকে চোখ ভিজিয়েছি। অনাথ শিশুর প্রতিমা হয়েছি। তাকে উদ্ধৃত করা আমার কথাগুলোর যথার্থ প্রতিধ্বনি শুনুন।
‘অনেক আলোর রঙে রাঙা ছুটির বাঁশির সুর
আমায় নিয়ে কোথায় যাবে কোন সে অচিনপুর?
যদিও বাঁশি সুর হারিয়ে খাচ্ছে এখন খাবি
সে কি আবার ফিরে পাবে স্বপ্নলোকের চাবি?
হয়তো বাঁশি হারিয়ে যাবে অনেক অনেক দূরে
সুর হারানো অজানা এক সুরের সুমুদ্দুরে।’ (ছুটির বাঁশি)
সবশেষে অমিত বড়ুয়ার সৃষ্টিশক্তি ও কাব্যশক্তির অনন্য উদাহরণ টানতে চাই। দেশ বরেণ্য কবি আল মাহমুদ–এর জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’। আগে গ্রন্থের শিরোনামের কবিতাটি চকিতে পড়ে নিই।
‘আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল
বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল–
পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ
রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।
…………………………………….
কি আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।’ (পাখির কাছে ফুলের কাছে)
জনপ্রিয় এ কবিতাকে সামনে রেখে আরেকটি কবিতা রচনা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অসম্ভব শক্তিশালী না হলে একই বিষয়ে স্বতন্ত্র কবিতা–নির্মাণ খুবই কষ্টকর। এক্ষেত্রে কবি অমিত বড়ুয়া অত্যন্ত সফল।
তিনি লিখেছেন–
‘দূরের আকাশ, নদীর স্রোত আমায় ডেকে বলে
ভয় পেয়ো না বন্ধু, তুমি ভুলো ঘরের কথা
নিয়ম ভাঙার কাজে এমন ভয় পেলে কি চলে?
তুমি ছাড়া ভাঙবে কে আর রাতের নীরবতা।
তাদের কথায় তাইতো আমি ভয়ের কথা ভুলি
আকাশ নদী ফুলের কাছে মনের খাতা খুলি।’
এ কবিতায় প্রতিটি পঙ্ক্তির পরতে পরতে কবি আকর্ষণীয় উপমা, চিত্রকল্প,ছন্দের কারুকাজ চমৎকারভাবে বিম্বিত করেছেন। অনুপ্রাসের, ব্যঞ্জনার ঝুমঝুমিও বাজিয়েছেন। ‘ডালিম গাছের লালিম গালে শিশির কণা ঝরে’। এভাবেই কবি অমিত বড়ুয়া দরদিমন দিয়ে, স্নেহের পরশ বুলিয়ে প্রতিটি কবিতা নির্মাণ করেছেন। আমরা আগামীতে কবির আরো অভিনব, কালজয়ী ও ক্ল্যাসিক্যাল লেখা প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত এ গ্রন্থের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি। গ্রন্থটির মনোরম প্রচ্ছদ ও ছবি এঁকেছেন শিল্পী আজিজুর রহমান। দাম ৬০ টাকা।