ভিকখু প্রজ্ঞাশ্রী:
মা-মাটি-মানুষের সাথে সম্প্রীতিতে বাংলা ভাষাভাষী অর্থাৎ বাঙালিদের অনন্যতা রয়েছে। বৌদ্ধিক আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতিতেও এ বিষয়টি অগ্রে। আমরা তথাগত মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের জীবনীতে দেখি, বুদ্ধ স্বয়ং তিন-তিনবার রক্ষা করতে গিয়েছিলেন সিদ্ধার্থরূপে জন্মজাত সেই জন্মবংশ- “শাক্য বংশ”। যে দিকে বিড়ুঢ়ব (শত্রুপক্ষ) সসৈন্যে নগরে প্রবেশ করবে বুদ্ধ তার অনতিদূরে যুদ্ধ যাত্রার পথিমধ্যে পাতা বিহীন বৃক্ষমূলে বসেছিলেন প্রখর রোদ্রতাপেও! -হে প্রভু গৌতম, প্রচণ্ড রোদ্রতাপে যেখানে সকলে একটু ছায়ার সন্ধানে উৎকণ্ঠিত সেখানে এতোই ছায়াশীতল বৃক্ষরাশি থাকাসত্ত্বেও আপনি এ পাতা বিহীন বৃক্ষমূলে বসে আছেন কেন? বিড়ুঢ়বের এমন প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ অপ্রমেয় মৈত্রীর সুরে বলেন- “জ্ঞাতীর ছায়া বড়ই সুশীতল” সকল প্রকার ছায়া অপেক্ষা জ্ঞাতীর ছায়া নির্মল-সুশীতল।
মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ শুধু মানব জাতি নয় বিশ্বে যত প্রকার প্রাণী আছে সকলের সুখ কামনা করেছেন। তাই তিনি রাজৈশ্বয্য ভোগশ্বর্য্য সব কিছু ত্যাগ করে জীবজগতের মঙ্গলের জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে কঠোর সাধনার মাধ্যমে জগতে ‘বুদ্ধ’ নামে আর্বিভূত হয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানবতা। আরো শিক্ষা দিয়েছেন মায়া, মমতা, দয়া করুণা, সহমর্মিতা, ঐক্যবদ্ধতা, অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে শ্রদ্ধা, জাতিসত্তা, জাতীয় মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বোধ, সামাজিক কল্যাণ, নৈতিকতা ইত্যাদি সর্ব মানবধর্ম। বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি এবং চরিত্রমানসেও বুদ্ধের এসব শিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্মদর্শন, বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের প্রভাব চিরন্তন।
বাংলার ইতিহাস অধ্যয়নে জানতে পারি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নেয়া নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাব ও স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গীর বিরূদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৯ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা ‘কপ’-প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দলোনের মাইলফলক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণাটি প্রকৃষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয় তবে সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে। কারাবন্দীত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে শেখ মুজিব ১৯৭০-এ অনুষ্ঠিত জেনারেল ইয়াহিয়া প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর থেকে বিরত থাকেন। এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এসবে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সর্বাত্মকভাবে। সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ববোধ, আত্মোপলব্ধি-আত্মজাগরণ-সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সর্বোপরি একতার শক্তি দিয়েই বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশাত্মবোধে জীবন বিসর্জন দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবেই বাঙালি ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে এনেছে।
রক্ষক্ষয়ী এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অবদান রেখেছিল স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠায়। সেদিন পিছিয়ে ছিল না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও। অংশ নিয়েছে মুক্তি সংগ্রামে। অগণিত বৌদ্ধ দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বহুজনের শহীদ হওয়ার (বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্খুসহ) ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়। মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং জাতির মুক্তির জন্য বৌদ্ধদের এই ত্যাগ বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসকে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে সমৃদ্ধ করেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনেও বৌদ্ধদের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা।
৭১’র মুক্তি সংগ্রামে বৌদ্ধদের অবদানের উজ্জ্বল সাক্ষ্য হিসেবে শ্রী সদ্ধর্মভাণক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার মহামান্য ২৪ তম মহাসংঘনায়ক, বিশ্ব বৌদ্ধদের বরেণ্য সাংঘিক ব্যক্তিত্ব, পণ্ডিত প্রবর ভদন্ত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো (১৯০৯-১৯৯৪) এবং বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, বিশ্ব নাগরিক, পণ্ডিত প্রবর দশম সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো (১৯১৪-২০০২) মহোদয়দ্বয়ের নাম নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সংগঠক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জ্যোতিঃপাল মহাথেরো ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, জাপান, সিঙ্গাপুর, মায়ানমারসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে বাংলার নিরীহ মানুষের উপর পাক-বাহিনীর চরম অত্যাচার-নির্যাতনের হৃদয়বিদারক বিবরণ উপস্থাপন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় ও জনমত গঠনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঢাকাসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এছাড়া “বিশেষ পরিচয়” পত্র প্রদানের মাধ্যমে তিনি লক্ষাধিক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও অগণিত মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন।
এর স্বীকৃতি মিলে জাতীয় পর্যায়েও। জাতীয় পর্যায়ে এরূপ গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মহোদয় ও ২০১০ সালে সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো মহোদয় জাতীয় একুশে পদক (মরনোত্তর) প্রাপ্ত হন। এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার ২০১১ সালে সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো মহোদয়কে স্বাধীনতা পুরস্কারও (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
পরিশিষ্টঃ
বাঙালির জাতীয় চরিত্র মানস ও হাজার বছরের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য গৌরবময় ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে বৌদ্ধ সংস্কৃতি। কিন্তু ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রামু এবং আশাপাশের বৌদ্ধ এলাকায় ঘটে যায় বৌদ্ধদের উপর স্মরণকালের শ্রেষ্ট সহিংসতা। ২০টি বৌদ্ধ বিহার ও অর্ধশত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাংচুর করা হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘর; আঘাত হানা হয় বৌদ্ধদের ধর্ম সংস্কৃতিতে, বিশ্বাসে। অতঃপর ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া এবং চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার লাখেরা, কোলাগাঁও গ্রামে দিনের আলোয় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয় যে, এটা একটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে অন্যের ট্যাগ করা ছবিটি নিছক ইস্যু। কিন্তু আমরা বৌদ্ধরা দেশকে কতটা ভালবাসলে শরীরে আগুন প্রজ্জ্বলিত অবস্থায়ও শান্ত, সাম্য-সৌম্য-মৈত্রীপরায়ণ থাকতে পারি! তার প্রমাণ, এ সহিংস হামলার প্রতিবাদে বৌদ্ধরা বিভিন্নভাবে সোচ্চার ছিল কিন্তু দেখুন কোন জায়গায়, কোন স্থানে একটি টায়ার জ্বলেনি, একটি গাড়ি পোড়েনি, একটি টিয়ারশেল ফোটেনি। এমন কি কোন মারামারি, জঙ্গি মিছিলও হয়নি। এসবে সহিংসতা কমে না বরং বেড়েই চলে। নিরীহ মানুষের মৃত্যু, দেশের সম্পত্তির ধ্বংস সাধন, আর্থিক অবনতি, বৈশ্বিক ভাবমূর্তির ক্ষুণ্ন ইত্যাদি সহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। আমরা বৌদ্ধরা বুদ্ধের শিক্ষা এবং মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসায় আজও বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য প্রতিটি স্তরেই অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ।
বিশ্বমাঝে শান্তির বাতাবরণ প্রবাহিত হোক এবং মৈত্রীপ্রেমে হিংসাত্মক-ধ্বংসাত্মক সকল অপসংস্কৃতি ভুলে সম্প্রীতির বন্ধনে জাগ্রত হোক পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-ভালবাসা-ঐক্যতা। চলুন, হিংসা-বিভেদ ভুলে সকলের প্রতি মহান বিজয় দিবসের মৈত্রীময় শুভেচ্ছা-ভালবাসায় “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার” শ্লোগানে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ি একসাথে।
জয় ঐক্যের জয়। জয় বাংলার জয়। জয় বুদ্ধ শাসনের জয়।
শেয়ার করুন