বিবর্তন ডেস্ক: নারী জাগরণের বাতিঘর , ভাষা সৈনিক, আজীবন শিক্ষাব্রতী প্রতিভা মুৎসুদ্দি বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন । ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ইং বাংলা একাডেমীর আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ হল এ বিকেল ৩ টায় তাকে এ ফেলোশিপ প্রদান করা হবে ।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান থানার মহামুণি পাহাড়তলী গ্রামে। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি, বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি। তাঁদের পাঁচকন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে তৃতীয় প্রতিভা। প্রতিভার জন্মদিনটি ছিল বেশ নাটকীয়। ইতোমধ্যে মুৎসুদ্দি পরিবারে পর পর দুই কন্যা এসেছে। এবার একটি পুত্রসন্তানের আকাক্সক্ষা। প্রতিভা যখন মায়ের গর্ভে তখন ঠাকুরদা প্যারীলাল মুৎসুদ্দি স্বপ্ন দেখলেন তাঁর মৃত জেঠামশায় বাড়িতে এসেছেন। তিনি এই স্বপ্নের অর্থ করে নিলেন এবার তার বংশে পুত্রসন্তান আসছে। ঘটনার দিন হাতে ঘড়ি পরে আকুল আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন, ইচ্ছে সবার আগে বংশধরের মুখ দেখবেন। নবজাতকের কান্না শুনে সবাই উৎফুল্ল হলেন। ধাত্রী এসে বখশিশ চাইলে ঠাকুরদা পকেটে হাত দিতেই ঠাকুরমা গিয়ে মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘রেখে দাও তোমার বখশিশ। ধুতির দোকানে আর যেতে হবে না, শাড়ি গহনার দোকানে যাও।’ ঠাকুরদার বিরাট আশাভঙ্গ। তিনি মনের কষ্টে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
মায়ের কাছে এই গল্প শুনে প্রতিভা প্রশ্ন করেছিল, কেন মেয়েরা কী মানুষ নয়? মা বলতেন, তোমরা দেখিয়ে দাও সত্যিকারের মানুষ হলে ছেলেমেয়ে দুই-ই সমান। প্রতিভা তার ঠাকুরদার প্রত্যাশা মতো বংশধর না হলেও তিনিই বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। নিরন্তর কাজ করেছেন মানুষের জন্য। জীবনে বেনারসি গহনা পরার প্রয়োজন বোধ করেননি, বোধ করেছিলেন কেবল মানুষের মতো মানুষ হবার আর নিজেকে মানুষের জন্য কাজে লাগানোর। নির্মোহ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সব সময় নাম-যশ খ্যাতি এবং প্রচার এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন।
২
প্রতিভা মুৎসুদ্দির শৈশবের কথা উঠলেই বলেন বড় সহজিয়া ভঙ্গিতে। ‘দুটো কী তিনটে জামা পরেই কেটে যেত সারা বছর। বিনোদন বলতে দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠে ছুটে বেড়িয়ে খেলাধুলা আর বইপড়া। ছিলাম ছোটখাটো নাদুসনুদুস। আদরে শাসনে দিদিদের নয়নের মণি। পড়াশোনা আর স্কুলজীবনের শুরুটাও দিদিদের হাত ধরে। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা স্কুলেও সবাই আদর করতেন। ছিল টিফিন খাওয়ার ব্যবস্থা। খুব আনন্দ করে স্কুলে যেতাম। ১৯৪৩ সাল বাবা হঠাৎ করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন নিরাপত্তার জন্য। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাবা শহরে আইন ব্যবসা করতেন। মহামুনি পাহাড়তলী আমার জন্মস্থান। প্রত্যন্ত গ্রাম। বৌদ্ধসম্প্রদায় অধ্যুষিত সে গ্রামে অন্যান্য সংস্কার থাকলেও লেখাপড়ার ব্যাপারে মোটামুটি সকলের উৎসাহই ছিল।
একটি মাত্র পাঠশালা মহামুনি মডেল প্রাইমারি স্কুল। আমার জেঠামশাই ভুবন মুৎসুদ্দি, তিনিই পাঠশালার প্রধান তিনিই সহকারী। হাতে থাকত লম্বা এক বেত। আবার হৃদয়ে অফুরন্ত স্নেহ-মমতা। ক্লাসে ঘণ্টা পড়ে না। নামতা পড়ান সুর করে দুলে দুলে। সেই একই কায়দায় কবিতা। আমার ভালো লাগতো না। আমার জেঠতুতো বোনের মেয়ে আরতি, সে পড়ত অন্য এলাকায় ‘মহামুনি এ্যাংলো পালি ইনিস্টিটিউশনে’। চলে গেলাম তার সাথে। ওরই সাথে চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে বসলাম। শিক্ষক হাজিরা খাতায় নাম তুলে নিলেন। এখানে ছেলেমেয়ে উভয়ই পড়ত।’
প্রতিভা পড়াশোনায় বরাবরাই ভালো ছিলেন। সপ্তম শ্রেণি পাস করার পর পাড়ার মুরব্বিরা বাবাকে পরার্মশ দিলেন ছেলেদের সাথে পড়ালেখা ঠিক নয়। চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে। অতএব পড়া বন্ধ। বাবা বিষয়টা মেনে নিলেন না। যে মেয়ে মেধার জোরে ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় হয় তার পড়া বন্ধ করা সমীচীন মনে করলেন না।
শৈশব থেকেই প্রতিভা ছিলেন মুক্ত স্বাধীন মনের। বাধা-বন্ধনহীন জীবনই তাঁর পছন্দ। ঝোঁক ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি। আর বই পড়ার নেশাটা তো ছিলই। পছন্দ করতেন খেলাধুলা করতে। আর দশটা মেয়ের মতো পুতুলখেলা তাকে কখনো তেমন আকর্ষণ করেনি। সে-সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলে এক নতুন শিক্ষক এলেন নিকুঞ্জ বিহারী দে, খুবই প্রাণবন্ত। কাছাকাছি সময়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী। আমাদের নিয়ে দিনটি উদ্যাপন করবার জন্য স্যার তোড়জোড় শুরু করলেন। আমায় ডেকে ধরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সবলা’-আবৃত্তি করতে হবে। নাচ-গান-আবৃত্তি-আলোচনা সব মিলিয়ে সে অনুষ্ঠান সবার মন জয় করল। আমি যখন আবৃত্তি করছিলাম ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’ তখন শ্রোতৃম-লীর মধ্যে পিনপতন নীরবতা। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন, জানিয়েছিলেন আন্তরিক অভিন্দন। পরে জেনেছিলাম তিনি নিজেও কবি, নজরুল ও সুকান্তের একনিষ্ঠ ভক্ত। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কৈশোরেই প্রতিভা সান্নিধ্য পেয়েছিলেন এমন শিক্ষকের যিনি পড়ানোর চাইতে শিক্ষার্থীর মনের দরজা খুলে দিতেই পারদর্শী। বামপন্থী ছাত্র নেতা সংঙ্ঘ মিত্র মুৎসুদ্দি, দেবন শিকদার, দেবপ্রিয় বড়ুয়া, মাহবুব উল আলম চৌধুরী এঁদের সান্নিধ্যে মেধাকে শানিত করার এক মননশীল সাংস্কৃতিক পরিম-লে বেড়ে উঠে ছিলেন প্রতিভা ও তার সতীর্থরা। সেই সাথে নারী জীবনের ভাগ্যকে জয় করার শক্তি সঞ্চয় করে নিয়েছিলেন সবার অলক্ষ্যে। একই সাথে পাঠ চলছিল নানা পত্র-পত্রিকা। ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রতিভাকে কেন্দ্র করে ছাত্রী সংসদ গঠন করা হয় স্কুলে। এ-বয়স থেকেই মন ও মস্তিষ্ক তৈরি হয়ে উঠেছিল দেশাত্মবোধে। লক্ষ্য স্থির হয়েছিল সমাজের অচলায়তন ভাঙার। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এভাবেই।
৩
এবছরেই দারুণ খরায় আক্রান্ত হয়ে কৃষকেরা স্ব-উদ্যোগে চট্টগ্রামের মাদরসার টেক খনন করতে গেলে তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে গুলি বর্ষণ হয়। এতে ১৮ কৃষকের অমূল্য জীবন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বহু সংখ্যক আহত হয়। মাহবুব আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৮টি লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে তীব্র প্রতিবাদ মিছিল হয় এবং খুনিদের বিচার দাবি করা হয়। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মহামুনি অ্যাংলো পালি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করে। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন প্রতিভা ও তার সাথীরা। কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়ার জন্য শাস্তিস্বরূপ প্রতিভা মুৎসুদ্দিসহ তিন ছাত্রীকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বাবা ছিলেন প্রচ- রাগী। এ-ঘটনায় প্রতিভার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। রাগ কিছু কমলে তিনি মেয়েকে নিয়ে ডা.খাস্তগীর সরকারী স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ না থাকলেও সীমাবদ্ধ পরিসরে মত প্রকাশের যে ক্ষেত্রটি ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও দেয়াল পত্রিকায় লেখা প্রাণের কথা জানাবার ছোট্ট জমি সেখানেই প্রতিভা বীজ বপন করেছিলেন নিজেকে তৈরি করার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে পুরস্কৃত হন।
১৯৫১ সালে প্রতিভা মুৎসুদ্দি প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এতে তার প্রতি বাবার যে রাগ ছিল তা সম্পূর্ণ উবে যায়। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে মেয়েকে ভর্তি করে দিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে।
১৯৪৮ সাল, ২১শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেন, “একথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া দরকার যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ, অন্য কোনো ভাষা নয়।” এ-ঘোষণায় প্রবল প্রতিবাদ ওঠে। জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি রেসকোর্স ময়দানে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। সেখানেও এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। সে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। চট্টগ্রামের মহান ভাষা আন্দেলন ও বিপ্লবী কর্মকা-ের নায়ক ছিলেন মাহবুব আলম চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিভা ও তার সঙ্গীরা আন্দোলন করেন ভাষার দাবিতে।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির স্মৃতিচারণায় জানা যায়, ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র চট্টগ্রামে স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালন করে। আমরা একটি ট্রাকে করে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে প্রথমে খাস্তগীর স্কুলে যাই। স্কুল গেইটে গিয়ে স্লোগান দিলে হালিমা (ভাষাসৈনিক)-র নেতৃত্বে কিছু ছাত্রী বেরিয়ে আসে। এরপর নন্দন কানন স্কুল, কুসুম কুমারী স্কুল ও আরো কয়েকটি স্কুল ঘুরে আমরা কলেজে ফিরি। দুপুরের দিকে বের হয় ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল। এই মিছিলে শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে রেল ও দোকান শ্রমিক কর্মচারী যোগদান করে। ঢাকার রাজপথে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকাল তিনটার দিকে গুলি চলে ছাত্রদের উপর। সে খবর চট্টগ্রামসহ গোটা দেশে প্রচার হতে সময় লাগেনি। ছাত্র হত্যার সংবাদ জানতে পারলাম শ্রমিকনেতা হারুণ অর রশিদের বক্তৃতায়। লালদিঘি ময়দানে সেদিন শ্রমিকদের পূর্বনির্ধারিত জনসভা হবার কথা। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক সভা পরিণত হয়েছিল বিক্ষুদ্ধ ও উত্তাল জনসমুদ্রে এবং স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদমুখর। এ-সময়ে মাহবুব আলম চৌধুরী জলবসন্তে আক্রান্ত। তাঁর কাছে পৌঁছাল সেই নির্মম সংবাদ। রোগ শয্যা থেকে তিনি লিখলেন ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে জ¦লন্ত লাভার মতো এক দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ সকল অন্যায়ের প্রতিবাদমুখর ছিলেন নির্ভীক সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তাঁর সহযোদ্ধা সুচরিত চৌধুরী। তাঁদের সম্পদনায় মাসিক সীমান্ত পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম থেকে প্রবাহিত সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির যে বেগবান ধারা তা দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল। সে কর্মকা-ের সঙ্গে প্রতিভা মুৎসুদ্দি জড়িয়েছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির কণ্ঠে ঝরে পড়ে আজো সেই সেদিনের সংগ্রামমুখর দ্রোহের ঝাঁজ। ‘আমাদের মানসপট তৈরি করেছিলেন মাহবুব ভাই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে। তখন আমরা পুরোপুরি কমিউনিস্ট ভাবধারার পথিক। ঘরের টান অনুভব করি না। সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার যে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস তা তৈরি হয়েছিল তখনই।’ ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে তিনি সাধারণ বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। তখন চট্টগ্রামে ভালো কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এই কলেজেই তিনি অর্থনীতি বিষয়ে সম্মান শ্রেণিতে ভর্র্তি হন। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কিন্তু তখন ঢাকা যাওয়ার সাহস পাননি। ভাইরা ছোট। অভিভাবক বলতে তেমন কেউ ছিলেন না, যিনি সে দায়িত্ব নিতে পারতেন। তাই সে স্বপ্ন চাপা দিয়ে চট্টগ্রামেই থেকে যান।
১৯৫১ থেকে ৫৪ সালে বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলন করেন। এসব সম্মেলনে পাকিস্তান ও ভারতের প্রগতিশীল প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা যোগ দিয়েছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি সুফিয়া কামাল, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রমুখ। সকল বক্তা ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও শহিদদের আত্মদান সবিস্তারে আলোচনা করেন। সেইসাথে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বশক্তি প্রয়োগের অঙ্গীকার করেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকা সম্মেলনে সরব উপস্থিতি ছিল প্রতিভা মুৎসুদ্দির।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার নির্বাচন ঘোষণা করে। মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন-উৎপীড়নে অতিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে। প্রতিভা মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারণা চালায়। তদানীন্তন সময়ে চট্টগ্রাম শহরে নারীদের শোভাযাত্রা অকল্পনীয় হলেও প্রতিভাদের কারণেই মা-বোনদের ঘরের বাইরে আনা সম্ভব হয়েছিল। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এর পর পরই প্রতিভা মুৎসুদ্দি ঢাকা চলে যান। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কোনো হল ছিল না। ছাত্রীরা থাকতেন চামেলী হাউসে যার নাম Dhaka
University women students residence মুসলিম ছাত্রীরা সলিমুল্লাহ হল বা ফজলুল হক হলে আর হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ছাত্রীরা ঢাকা হলে অ্যাটাস্ট থাকতেন। প্রতিভা অ্যাটাস্ট ছিলেন ঢাকা হলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। এ-সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘তখন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সভা করতেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ও বাংলা ভাষার পক্ষে আমাদের দিক-নির্দেশনা দিতেন। আমরা তা অনুসরণ করে কাজ করতাম।’
১৯৫৫ সাল। প্রতিভার সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা। কুখ্যাত ইসকান্দর মির্জা ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুতরাং নির্যাতন-দমন-দলন চলবেই- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এদিকে ভাষাআন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত হয় যে যথারীতি কার্যক্রম চলবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমতলায় মিটিং। কিন্তু পরীক্ষার্থীরা মিটিংয়ে যাবে না- এটাই ঠিক হলো। আগের রাতেই হলে হলে কলো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেবার বোধহয় শীত পড়েছিল একটু বেশি। কুয়াশার চাদরে ঢাকার ভোর। সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা দিয়ে রেখেছে খুনি সরকার। পুলিশ হলগুলি ঘিরে রেখেছে। চলে পুলিশি তল্লাশি, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার। তবু সেই ভোর বেলাতেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহিদ স্মৃতি অমর হোক’- দৃপ্ত কণ্ঠের স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। ‘যতটা নির্দয় পুলিশ তার চেয়ে শতগুণ সাহসী হয়ে উঠেছিলাম আমরা। ছাত্র-যুব সমাজই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি। হলে বসেই খবর পেলাম সকালে মিডফোর্ড ও মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ খবরে তখন আমাদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। আমি ও কামরুন নাহার লাইলী একটা দল নিয়ে হল থেকে শোভাযাত্রা করে এগিয়ে দেখি রাস্তার দুধারে হেলমেট পরা বন্দুকধারী মিলিটারি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝখান দিয়ে আমরা আমতলায় সমবেত হলাম। এক ছাত্রনেতা আগুনঝরা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জ। যে-যেদিকে পারছে ছুটছে। আমার গায়েও পড়ল কয়েক ঘা লাঠি। পড়ে গেলাম মাটিতে। দুজন ছাত্র আমাকে ধরাধরি করে এগিয়ে দিল লাইব্রেরির সামনের বারান্দায়। আমরা কোনো রকমে দোতলায় ছাত্রী কমনরুমে গেলাম। সেখান থেকেই দেখতে পেলাম মিলিটারি মধুর ক্যান্টিন, কমার্স বিল্ডিং ও একতলা থেকে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। আমরা সাতজন- কামরুন নাহার লাইলী, হোসনে আরা, ফরিদা বারি মালিক, লায়লা নূরসহ আরো দুজন বেশ ক’ঘণ্টা সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থেকে পরে লাইব্রেরির দিকে চলে যাই। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই লাইব্রেরিয়ান ব্যাপার বুঝতে পেরে কার্ড ছাড়াই আমাদের বই দিলেন।
তখন সন্ধ্যা প্রায়। লাইব্রেরি থেকে বের হলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। তাই আমরা ঠিক করলাম সবাই একসঙ্গে ধরা দেব। এরপর আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে পৌঁছাই সেখানে ওত পেতে ছিল মিলিটারি। তারা আমাদের ভ্যানে উঠতে বলল। আমরা তখন স্লোগান দিতে আরম্ভ করলাম- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহিদ স্মৃতি অমর হোক।’ স্লোগান শুনে যারা ক্যাম্পাসে আত্মগোপন করেছিল তারা বেরিয়ে এল। তাদেরও মিলিটারিরা ভ্যানে তুলল। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল লালবাগ থানায়। শত শত ছাত্রছাত্রী, একে একে সবার নামে ওয়ারেন্ট লেখা হলো। তারপর রাত সাড়ে নয়টার দিকে সবাইকে পাঠানো হলো কেন্দ্রীয় কারাগারে। পরদিন হোস্টেল থেকে ছাত্রীবন্ধুরা আমাদের জন্যে কাপড়চোপড়, খাবার ও বইপত্র পাঠিয়ে দিল। দু’দিন পর খাবার পাঠানো বন্ধ। কেননা হোস্টেলের সভাপতি সে-সময়ের ভিসি ড. জেনকিন্যান্সের স্ত্রী মিসেস জেনকিন্স বলেছেন, ওরা রাষ্ট্রদ্রোহী, ওদের জন্য কিছু পাঠানো যাবে না। প্রায় দু’সপ্তাহ পর ছাড়া পেলাম। পরের বছর ১৯৫৬ সালে সরকার নীতিগতভাবে স্বীকার করল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এরপর ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালনে আর বাধা রইল না।’
১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু নির্বাচনে প্রতিভা মুৎসুদ্দি কমনরুম সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের উইমেন্স হল (বর্তমান রোকেয়া হল) ইউনিয়নের প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন। রোকেয়া হলের প্রোভোস্ট আখতার ইমাম তাঁর ‘রোকেয়া হলে বিশ বছর’ গ্রন্থে প্রতিভা মুৎসুদ্দি সম্পর্কে লেখেন, ‘ভিপি প্রতিভা মুৎসুদ্দি উইমেন্স হল ইউনিয়নের কর্মবহুল জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তার কর্মতৎপরতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং নানান নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা আমাকেও কম ব্যতিব্যস্ত রাখেনি। প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, প্রথম হল ইউনিয়নের কর্মপদ্ধতির ভিত দৃঢ় না হলে ভবিষ্যতের ইমারত দুর্বল হতে বাধ্য। তার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল অন্যকে বশ করে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়ার। এমন ভাবে না হলেও অনেক ভিপিই আমাকে কাজের ভিড়ে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। কিন্তু প্রতিভার কাজ আদায়ের ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমার প্রশাসনিক কাজের মধ্যে তার ইউনিয়নের কাজের তাগিদে আমাকে মাঝে-মধ্যে খাবি খেতে হতো। তবে কোনোদিন রাগ করতে পারিনি। কারণ, তার চাহিদার জোরের মধ্যে দৃঢ়তা থাকলেও চাওয়ার ধরনটি ছিল মোলায়েম।’
অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৫৯ সালে এমএ পাস করার পর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন ১৯৫৯-৬০ শিক্ষাবর্ষে। সেখানেও ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির আজীবন লালিত ইচ্ছে পিছিয়েপড়া মেয়েদের জন্য কাজ করবেন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করবেন। এই লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ শহরের স্কুলের ৩০০ টাকা বেতনের প্রধানশিক্ষকের পদ প্রত্যাখ্যান করে তিনি চলে গেলেন সে-সময়ের প্রত্যন্ত এলাকা কক্সবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হয়ে। বেতন ১৫০ টাকা। সময়টা ১৯৬১ সাল। এখানে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অনিয়ম, বিশৃঙ্খল শিক্ষার পরিবেশ তাঁর কাজ করার জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। পরীক্ষায় নকল করতে না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন। পরে জয়দেবপুর বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। এখানে থাকতেই ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষার পক্ষ থেকে বেশ ক’বার প্রতিভার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার জন্যে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কারণ তার ধারণা ছিল এটা বড়লোকের স্কুল। এখানে তার পোষাবে না। তাঁকে পুনরায় অনুরোধ জানানো হলো। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিনের জন্যে আসবেন। প্রতিষ্ঠান তাঁকে জানাল ভারতেশ্বরী হোমসের নিয়ম অনুযায়ী অন্যূন দুই বছর কাজ করতে হবে। এরপর এক মাসের নোটিশ দিয়ে তবেই পদত্যাগ করা যাবে। প্রতিভা ভাবলেন দুই বছর ভারতেশ্বরী হোমসের সুন্দর ব্যবস্থাপনা শিখে চলে যাবেন গ্রামের কোনো স্কুলে।
১৯৬৩ সালে প্রতিভা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতির প্রভাষিকা হিসেবে যোগদান করেন। এখান থেকেই তাঁর এক নতুন জীবনের পথচলা শুরু হয়। তিনি স্নেহময় সান্নিধ্য পেলেন অধ্যক্ষা জয়া পতির। জয়া পতি দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার কনিষ্ঠ কন্যা। কন্যা সমতুল্য স্নেহ-মমতা পেয়েছেন রণদা প্রসাদ সাহার। রণদা প্রসাদ প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন। অনূঢ়া প্রতিভা আজীবন লালন করেছেন সেই মাতা-পুত্রের চিরন্তন সম্পর্ক।
মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারিয়ে রণদা প্রসাদ ছিলেন চিরকাল মাতৃস্নেহের কাঙাল। পরিবারের অবহেলা, বাবার অনাদর, সৎমায়ের অত্যাচার তাকে ঘর ছাড়া করেছিল। হয়েছিলেন দেশান্তরী। জীবনসংগ্রাম শুরু করেছিলেন কলকাতা শহরে। সেখানে দু’মুঠো খাবারের জন্যে কায়িক শ্রমের হেন কাজ নেই, যা তিনি করেননি। জীবনের মোড় ঘুরেছিল ১৯১৪ সালে। এ-সময়ে শুরু হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মহাযুদ্ধ। ভারত থেকে লাখ লাখ তরুণ যুদ্ধে যোগ দেবার জন্যে সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়। রণদা প্রসাদ সাহাও নাম লেখালেন বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স করে। এক সাধারণ খেটেখাওয়া তরুণ রণদা হলেন সৈনিক রণদা প্রসাদ সাহা। সেখানে অসীম সাহসিকতার জন্যে রাজা পঞ্চম জর্জ-এর আহ্বানে বিলাত গিয়ে পেলেন রাজ সম্মাননাসহ সোর্ড অব অনার।
যুদ্ধ শেষ হলে রণদা প্রসাদ নতুনভাবে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম সাহস, ধৈর্য, নিষ্ঠা, সততা ও সৈনিক জীবনের শৃঙ্খলা দিয়ে অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতার মাধমে যৌবনেই তিনি শূন্য থেকে বিপুল বিত্তের মালিক হন। আবার সকল বিত্ত মায়ের নামে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মাধ্যমে মানবসেবায় উৎসর্গ করেন। ভারতেশ্বরী হোমস টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী কমপ্লেক্সে অবস্থিত অনন্য এক নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রণদা প্রসাদ সাহা উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন ছাড়া অবহেলিত নারী সমাজের মুক্তি নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষিত স্বাবলম্বী মা উপহার দেবে শিক্ষিত পরিবার, উপহার দেবে আলোকিত সমাজ- উন্নত জাতি। সেই বিশ্বাসের বাস্তব রূপ ভারতেশ্বরী হোমস যেখানে মেয়েরা হয়ে উঠবে সুশিক্ষিত, পরিশ্রমী, ত্যাগী, আত্মসম্মানবোধে স্বাবলম্বী মানুষ। রণদা প্রসাদ সাহার প্রপিতামহীর নাম ভারতেশ্বরী দেবী। তিনি কিছুটা লেখাপড়া জানতেন। সেই সামান্য শিক্ষা দিয়ে বাড়ির ও গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলাই ছিল এই বিদ্যানুরাগী নারীর ইচ্ছা। তাই রণদা প্রসাদ সাহা বিদ্যালয়টির নামকরণ করেন ভারতেশ্বরী দেবীর নামে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে ১৯৩৮ সালে সাত-আট জন ছাত্রী নিয়ে। প্রতিষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৫ সালে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এ-প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের সংস্কৃতি ও শরীর চর্চা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। ভারতেশ্বরী হোমস এ-অঞ্চলের প্রথম আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়। এখানে মেয়েরা পড়তে আসে দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জসহ সকল স্থান থেকে। রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠা করেন সাধারণ দরিদ্রদের বিনাপয়সায় চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য কুমুদিনী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইলের কুমুদিনী (আবাসিক) ডিগ্রি কলেজ, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে প্রতিভা মুৎসুদ্দি স্বনামধন্য ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর এই দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে তিনি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের পরিচালক।
৪
অশীতিপর প্রতিভা মুৎসুদ্দি কাজ করছেন বয়সের ভারকে অভ্যাসে পরিণত করে। তাঁর সাদাসিধে জীবনে খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ নিরামিষ। নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের পেছনে একটি ঐতিহাসিক গল্প লুকিয়ে আছে। তিনি শোনালেন সে গল্প, ‘১৯৪৮ সাল ৩০শে জানুয়ারি। তখন ভারত পাকিস্তান ভাগ হলেও দু’দেশের সম্পর্ক এত তিক্ত ছিল না। রেডিওতে মহাত্মা গান্ধী নাথুরাম গডসের হাতে নিহত হবার সংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের গ্রামটি ছিল নানা দিক থেকে আলোকিত। গান্ধীজির হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই এবং অহিংসা নীতি সম্বন্ধে আনেকেই জানতেন। শত কোটি গুণমুগ্ধের হৃদয়ে তিনি মহাত্মা, ভক্তদের কাছে বাপুজি। তাঁকে কেউ গুলি করে মারতে পারে সে ছিল কল্পনার অতীত। মহাত্মা গান্ধীর জন্য প্রায় প্রতিদিনই শোকসভা হতো। প্রথম সভায় চট্টগ্রামের বিখ্যাত গায়ক তেজেন সেন গাইলেন রবীন্দ্রনাথের গান- ‘তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ কর’। তাঁর কণ্ঠে কথা ও সুরের মূর্ছনায় আমরা প্রতিটি শ্রোতা ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। পাড়ায় পাড়ায় আলোচনা ও শোকসভার আয়োজন হয়েছিল। আমার দুই বান্ধবীসহ আমাদের বাড়িতেই মহাত্মার জন্য আলোচনা- শোকসভার আয়োজন করি। সেই সভায় মহাত্মার জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানব সেবায় তাঁর অবদান সম্পর্ক আলোচনা করা হয়। সে-সময় ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ গান্ধীজির এই বাণী থেকে তাঁর অহিংসা নীতিতে দেশ ও দেশের মানুষের সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত হই। আমরা শপথ করি যে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনই হবে আমাদের জীবনের ব্রত। এখন থেকে আমরা নিরামিষভোজী হব।’
প্রতিভা মুৎসুদ্দির জীবনে এখনো সে মন্ত্র মিলেমিশে আছে। সত্যাগ্রহী গান্ধীজি তাঁর আত্মকথায় বলেছিলেন, ‘সত্য ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বর আছেন তা আমি অনুভব করি না। সত্যময় হওয়ার যাত্রাপথে অহিংসা একটি অবলম্বন।’ প্রতিভা মুৎসুদ্দি তাঁর জীবনে এই সত্যময় পথটি আঁকড়ে ধরেছিলেন কৈশোরেই। সে-পথেই তিনি আজীবন অবিচল।
৫
প্রতিভা মুৎসুদ্দি ছেলেবেলায় বিশ্বাস করতেন মহামতি গৌতম বুদ্ধই সবকিছু করেন। তাঁর ইচ্ছেতেই মানুষের এত দুঃখ-কষ্ট। তাই তখন না বুঝেই বুদ্ধের পাদদেশে বসে প্রশ্ন করতেন, কেন মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ? কেন ধনী-দরিদ্রের এত ফারাক? ধীরে ধীরে বুঝেছেন মানুষই এসবের কারণ। অর্থনৈতিক মুক্তির একমাত্র উপায় সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ। বিশ্বাসও করেছেন এবং সেইমতো কাজ করার পথ খুঁজেছেন নিরন্তর। প্রতিভা নির্যাতিত নিপীড়িত পিছিয়েপড়া নারীদের এগিয়ে নেয়ার জন্য সামাজিক রাজনৈতিক সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত থেকেছেন। নির্মোহ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সব সময় নাম-যশ-খ্যাতি এবং প্রচার এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন।
দু শ’ বছরের ইংরেজ সা¤্রাজ্যবাদী শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানিদের চব্বিশ বছরের রক্তচক্ষুকে হটিয়ে এতকাল পরেও জাতির পিতা ও স্বাধীনতার স্বরূপ সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, এ-দুঃখ যেমন প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে ব্যথিত করে ঠিক তেমনি ব্যথায় নীল হয়ে ওঠেন যখন দেখেন বাঙালির হাতে বাংলা, তবু বাংলাকে অবহেলা!
তবু আশাবাদী তিনি তাকিয়ে আছেন তরুণ প্রজন্মের দিকে। বাংলাদেশের এত সাফল্যের মধ্যে তিনি বিশ্বাস করেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে নারীদের মুক্ত করে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারে পূর্ণ সাম্য বয়ে আনতে পারবে ওরাই! তবেই হবে সোনার বাংলাদেশ!