1. pragrasree.sraman@gmail.com : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী : ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী
  2. avijitcse12@gmail.com : নিজস্ব প্রতিবেদক :
শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন

পূজ্য বনভন্তের বুদ্ধ-চেতনার পরিচয়(শেষ পর্ব)

প্রতিবেদক
  • সময় রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭
  • ১২৮৭ পঠিত

ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির :

শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বনভন্তের বক্তব্য :

১। তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সংসারী বা গার্হস্থ্য জীবন যাপনকারীদেরকে বহুবিধ শিল্প জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কারণ তাহাদের চাহিদা ও রুচির কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তাই বুদ্ধ মঙ্গল সূত্রে বহুবিধ শাত্র এবং শিল্প শিক্ষা করাকে উত্তম মঙ্গলদায়ক বলেছেন। অপর দিকে ভিক্ষুদের ক্ষেত্রে করণীয় মৈত্রী সূত্রে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন অল্পকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার জন্যে। তাই একমাত্র চারি আর্যসত্য জ্ঞান এবং প্রতীত্যসমুৎপাদজ্ঞান ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের অনুসন্ধান বা নানা বিধ শিল্প ভিক্ষুর পক্ষে অহিতকর ও অশোভন। বসউত স্ব স্ব জীবন পর্য্যায় ভিত্তিক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন কর, প্রতিষ্টা লাভ কর, অভিবৃদ্ধি লাভ কর- ইহাই বিধেয়।

২। শ্রদ্ধেয় বনভন্তে বলেন প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি নিজেকে নিজে পরীক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করে। তোমার অর্জিত বিদ্যায় ধৈর্য্যের ক্ষমার এবং আত্মা সংযমের গভীরতা প্রয়োজন মুহূর্তেই পরীক্ষা করার ক্ষমতা যে শিক্ষা উপদেশে লাভ হয় তথাই প্রকৃত শিক্ষা, প্রকৃত উপদেশ।

৩। তিনি বলেন, এই যে, এম, এ; বি, এ, পড়ছে ছেলে মেয়েরা তারা এত দলাদলি, হানহানি করে কেন? এই শিক্ষা কি সুশিক্ষা না কু শিক্ষা? সুশিক্ষা মানুষের জ্ঞান বাড়ায়। এই জ্ঞানে তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে সংযমের শক্তি যোগায়। সুশিক্ষিত ব্যক্তি ভদ্র হয়, বিনয়ী হয়, মার্জিত রচিশীল হয়, উদ্বাব হয়, সৎ হয়, আত্ম নির্ভরশীল হয়, পরিশ্রমী হয়, উপায় কুশলী হয়; সৃষ্টিশীল হয়।

৪। ভিক্ষুদের লেখা পড়ার বিষয়ে শ্রদ্ধেয় বনভন্তের দৃষ্টি ভঙ্গি সবিশেষ প্রণিধান যোগ্য-

বুদ্ধের ধর্ম বহু প্রাচীন ধর্ম। এই প্রাচীনত্বের দোহাই দিয়ে বর্তমানে বহু ভিক্ষুরা ভিক্ষু জীবনে শীল-বিনয় প্রতিপালনে শৈথিল্যতা প্রর্দশন করছে তারা স্কুল কলেজে পড়তে নিজেও উৎসাহী এবং অপরকেও উৎসাহিত করে। অনেক বিশিষ্ট গৃহীরাও এক্ষেত্রে সমর্থন এবং প্রেরণা যোগায়।

১) এ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় বনভন্তে বলেন, যদি কেহ সত্যিকার ভাবে নিজেকে বিশ্বাস করে যে, আমি বুদ্ধের প্রতি এবং তাঁর উপদেশের প্রতি বিশ্বাসী তা হরে বুদ্ধের উপদেশ প্রতিপালনে কোন প্রাচীনত্ব বা নতুনত্বের প্রশ্ন অবান্তর। তোমরা বুদ্ধের প্রতি তাকাও। সারিপুত্র, মোদগল্যায়ন, আনন্দ, মহাকাশ্যপ প্রমূখ হাজার হাজার কুলপুত্রগণ তাঁর উপদেশে বিশ্বাস করে প্রব্রজ্যা নিয়ে সেই প্রব্রজিত অবস্থায় আবার কোন গুরুর নিকট কোন স্কুল কলেজে পড়তে গেছে? বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজ্যা নিয়ে এখন ভিক্ষু শ্রামণেরা যে স্কুল কলেজে পড়তে যাচ্ছে তাতে একথা কি বলা যায় না। যে- “অ-বুদ্ধ আমি তোমাকে জ্ঞানী মনে করে প্রব্রজ্যা নিয়েছিলাম। এখন দেখছি তোমার চেয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষকেরা বেশৗ জ্ঞানী। তাই তাদের কাছে জ্ঞান নিতে যাচ্ছি। তবে, আমি গরীবের ছেলে বিধায় এই রং কাপড়টা ছেড়ে যাচ্ছি না। কারণ এই রং কাপড় আছে বিধায় লোকে আমাকে বিশ্বাস করবে। এই রং কাপড় গায়ে রাখলে আমাকে ছোয়াইং দেবে, দান দেবে দক্ষিণা দেবে। তাতে আমি নিরাপদে হে বুদ্ধ! তোমার কাঁধে চড়ে আই, এ, বি এ, এম, এ-নদী পার হতে পারব। বা! চমৎকার বুদ্ধি। বুদ্ধ কে ও বেকুপ বানানো গেল; সরল বুদ্ধির দায়কগুলো চোখে ও ধুলো দেয়া গেল।

২) তিনি বলেন, ভিক্ষু শ্রামণেরা এভাবে স্কুল কলেজে পড়ার এই মানসিকতার কারণেই আজকে এত হীনমন্যতার শিকার হযেছে। তাই তারা S.D.o. D.c. মন্ত্রী, অফিসার দেখলেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তাদের সাথে করমর্দন করে সমান সমান হয়ে যায়। বুদ্ধ শিষ্যের সেই শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা বিমণ্ডিত উন্নত শীল ভূলে গিয়ে সিংহ চর্ম পরিহিত সেই বানরের ন্যায় ধান খাওয়ার আচরণ শুরু করেছ।

কই, আমি তো, স্কুল কলেজে ও পড়িনি, কোন এম, এ, বি, এ, ডিগ্রী ও আমার নেই। তাই বলে সেই পিন্সিপালেরা কি আমাকে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা প্রদর্শন করে? আমিতো কখনো তাদের দেখে চেয়ার চেড়েও দাঁড়াই না, করমর্দন করি না! তাতে কি তারা আমাকে আত্ম-অহংকারী মনে করে? আসলে কি জান, ভিক্ষু নিজেকে জ্ঞান বলে উচ্চ, ত্যাগ বলে উচ্চ, চরিত্র বলে উচ্চ, প্রতীয়মান করতে হবে। এম, এ, বি, এ ডিগ্রীতো গৃহীদের ও আছে। লোভ, দ্বেষ, মোহ ক্ষয়ের ডিগ্রী, স্রোতাপন্ন, মার্গফল, সকৃদাগামী মার্গফল, অনাগামী মার্গফলের ডিগ্রী কয়জনের আছে? বুদ্ধ ও ডিগ্রীর সনদ প্রদান করেছেন। তাঁহার শাসনে যিনি স্রোতাপন্ন তিনি মেট্রিক পাশ, যিনি সকৃদাগামী তিনি আই, এ, পাশ, যিনি অনাগামী তিনি বি, এ, পাশ এবং যিনি অরহত্ব লাভ করেন তিনি এম, এ, পাশ। সাধারণ এম, এ, বি,এ, ডিগ্রী জীবনের কোন গ্রান্টি দিতে পারেননা। কিন্তু বুদ্ধের এই ডিগ্রী জীবনের পরম নিরাপত্তা দান করে। সাধারণ ডিগ্রী লোভ, দ্বেষ, মোহকে বাড়ায়। জন্ম-জন্মান্তরে বহু দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করায়। কিন্তু, বুদ্ধের ডিগ্রী অপায় দুঃখ রোধ করে, পুনঃজন্ম চিরতরে বন্ধকরে, পরম অক্ষয় চিরশান্তি নির্বাণ প্রদান করে।

তিনি বলেন, প্রব্রজ্যা নেওয়ার আগেই ব্যবহারিক বিদ্যা যা পার সমাপ্ত কর। প্রব্রজ্যা নেওয়ার পর এই লেখাপড়ার প্রয়োজন কি? অনিত্য, দুঃখ অনাত্মা এই তিনের উপলব্ধির মধ্যেই তো নির্বাণ। এ তিন উলব্ধির জন্যে এই দেহে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে কেবল তার পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধিই তো প্রয়োজন। এত লেখাপড়ার দরকার কি? যদি ত্রিপিটক জানতে চাও তবে অনিত্য জ্ঞানের মধ্যে আছে সূত্র পিটক, দুঃখ জ্ঞানের মধ্যে আছে বিনয় পিটক এবং অনাত্মা জ্ঞানের মধ্যে পাওয়া যাবে অভিধর্ম পিটক।

তাই মহাকাশ্যপ স্থবির বলেন- নানা শাস্ত্র পড়ে, নানা জনপদ ভ্রমণ করে কোন ফল নেই, একস্থানে বসে কর্মস্থান ভাবনাই উত্তম। যে ভিক্ষু প্রব্রজ্যা নিয়ে আসব ক্ষয় জ্ঞান উৎপন্ন না করে, চিত্ত বিমুক্তি জ্ঞান উৎপন্ন না করে, শীল-বিনয় রক্ষা না করে কেবল স্কুল কলেজের লেখাপড়া অনাথাশ্রম তাঁতকল, পালিটোল চাকুরী এসব নিয়ে সারা জীবন গত করলে, তাদের ধর্ম কোথায়? মুখে আর বই-তে বুঝি? এশ্রেণীর ভিক্ষুরা নিজেরা ও অপায়গতি লাভ করবে, ধর্ম ও রসাতলে যাবে।

সংস্কৃতি সম্পর্কে বনভন্তে :

বৈরাগ্য উৎপাদক, দান, শীল, ভাবনা, আর শীল, সমাধি প্রজ্ঞার প্রেরণা দায়ক গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদির পক্ষপাতি। লোভ, দ্বেষ, অজ্ঞানতার ক্ষয় সাধন করার সহায়ক সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এবং বুদ্ধের মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা গুণাবলীর প্রতি জনসাধারণের চেতনা জাগ্রত করবে এমন গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, গানই প্রকৃত পক্ষে জগতের সুখ-শান্তি সমৃদ্ধির সহায়ক হবে বলে তিনি দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন। বনভন্তে নিজেও জাতীয় কিছু গান ও কবিতা রচনা করেছেন এবং প্রতিদিন শ্রবণ করে থাকেন। সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ নামক একটি পালাকীর্ত্তনের বই তাঁর জীবনের মোড়া কি ভাবে ফিরায়ে দিয়েছে তা ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। তিনি বাল্য জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রায় সময় উল্লেখ করেন “গৃহীকালে আমি জেমস্‌ওয়াট নিউটন, এ সকল বৈজ্ঞানিকের জীবনী পড়ে বুদ্ধ ধর্মের মাধ্যমে কি কি আবিষ্কার করা যায়, কিকি লাভ করা যায়- এই কৌতুহল জাগে। জঙ্গলে তাঁদের স্মরণ করে সেই রূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। বনভন্তে বৈজ্ঞানিকের ন্যায় পরীক্ষা না করে কারো কথায় বিশ্বাস করেনি, গ্রহণ করেনি। তাই বনভন্তে বুদ্ধ ধর্মের বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধ ধর্মের ইঞ্জিনিয়ার। জঙ্গলে থেকে এসব পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মাঝে মাঝে যখন হতাশ হয়ে পড়তাম তখন জর্জ ওয়াশিংটনের অধ্যবসায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী কর্তৃক বেলজিয়াম কে পদানত করে বৃটেন আক্রমনে হিটলারের উক্তি, জাপানী মহিলা কর্তৃক বৃটিশ যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস, ডুবুরী সাগর তলের মুক্তার সন্ধান- এসকল অসম-সাহস আর বীরত্বমূলক বিষয় চিন্তা করে জঙ্গলে আমি বীর্যপরাক্রমতা উৎপাদন করতাম।

অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্র নৈতিক চিন্তা :

অর্থনীতি সাম্যবাদ বলতে যা বুঝায় তিনি তা এভাবেই ব্যাখ্যা করেন- সামাজিক মর্যদায় মা-কে যেমন মায়ের স্থান, পিতাকে পিতার স্থান, ভাইকে ভায়েব স্থান বয়োজ্যেষ্ঠ্যকে বয়োজ্যেষ্ঠের স্থান, কনিষ্ঠকে কনিষ্ঠের স্থান দিতে হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও মানুষের বুদ্ধি, মেধা, শ্রম, ত্যাগ ও অবদানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা উচিত। ধনী, গরীব, সুখি, দুঃখী সবই তো স্ব কর্মের ফল। জন্ম-জন্মান্তরের কথা বাদ দিলেও একজন মানুষ, একটি জাতি ইহজীবনে অতীতে যে ভুল করেছে তারই মাশুল দিতে হচ্ছে বর্তমানে। আর বর্তমানে যা করছে তা সৃষ্টি করে রাখছে তার ভবিষ্যত। এ-ইতো বীজ নিয়ম সদৃশ তার কর্ম নিয়ম। অতএব, তোমরা বর্তমানের দুঃখ, দুর্বিপাকের জন্যে কেবল তোমার সম্মুখাস্থ লোকটির উপর সমস্ত দায়-ভার যে চাপতে চাচ্ছ তা তোমার অজ্ঞতা প্রসূত আর এক মহাভুল। অনাগতে তুমি বা তোমার বংশধরকে এই ভূলের খেসারত দিতে হবে আরো চরম ভাবে।

একদিন এক দায়ক ভন্তেকে দান দিতে তাইওয়ানের তৈরী একটি ইলেকট্রিক চার্জ লাইট আনল। এতে রেডিও, ঘড়ি, কেসেট, প্লেয়ার সবই আছে। দেখে শুনে, তিনি বল্‌লেন- বুদ্ধ বলেছেন বহুবিধ শিল্পজ্ঞান দিয়েই ভাত খায়। আর আমাদের দেশে চাঁদা বাজি, অস্ত্রবাজি, ঘুষ, কালোবাজারি এসব করে করে সব্য বলো তো? কারা ধনী হতে বলো তো? ধর্ম করা বুঝে, কারা মানে বলো তো? এভাবে তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেন একান্ত মনে। বলতে গেলে কোন প্রত্যোত্তরের অপেক্ষা না করেই। যেম মহাকাল তার অনন্ত প্রশ্নের উত্তর দাতা শ্রদ্ধেয় বনভন্তে, সমাজের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে একটি শক্তিশালী জাতীয় তহবিলের গঠনের উপর বিশেষ ােজর দেন। এই তহবিল গঠনের উপায় বলতে গিয়ে বিলাস সামগ্রী ব্যবহার বর্জন এই খাতের অর্থ জাতীয় তহবিল খাতে সংগ্রহের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এদেশে কৃষ্টি এবং কারিগরি উন্নয়নে এই জাতীয় তহবিল ব্যবহারে মত প্রকাশ করে থাকেন।

তিনি আর্থিক অপচায় রোধে একটি সুন্দর উপমা আমাদের শুনিয়ে থাকেন মেয়েদের চুল ও তেলকে দিয়ে। তিনি বলেন, এই লম্বা চুলওয়ালা মেয়েদের প্রত্যেকটির মাথায় যদি প্রতিদিন একছটাক করে নাকিকেল তেলের প্রয়োজন হয়, তাহলে চাকমা সমাজের দেড়, দুইলক্ষ মেয়ের জন্যে প্রতিদিন কত সের, কতমন তেল লাগবে। হিসাব করতো? তাই আমি বলি যে, সব চাকমা মেয়েরা লম্বা চুল ফেলে দিয়ে বেটে চুল রাখ।

রাষ্ট্রনৈতিক থেকে শ্রদ্ধেয় বনভন্তে গণতন্ত্রের চেয়ে ধার্মিক রাজতন্ত্রের পক্ষপাতি। তিনি বলেন, ধার্মিক রাজারহাতেই প্রজারা সন্তান বৎ সুখ লাভ করে। কেহ তাঁর উপরে কথা বলার থাকেন একক নেতৃত্বে সবকিছু চলে। কলে অণ্যায় কারীর যথোচিত শাস্তি হয়। ন্যায়ীর যথা সম্মান লাভ হয়। রাজা অধার্মিক হলে প্রজা কষ্ট পায়। এই কষ্ট সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে গণ বিদ্রোহে রাজাক্ষমতা চ্যুত হয়। পরে দশজনে মিলে উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে আবার সিংহাসনে বসানো যায়। আধুনিকগণতান্ত্রিক আন্দোলনেও ইদানিং যা ঘটছে।

কিন্তু, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্যে অনুপযুক্ত অজ্ঞ মানুষের ও ভোটাধিকার থাকার কারণে নেতৃত্বে যোগ্য অযোগ্য বিচার দুরূহ। নানা অন্যায় আর কূট কৌশলে অযোগ্য লোকই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্বে পায়। ফলে চারিত্রিক আদর্শহীন, অনুদার, অদূরদর্শী অসহিষ্ণু, প্রতিশোধ পরায়ণ লোকের নেতৃত্ব দেশ ক্রমে নানা নৈরাজ্য, দলাদলির অতল গহ্বরে নিপাতিত হয়। সর্বোপরি যে নেতা লোভ, হিংসা আর অজ্ঞতাকে লাল করে তেমন নেতার নেতৃত্ব আত্ম-পর কাহারো শান্তির কারণ হতে পারে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একজন নেতা আদর্শ চারিত্র সম্পন্ন, ন্যায়বাদী, নিঃস্বার্থপরায়ণ হলেও কখনো রাজার ন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। তাই অসংখ্য অন্যায় কারীর দাপর্টে তার নেতৃত্ব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সবশেষে বলতে হয় ধ্যানই জ্ঞানের উৎস স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পুথিগত জ্ঞানের ধারে কাছে না গিয়ে ধ্যান যোগে জ্ঞান চোখে এই বিশ্ব চরা-চরকে যিনি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেন তেমন মানুষটির জ্ঞানগভীরতা অনুভূতির গভীরতা কর বিষ্ময়কর তা শ্রদ্ধেয় বনভন্তের সহজ সরল সান্নিধ্যে না গেলে দূর থেকে ক্ষণিকের দর্শনে শ্রবণে বুঝা কঠিনই বটে।

আমি অভাজন বহুদেশ ঘুরে, বহুঘাটের জল খেয়ে, তিক্ত মধুর হাজারো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। অথচ তিনটি মাসের সান্নিধ্যে অতিকাছে থেকেও পূজ্য বনভন্তের বিশাল জ্ঞান রাজ্যের সীমানাখুঁকে পাইনি। তিনি এক কথা, এক উপমা বহু বার আওড়ান। পুনঃ শনেও শ্রোতার অরুচি জন্মে না। যেমনটি হতো ভগবান বুদ্ধের দেশনার বেলায়। শুনতে শুনতে মাঝে মধ্যে আমি হত বিহ্বল হয়ে পড়তাম। হারিয়ে ফেলতাম নিজেকে কি তিনি বলছেন- তার গভীরতল খুঁজে না পেয়ে। তখন তাঁর সুনীল ভাব-লেশহীন নিরাভয় নয়ন দু-টি-ইহতো আমার দৃষ্টির আশ্রয়। অবাক বিষ্ময়ে কেবল ভাবতাম এ কোন অচিন রাজ্যের মানুষ কেমন করে রাতনেই, দিন নেই অবিরাম গতিতে স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর মতো বইয়ে দিতে পারেন এ অমৃত ধর্ম-বারি। কতগভীর কত বিশাল তার পরকল্যাণকামী হৃদয়। সেই পরম কারুণিক মহাপুরুষের সম্মুখে বসে একটু সুযোগ পেলে যে দু’একটি কথা লিখে রাখতে পেরেছি আমার বর্তমান নিবন্ধ তারই আলোকে গাথা। তাই এতে কখনো দাবী করা যাবে না পূর্ণাঙ্গতার। অতৃপ্ত আমি পরম আর্যপুরুষের বিশাল জ্ঞানরাজ্যে হাত দিতে গিয়ে বামুণের চাঁদ ছোয়ার কাজই করা হলো। আমার এই অপূর্ণতার জন্যে পরম পূজ্যই ভন্তের নিকট করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থী।

বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না; বনভন্তের দেশনা দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা ডাঃ অরবিন্দ বাবু যখন আমাকে লিখতে দিয়েছিলেন তখন বলতে গেলে বনভন্তে সম্পর্কে আমার ধারণা বলতে কিছুই ছিলনা। ফলে কতগুলো বিষয়ে ভন্তের ধ্যান জ্ঞানের সাথে আমার পুঁথিগত বিদ্যার দ্বিমত প্রকাশ পেয়েছে সেই ভূমিকায় বর্তমানে আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি বিধায় ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

বাংলাদেশে মূল বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পতন এবং পুনরুত্থানে সাধনান্দ মহাথেরো- এই প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে যা আলোচনা হলো তাতে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হবে যে, তথাগত বুদ্ধ তাঁর দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছরের প্রচার জীবনে সব সময় লোকোত্ত জীবনের শ্রেষ্ঠত্বই প্রতিপাদন করেছেন। সেই জীবনের অধিকারী হতেই সকলকে উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে, লৌকিক জীবনকে মূল্যায়ন না করে নয়। পরম পুজ্য বনভন্তে তথাগতের হুবহু প্রতিষ্ঠানিই আমাদেরকে শোনাচ্ছেন। আধুনিকতার বিকৃতিতে বর্তমান কালে এদেশের ভিক্ষুদের যে দৃষ্টি বিকার ঘটেছে পূজ্য বন ভন্তের জীবন, ধর্মবোধ এবং ধর্ম প্রচার এই বিকৃতির দ্বিধাহীন প্রবল প্রতিবাদ। এদেশে মূল বুদ্ধ ধর্মের এক মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে তিনি আর এক পুনঃরুত্থানে নায়ক বললে কিছুতেই অত্যুক্তি করা হয় না।

লেখক : ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির, পণ্ডিত প্রবর, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, ফ্রান্স প্রবাসী।

Facebook Comments Box

শেয়ার দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো
© All rights reserved © 2019 bibartanonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazarbibart251
error: Content is protected !!