ছড়াসম্রাট সুকুমার বড়ুয়া
উৎপল কান্তি বড়ুয়া
অসময়ে মেহমান / ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার / যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন;
ঠিক আছে! ঠিক আছে!
রেশনের পচা চাল / টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙাচোরা / বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে! ঠিক আছে!
মেঘ দেখে মেহমান / চাইলেন ছাতাখান
দেখালাম ছাতাটার / শুধু ক’টা শিক আছে
তবু তিনি বললেন:
ঠিক আছে! ঠিক আছে!
সুকুমার বড়ুয়ার ‘ঠিক আছে’ শিরোনামের এই বিখ্যাত ছড়াটা নিশ্চয়ই তোমরা কখনো না কখনো পড়েছ, শুনেছ আশা করছি।
আমাদের সকলের প্রিয় সুকুমার বড়ুয়া। ছড়ার মুকুটহীট সম্রাট সুকুমার বড়ুয়া। ছড়ার রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সর্বানন্দ বড়ুয়া, মাতা কিরণ বালা বড়ুয়া। ১৯৪৩ সালে তাঁর বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং মাতা ১৯৬১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সহধর্মিণী ননীবালা বড়ুয়া। বিবাহকাল ১৯৬৪ সাল। তাঁর তিন মেয়ে চন্দনা, রঞ্জনা ও অঞ্জনা এক ছেলে অরূপ রতন বড়ুয়া।
তাঁর বাবা, সর্বানন্দ বড়ুয়া হাট-বাজারে সওদা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পুত্র সন্তানের জন্য তিনি পর পর চারবার বিয়ে করেন। সুকুমার বড়ুয়া হচ্ছেন তার ত্রয়োদশ সন্তান এবং প্রথম ও একমাত্র পুত্র সন্তান। সুকুমার বড়ুয়ার বয়স যখন পাঁচ বছর ঠিক সে সময়ই ১৯৪৩ সনে দুর্ভিক্ষের সময় পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে না পারার অপরাধবোধ থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হন। তখন থেকে মা কিরণবালার পরিবারে নেমে আসে অনটনের কালো রাত।
মামাবাড়ি রাউজানের উত্তর গুজরা গ্রামে অক্ষরজ্ঞান থেকে ১ম শ্রেণি পর্যন্ত অবস্থান করেন তিনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি পড়াকালীন বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে থেকে লেখাপড়া করেন। মামাবাড়ি এবং দুই-তিনটা বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করে আড়াই শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক লেখাপড়া তাঁর। তৃতীয় শ্রেণি শেষ করতে পারেননি। তাই তিনি সবসময়ই বলে থাকেন-“আমি আড়াই ক্লাস পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি।”
কৈশোর কালটাতে বেঁচে থাকার জন্যে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন তিনি। থাকা খাওয়া ও অর্থের বিনিময়ে বাসায় কখনো শিশু দেখাশুনার কাজ, কখনো মেসে বসবাসকারীদের রান্নবান্না করে দেওয়ার কাজ, কখনো চা দোকানে বয়, মাটি কাটার কাজ, নুনের গোলার জোগালির কাজ, কখনো হকারি, কখনো বা আইসক্রিম বিক্রি করেছেন।
ছেলেবেলায় মনসার পুঁথি শুনে শুনে তাঁর মনে ছন্দের হাওয়া দোলা দেয়। সুরের জোছনায় সৃষ্টির আলোর বান ডাকে তাঁর ভেতরে। মামাবাড়িতে ১৯৪৩ সালে যোগীন্দ্রনাথের ‘হাসি খুশি’ , গ্রামে পুঁথি পাঠ মুগ্ধ হয়ে শুনা, চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাবু মনমোহন তালুকদারের বাসায় শিশুকে সঙ্গ দেওয়ার কাজের ফাঁকে ফাঁকে (১৯৫০-১৯৫৪), সুনির্মল বসুর ‘হুলুস্থূল’ মুখস্থ করা ও বিভিন্ন পত্রিকা পাঠ, কলকাতার দেবসাহিত্য কুঠিরের শিশু সাহিত্য ও দৈনিক আজাদের ‘মুকুলের মাহফিল পাঠ এবং বিভিন্ন পত্রিকার ছোটদের আসর পড়তে পড়তে লেখক সত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর মধ্যে।
তাঁর ছেলেবেলায় লেখাপড়া করতে না পারার কষ্ট থেকে এবং বাস্তব জীবনের কঠিন চালচিত্রের নমুনা স্বরূপ তাই তিনি হয়তো লিখেন-
ইসকুলে পড়া হয়নি তেমন
ভাগ্য ছিল যে মন্দ
নেশা ছিল তাই যেখানে যা পাই
পড়াটা হয়নি বন্ধ।
কত যে ভাবনা কত যে ঘটনা
মনে পড়ে কিছু তার
হারানো দিনের সেই ছেলেবেলা
ফিরে আসবে কি আর?
১৯৬০ সালে ডিপি বড়ুয়া (ঢা.বি.’র ছাত্র, পরবর্তীতে বাসস প্রধান) সহ আরো ছয়জনের মেসে মাসে ৩৫ টাকা মজুরিতে রান্নাবান্না করে দেওয়ার কাজ নেন। ১৯৬২ সালে ০৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের স্টোরকিপার এর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালের ০৩ জুলাই, দৈনিক সংবাদ এর ‘খেলাঘর’ এর পাতায়। প্রকাশিত প্রথম ছড়ার শিরোনাম ‘বৃষ্টি নেমে আয়’। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘পাগলা ঘোড়া’ ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
তাঁর প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সংবর্ধনা / সম্মাননা ও পুরস্কারের মধ্যে হলো- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার -১৯৭৭, ঢালী মনোয়ার স্মৃতি পুরস্কার- ১৯৯২, বৌদ্ধ একাডেমী পুরস্কার- ১৯৯৪,বাংলাদেশ শিশু, একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ সম্মাননা-১৯৯৭,অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৭ ও ২০০৯, জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা-১৯৯৮, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৯, ভারত থেকে চোখ সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৯৯ সালে, শিশুসাহিত্যে নন্দিনী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব পুরস্কার পান-২০০০ সালে, শিরি এ্যাওয়ার্ড পান-২০০৫, শব্দপাঠ পদক-২০০৬,
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সম্মাননা-২০০৬, অবসর সাহিত্য পুরস্কার-২০০৬, মোহাম্মদ মোদাব্বের- হোসনে আরা স্মৃতি পুরস্কার-২০০৭, লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক-২০০৭, লিমেরিক সোসাইটি পুরস্কার-২০০৯, রাউজান ক্লাব সংবর্ধনা-২০০৯, কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার -২০১০, অনোমা সম্মাননা গ্রন্থ ও সংবর্ধনা-২০১১, চট্টগ্রাম সমিতি সম্মাননা-২০১২, বীরপ্রসূ পত্রিকা সম্মাননা-২০১২, আনন ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা -২০১৩, চন্দ্রাবতী শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০১৪, আমিন জুয়েলার্স গুণীজন সম্মাননা-২০১৬, এবং সর্বশেষ তিনি লাভ করলেন একুশে পদক -২০১৭
লেখার সংখ্যা তার সহস্রাধিক। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সংবর্ধনা, সম্মাননা ও ক্রেস্টের সংখ্যা ৬০টি। বিশেষ সম্মাননা ৭০এর অধিক। তাঁকে নিয়ে ছড়াসহ বিভিন্নভাবে লেখালেখি করেছেন দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা লেখকসহ ১২০ জনেরও অধিক। ১৯৭৮ সাল থেকে একাধিক লেখা বিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে তাঁর। বর্তমানে নার্সারিতে ‘এমন যদি হত’ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ‘শব্দ দূষণ’ পাঠ্য রয়েছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো- পাগলা ঘোড়া ১৯৭০ বাংলা একাডেমী, ভিজে বেড়াল ১৯৭৬ মুক্তধারা, চন্দনা রঞ্জনার ছড়া ১৯৭৯ মুক্তধারা, এলোপাতাড়ি ১৯৮০ বাংলা একাডেমী , সুকুমার বড়ুয়ার, ১০১টি ছড়া ১৯৯১ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, চিচিং ফাঁক ১৯৯২ ওলটপালট প্রকাশনী, কিছু না কিছু ১৯৯৫ বিশাখা প্রকাশনী, প্রিয় ছড়া শতক ১৯৯৭ মিডিয়া প্রকাশনী, বুদ্ধ চর্চা বিষয়ক ছড়া ১৯৯৭ ভিক্ষু সনন্দপ্রিয়’র সৌগত থেকে প্রকাশিত, ঠুসঠাস ১৯৯৮ প্রজাপতি প্রকাশন, নদীর খেলা ১৯৯৯ শিশু একাডেমী, আরো আছে ২০০৩ আরো প্রকাশন, ছড়া সমগ্র ২০০৩ সাহিত্যিকা, ঠিক আছে ঠিক আছে ২০০৬ প্রবাস প্রকাশনী, লন্ডন, সম্পূর্ণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ছড়াগ্রন্থ, কোয়াল খাইয়ে ২০০৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে, ছোটদের হাট ২০০৯ বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, লেজ আবিস্কার ২০১০ প্রথমা প্রকাশনী , সুকুমার বড়ুয়ার ছড়াসম্ভার -১ ও ২ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে, নান্দনিক প্রকাশন থেকে, এমন যদি হত ২০১৬ তুষার ধারা প্রকাশন সহ মোট ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
তিনি যে সব সংগঠনে আছেন সেগুলো হলো-
ফেলোঃ ১০৬ -বাংলা একাডেমি,
উপদেষ্টাঃ চট্টগ্রাম একাডেমি,
মধ্যম বিনাজুরি সুকুমার তরুণ সংঘ, ব্র্যাক, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, কেন্দ্রীয় কচিকণ্ঠের আসর ও একাধিক বৌদ্ধ পত্র-পত্রিকা।
প্রতিষ্ঠাতাঃ মধুমাছি খেলাঘর আসর ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-১৯৭৯), সুকুমার শিশু পাঠাগার- (২০০২ ) নিজ পৈতৃক নিবাসে তিনি তা প্রতিষ্ঠা করেন।
সুকুমার বড়ুয়া প্রতিভাবান আধুনিক স্বতন্ত্র চারিত্র্য- বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সমকালীন জীবন ও সমাজমনস্কতা তাঁর ছড়ার প্রধান উপজীব্য। তবে পরিহাস প্রবণতা ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক উপাদানেও তাঁর ছড়া সমৃদ্ধ। শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা আর শিশু-মনস্তত্ত্ব সংলগ্নতাও তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ। এভাবে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে তাঁর ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য রীতিমত বিস্ময়কর মনে হয়।
তাঁর ছড়া সহজাত সাবলীল। তাঁর ছড়ায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। আছে ছন্দের দ্যোতনা, সুরের ঝরনার কলকল বয়ে চলা। তাঁর ছড়ায় অন্ত্যমিল যেমন, মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের মুন্সিয়ানাও উপভোগ করার মতো।
যেমন-
রাসবিহারী দাসের নাতি
হাসাপাতালে বাস করে
মাস ফুরালেই দেশে গিয়ে
খাস জমিতে চাষ করে।
পাশ করেনি পরীক্ষাতে
পয়সা কড়ি নাশ করে
হাতের কাছে কাউকে পেলে
চড় মেরে দেয় ঠাস করে।
সুকুমার বড়ুয়া একজন নির্লোভ, নিরেট ভদ্রলোক। তিনি রাগেন না কখনো। উচ্চ বাক্যে কথা বলা তাঁর ধাঁচে নেই। তিনি অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় লোক। তাই বলে তিনি যে একেবারে চুপ বসে থাকেন তা নয়। তাঁর বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন সময়, সমাজের অসঙ্গতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের খোলশ উন্মোচন করেছেন রূপকের আশ্রয়ে, যেমন-
শিয়াল নাকি লোভ করে না
পরের কোনো জিনিসটার
কি পরিচয় দিলো আহা
কি সততা কি নিষ্ঠার!
তাই সে হলো বনের মাঝে
এডুকেশন মিনিস্টার।
উদাহরণ দিলে অসংখ্য ছড়া পাওয়া যাবে যেগুলোতে ছড়াশিল্পী সুকুমার বড়ুয়ার দক্ষতা, সৃষ্টিশীলতা ও উৎকর্ষের ছাপ নিমিষেই পাওয়া যাবে।
সুকুমার বড়ুয়া’র ছড়া শিশুতোষ যুবতোষ ও বৃদ্ধতোষ এক কথায় তাঁর ছড়া ছোটদের বড়দের সকলের।
পুরো একটি জীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে ছড়ার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আজ তিনি সত্যিকার অর্থে ছড়ারাজ্যের সুকুমার।
সুকুমার বড়ুয়াকে নিয়ে দেশের খ্যাতিমান কবি আসাদ চৌধুরীর কথার উদ্বৃতিটি তাই এখানে উল্লেখ করতে চাই- “ছন্দ যেন তার ভিটেবাড়ির প্রজা, যেমন খুশি ব্যবহার করছেন, হাসানোর জন্য চটানোর জন্য, রাগিয়ে দেয়ার জন্য, কী কাঁদাবার জন্য। অসম্ভব ক্ষমতা থাকলেই অতো সহজেই সমিল ছড়া ও কবিতা লেখা সম্ভব। মিল খোঁজার জন্য তাঁকে বোধ হয় কোনোদিনই নিজের চুল ছিঁড়তে হয়নি। সুকুমার বড়ুয়ার পরিচয় তিনি আমাদের এক শ্রদ্ধেয় ছড়াকার। এ কথা কে না কবুল করবেন। কবি না হলে এমন ছড়া লেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। না, আজ পর্যন্ত এমন একটি কাব্য সংকলন চোখে পড়েনি যেখানে আমার প্রিয় ছড়াকারের রচনা সম্মানের সঙ্গে আসন পেয়েছে। সুকুমার বড়ুয়ার জন্য আমাদের একজন বুদ্ধদেব বসু বড়ো প্রয়োজন।”
সুকুমার বড়ুয়া আমাদের গর্ব। আমাদের অহংকার। তাঁর সুস্থ-নিরোগ দীর্ঘ জীবন কামনা করি। জয়তু সুকুমার বড়ুয়া।
শেয়ার করুন