কালের আবর্তে বিলুপ্ত হতে চলেছে দিনাজপুরের ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার।
এই নিদর্শনকে ঘিরে রামের পত্নী সীতাকেও নিয়ে রয়েছে কল্পকাহিনী। সীতাকে পঞ্চবটীর বনের গভীরে বনবাস দিয়ে তার থাকার জন্যে তৈরী করে দেয়া হয়েছিল একটি কুঠির যা কিনা সীতার কোট নামে খ্যাত। আসলে সীতার সঙ্গে এই বিহারের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। ১৯৬৮ ও ১৯৭২ সালে দু-দফায় আংশিক খননের পর দেখা গেছে এটা একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ছিল। প্রত্মতত্ত্ব অনুসন্ধানকারী একটি দল একই অভিমত করেছেন।
জানা গেছে, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে তার রাজ্যের মধ্যে ৮৪ হাজার স্তুপ ও স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ওই সময় থেকে শুরু করে ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত উত্তর বঙ্গে বহু বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হয়। যার একটি ছিল আলোচিত এই সীতার কোট বৌদ্ধ বিহার। নবাবগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে পশ্চিম দিকে বিরামপুরগামী রাস্তার উত্তর পার্শ্বে গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের ফতেপুর মাড়াষ মৌজার প্রায় ১ একর ভুমির উপর এই বিহার অবস্থিত।
প্রাপ্ত তথ্য জানা যায়, এই বিহার পূর্ব পশ্চিমে লম্বা ২১৪ ফুট, উত্তর দক্ষিন প্রস্ত ২১২ ফুট। শৌচাগার ছাড়া ছোট বড় কক্ষের সংখ্যা ৪১টি। বেষ্টনী প্রাচীর সাড়ে ৮ ফুট, সামনে প্রাচীর ৫ ফুট, বারান্দা ৮ ফুট, বারান্দার সামনের প্রাচীর ৫ ফুট প্রশস্থ। কক্ষে প্রবেশের পথ ৩ থেকে ৫ ফুট প্রশস্থ। মূল প্রবেশ পথ উত্তর দিকে। প্রবেশের পথের মুখের দু’পার্শ্বে পাশাপাশি ২টি করে ৪টি কক্ষ আছে। পাটিশন প্রাচীরের প্রশস্থ ৪ ধরনের। ১৩ ফুট ৫ ফুট ও ৪ ফুট। বিহারের ভিতরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি কুপ ছিল। বর্তমানে কুপটি ভরাট হয়ে গেছে। বিহারের বাইরে পুর্ব-দক্ষিণ দিকে পাশাপাশি অবস্থিত ৫ টি কুটির দেখা যায়। সম্ভাবত এগুলো টয়লেট হিসেবে ব্যবহার হত। মূল মন্দির ছিল দক্ষিণ দিকের মাঝখানে। প্রত্যেক কক্ষের সামনের দেয়াল ব্যতিত বাকী ৩ দেয়ালে তাক কুলঙ্গী ছিল। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশের একটি মাত্র পথ আছে।বিহারের ৪ কোনায় ৪টি কক্ষে বেশ লম্বা পশ্চিম দিকে মাঝের অংশে রয়েছে একটি বড় কক্ষ। তার দক্ষিণে পার্শ্বের কক্ষটি খুব ছোট। এর কোন প্রবেশ পথ নেই। সম্ভবত এই টি গুপ্ত কক্ষ ছিল। সমগ্র ইমারতের গাঁথুনী লম্বা মধ্যম ও ছোট ইট এবং চুন সূরকী দ্বারা নির্মাণ শৈলী দেখে গবেষকগণ অনুমান করেন এ বিহার পশ্চিম শতাদ্বি কিংবা তার কিছু আগে নির্মিত হয়েছিল। বিহার খননের পরে বা আগে যে সব দ্রব্য পাওয়া গেছে তা হলো নানা ধরনের হিরার বাইশ, মাটির পাত্রের ভাংগা অংশ, মাটির দোয়াত, লোহার পেরেক, নকশা করা মাটির তৈরী মাছ, মাটির পুতুল নকশা ইট, লোকেশ্বর পাদ্যুপানী ও মজুশ্রী রোজ নির্মিত দুইটি মুর্তি সহ লোহার রিং, ও রড। বিহারের পূর্ব দিকে প্রায় ৫শ গজ দুরে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে। যা শালদীঘি নামে পরিচিত। সেখানে বর্তমানে একটি আশ্রয় কেন্দ্র করা হয়েছে এবং দীঘিটি একজন সরকারী কর্মচারীর আওতায় লিজ রয়েছে। পশ্চিম দিকে একটু বেশী দুরত্বে একটি পুকুর ছিল। এখন তা নেই। উত্তর দিকে জঙ্গলের ওপাড়ে একটি ছোট নিচু জমি দেখা যায়। সম্ভাবত সেখানে পুকুর বা জলাশয় ছিল। এই বিহার খননের পূর্ব কথা যা জানা যায় বিহারের উত্তর দিকে মাড়াষ গ্রামে মহিরউদ্দিনের পুত্র তালেব আলীর বাস। তালেব আলী বিহারের পার্শ্বে জমি চাষ করতে গিয়ে একটি জরাজীর্ণ ধারালো অস্ত্র (বাইশ) পান। বাড়ীতে নিয়ে ধার দিয়ে তা গৃহস্থালীর কাজে লাগান তালেব আলী। এ ধারালো অস্ত্র দ্বারা ২/১ কোপে বনের বড় বড় শাল গাছ কাটা যেত। বন বিভাগের লোকেরা তা মোটেও টের পেত না। এমতাবস্থায় একদিন ধরা পড়ার পর তালেব আলীকে জিজ্ঞাবাদের এক পর্যায়ে বন বিভাগের লোককে ওই ধারালো অস্ত্র দেখায়। বন বিভাগের লোক দেখে অস্ত্র পছন্দ করছিল না পরে তার কাছ থেকে নিয়ে তা পরীক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। পরে জানা যায় অস্ত্রটি ছিল হিরার তৈরী বিষয়টি জানাজানি হলে আরও মুল্যবান প্রতœ তত্ত্ব মিলতে পারে বলে দিনাজপুর জেলা পরিষদ নিজস্ব অর্থে বিহার এলাকা খননের উদ্যোগ গ্রহন করেন। চাকুরী দেয়া হয় তালেব আলীকে ওই বিহার পাহারা দেয়ার । তালেব আলী কয়েক বছর আগে স্বাভাবিক মৃত্যু বরন করে। বর্তমান বিহারের পশ্চিম পার্শ্বে বিহার সংলগ্ন গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাদরাসা। এলাকার লোকজন জানালেন বিহারের দু-পার্শ্বে দুইটি সাইন বোর্ড ছিল যা চুরি হয়েছে এখনও বিহারের ইট চুরি হয়। বর্তমানে প্রতœ তত্ত্ব বিভাগ নতুন একটি সাইন বোর্ড তৈরি করেন। বিহারের জায়গা অনেকে জবর দখল করে খায়। বিহারের ইমারতের জায়গা ছাড়া কিছু জায়গা চাষাবাদের জন্য পত্তন দেয়া হয়। কিন্তু কেউ কেউ সেগুলোতে বসতবাড়ী করেছে। তবে যারা বাড়ী করছে তা তাদের নিজস্ব জমি বলে দাবী করছে। এলাকা বাসী বলছে, বিহারটি সংস্কার করে দর্শনীয় স্থান হিসাবে গড়ে তোলা যেতে পারে । হতে পারে পিকনিক কর্ণার । যা থেকে আসতে পারে সরকারের প্রচুর রাজস্ব আয়।