ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির:
(প্রথম পর্ব)
বিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় বৌদ্ধদের ধর্মীয় জীবনে এক ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় লগ্নে ১৯২০ খৃস্টাব্দে বর্তমান কালের জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সর্বজন পূজ্য পরম পূজ্য বনভন্তের আবির্ভাব। তিনি প্রচলিত ভিক্ষু জীবনে কাকেও জীবন চলার পথ প্রদর্শক হিসেবে না পেয়ে একমাত্র বুদ্ধ, সারিপুত্র, মোদগল্যায়ন, মহাকাশ্যপকে আপন গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়ে একদিন কাপ্তাই অঞ্চলের ধনপাতা নামক গহীন অরণ্যে প্রবেশ করলেন। সাথে নিলেন গুটি কয়েক ধর্মগ্রন্থ। এক নাগাড়ে ১২টি বছর ধরে চললো তাঁর সাধনা। বুদ্ধেরই মতো রোদ, বৃষ্টি, ঝড়; শীত; গ্রীষ্ম, বর্ষার প্রকোপ, কীট-পতঙ্গ মশার দংশন, রাতে দেব-দানবের ভয়, বিষাক্ত, ক্ষুধা-তৃষ্ণা কামচ্ছন্দ, তন্দ্রালস্য চিত্ত বিক্ষিপ্ততা প্রভৃতি সব কিছুকে তিনি স্বীয় অভিজ্ঞতার দ্বারা জানতে চেয়েছেন; বুঝতে চেয়েছেন-ইহা দুঃখ চির সক্ষাব নিরোধ ধর্ম তা চির নিরুদ্ধ হওয়ার সম্যক মার্গ বুদ্ধ বর্ণিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
এভাবেই তিনি বুদ্ধের আবিষ্কৃত চারি আর্যসত্য এবং প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতিকে আপন প্রতিটি চিত্ত উৎপত্তি দেহ মনের প্রতিটি ক্রিয়া প্রতিক্রিযায় দর্শনের চেষ্টা করলেন। সদা জাগ্রত ভাবে দর্শন ও উপলব্ধির অবিরাম চেষ্টায় জীবন মরণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হরেন তিনি দীর্ঘ ১২টি বছরের একটানা সেই প্রায় জাত উপলব্ধি সমূহ ক্রমে তার কাছে অভ্যাস ও দৃঢ় বিশ্বাসে রূপ নিল। এই জানা, এই বুঝা, এই বিশ্বাস ও অভ্যাস তাঁর সামগ্রিক উপলব্ধিকে পরবর্তী কালে কোন ধরণের জীবন দৃষ্টি দান করলো তা নিম্নে কয়েকটি উক্তি থেকে সহজেই অনুমেয়। যথা-
১। আলমিরা তৈরীতে বিভিন্ন সরঞ্জাম নির্বাণ লাভের সাধনায় বুদ্ধের সকল ধ্যান পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতা।
২। তৃষ্ণা ক্ষয় করতে পারলে ত্রিপিটকের দরকার কি? অধর্মবাদী, লোভ-দ্বেষ-মোহযুক্ত ভিক্ষুদের জন্যেই তো সঞ্চয় হলো ত্রিপিটক তৈরী হলো। তোমরা আমার ন্যায় তৃষ্ণা ক্ষয় কর। লাভ সৎকারের প্রত্যাশী না হলে আমার ন্যায় ভোগ্য বস্তুর অভাব কখনো হবে না।
৩। শীল-বিনয় ধর্মানুধর্ম আচরণ করছেন বলেই বর্তমান ভিক্ষুদের উপর দায়কদের বিশ্বাস নেই। তাই তারা এখন অশ্রদ্ধাবান দায়কে পরিণত হচ্ছে। অশ্রদ্ধাবান দায়কেরা কি ভিক্ষুর প্রতি মাতা-পিতার ন্যায় যত্ন নেবে? প্রয়োজন কখনো মিতাবে? বলতো দায়কদের এমন অধঃপতনের জন্য দায়ি কে? মানুষ কি বেকুপ যে, তুমি শীলবান, চরিত্রবান, ধ্যানী না হয়ে কেবল পালি শ্লোক আওড়ালেই পণ্ডিতালী দেখালেই তারা তোমাকে বিশ্বাস করবে? তাই কিছু বলতে পারা বা পালি রূপ ভাষা শিক্ষকরা নিষ্প্রয়োজন। ধর্মানুধর্ম জীবন গঠনই আসল।
৪। কামাতুর হলে নির্বাণ লাভ অসম্ভব কাম ত্যাগ, রূপ ত্যাগ, বেদনা ত্যাগই নির্বাণ পঞ্চস্কন্ধে কি যে দুঃখ তা সাধারণের পক্ষে বুঝা অসম্ভব। পঞ্চস্কন্ধ নাম-রূপের প্রতি সর্বক্ষণ অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা দৃষ্টিতে দর্শন কর।
৫। কেহ কেহ বলে নির্বাণের চেয়ে বৌ ভালে। কারণ বৌ ভাত রান্না করেদেয়, চা করে দেয়, বিছানা করে দেয়। নির্বাণ তো কিছুই দেয় না। আসলে কি জান? অন্তরদৃষ্টিভাব না থাকলে, উৎপন্ন না হলে, নির্বাণ কি তা বুঝা অসম্ভব। স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, ক্লেশ, অবিদ্যা, তৃষ্ণা-এসকল যে দুঃখ দেয়, তা জানতে হবে বুঝতে হবে। তাতেই অন্তদৃষ্টি ভাবের উদয় হবে।
৬। পঞ্চস্কন্ধে দুঃখ আর্যসত্য জ্ঞাত হও। অবিদ্যা-তৃষ্ণা জাত সমুদয় আর্য্য সত্য ত্যাগ কর। নির্বাণ রূপ নিরোধ আর্যসত্য প্রত্যক্ষ কর। এবং শমথ বিদর্শন রূপ মার্গ আর্য সত্য ভাবনা কর। তাতেই নির্বাণ।
৭। ছড়ার পরিষ্কার পানিতে তলদেশের মাছ, শামুক, কাকরা, প্রভৃতি স্পষ্ট দেখা যায়। তেমনি, চিত্ত শমথ ভাবনা দ্বারা পরিষ্কার হলে (অর্থাৎ দুঃখ আর্য সত্যকে দেখলে, সমুদয় আর্য সত্যকে বুঝতে পারলে) তখনই নিরোধ আর্যসত্যকে দেখবে, মার্গ সত্যকে দেখবে।
৮। ঘোলা জলে যেমন কিছুই দেখা যায় না, তেমনি অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ এ সব চিত্তকে সবসময় ঘোলা রাখে বলিয়াই অধর্ম কে ধর্ম ধর্ম কে অধর্ম, সুখ কে দুঃখ, দুঃখ কে সুখ এই বিপরীত দর্শন হইয়া থাকে।
৯। তোমার চিত্ত সত্য পথে যাচ্ছে, না মিথ্যা পথে যাচ্ছে; কুশল পথে যাচ্ছে, না অকুশল পথে যাচ্ছে তা অবশ্যই জানতে হবে। নির্দয় রাজা, প্রবল শত্রু, বনের বাঘে যত ক্ষতি করতে পারে না, মিথ্যাপথগামী চিত্ত তদপেক্ষা বহু অধিক ক্ষতি করে থাকে। মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব যত উপকার করতে পারে; সত্যপথগামী, কুশল কর্ম চিত্ত তদপেক্ষা বহুবেশী উপকার করে।
১০। চারি আর্যসত্য, প্রতীত্যসমৎপাদ-হল নিজ ধর্ম। মার্গফল, নির্বাণ হল নিজধর্ম। চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমৎপাদজ্ঞান হল নিজ কাজ। এ সবের বাইরে যত ধর্ম কর্ম সবই হল পরধর্ম পরকাজ। আমি নিজ ধর্ম করিব, নিজ কর্ম করিব। পরধর্ম, পরকাজ ত্যাগ করত-এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কর।
১১। সংগ্রাম ছাড়া নির্বাণ লাভ হয় না। প্রথম যুদ্ধ হবে মেয়ে-পুরুষ পরষ্পরে অর্থাৎ কাম ভাবের সাথে। দ্বিতীয় যুদ্ধ হবে দেবপুত্র মারের সাথে, ক্লেশমারের সাথে, সংস্কার মারের সাথে, তৃতীয় যুদ্ধ হবে আত্মা, আমিত্ববা অহংকারের সাথে।
১২। অজ্ঞানীর মাংস বাড়ে কিন্তু প্রজ্ঞা বাড়ে না। হাল কর্ষণ না করলে যেমন ক্ষেতি হয় না, তেমনি ভাবনা না করলে জ্ঞান হয় না। অজ্ঞানই সর্বদা এক আমার ওটা আমার করিয়া করিয়া মরে।
১৩। লোভই মহাব্যাধি, সংস্কার (অবিদ্যা তৃষ্ণাজাত নানা অভ্যাস) পরম দুঃখ ইহা যথার্থ রূপে যারা জানে তাঁরাই পণ্ডিত তাঁরাই নির্বাণ দর্শন করে।
১৪। অবিদ্যা নানা মত, নানা পথ চিত্তকে প্রদর্শন করে। তাই বুদ্ধ কিছুই অনুসন্ধান করেননি। তিনি শুধু চেয়েছেন দুঃখ নিরোধ জ্ঞান আর সর্বজ্ঞতা জ্ঞান। চারি আর্যসত্য হলো দুঃখের ক্ষয় বা দুঃখ নিরোধ জ্ঞান আর প্রতীত্যসমুৎপাদজ্ঞান হলো সর্বজ্ঞতা জ্ঞান। বুদ্ধের এই অনুসন্ধানের বাইরে ভিক্ষুদের পক্ষে অন্য যে কোন বিষয় অনুসন্ধান করা বা নানা শিল্প শিক্ষা করা অন্যায় ও অশোভন।
১৫। শীল সংযম, ইন্দ্রিয় সংযম, ভোজনে মাত্রজ্ঞান আর সদা জাগ্রত ভাব ভিক্ষু এই চারটি গুনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে নির্বাণ লাভ হয়। পাপে লজ্জা, পাপের ভয় থাকলে, ব্রহ্মচর্য শীল দৃঢ় হও এতে অনাগামীফর পর্যন্ত লাভ হয়।
সংঘকে একটু মান্য করে।
অন্যান্য ধর্মে নারী পুরুষের মিলনে সুখ, ধন-সম্পদ ভোগে সুখ, এসব বলে। তাঁদের ধর্মের এগুলোই তলা। তাই সেখানে সহজেই তল পাওয়া যায়। বুদ্ধ ধর্ম গম্ভীর। তার তল পাওয়া বহু শ্রমসাধ্য ব্যাপার।
তিনি বলেন এদেশে ভিক্ষুরা উত্তম না হলে বৌদ্ধ সমাজ টিকতে পারবে না। ভিক্ষুদের সেজন্যে তিনটি সম্পদা থাকতে হবে। এগুলো হরো- ১) প্রব্রজ্যা ত্যাগ না করা; ২) চারি আর্যসত্য জ্ঞান অর্জন করা, ৩) আসবক্ষয় জ্ঞান উৎপন্ন করা (চিত্ত বিমুক্তি, প্রজ্ঞা বিমুক্তি)। বর্তমানে ভিক্ষুদের এসব নেই। তাই এদের পূজা করলে, কি করে দায়কের সুখ হবে শান্তি হবে? কেন তারা কাপড় ছাড়ে? কাপড় নিয়ে থেকেও কেন তারা ভিক্ষুধর্ম বিরোধী কাজ করে? কৈ আমি তো আছি। আড়াই হাজার বছর আগেকার ভিক্ষুদের মতো জীবন গঠন করতে গিয়ে আমি তো মরে যাইনি। এবং আমার আচরণে বুদ্ধ ধর্মের বা দায়কদের কোন ক্ষতি হচ্ছে বলেও তো এযাবত কেহ বললোনা। বর্তমান ভিক্ষুরা বুদ্ধের ধর্ম-বিনয় বিরোধী চলছে এজন্যে কি যে, তারা কোন দিন আর মরবে না?
পূজ্য বনভন্তে এক আদর্শ বৌদ্ধ পল্লীর কথা বার বারই উচ্চারণ করেন। তাঁর মতে সেই বৌদ্ধ পল্লী হবে- ছয় মাইল দীর্ঘ, ছয় মাইল প্রস্ত সোজা সরল বৃহৎ পাকা রাস্তার উভয় পাশের বাড়ী প্রতিটি বাড়ী হবে চার পাঁচ তলা বিশিষ্ট। আর প্রতিটি বাড়ীর সামনে থাকবে ঘরের নম্বর যুক্ত নাম ফলক এবং টেলিফোন নম্বর সামনে ফুলবাগান গাড়ী বারন্দা ইত্যাদি। তিনি বলেন, তোমরা যদি শীলবান হও তাহলে অবশ্যই ধনী হবে। দেবরাজ ইন্দ্র চারিলোকপাল দেবগণ এবং ধনী দেবতারা তোমরা সহায়তা দেবে। বুদ্ধের উপর অগাধ বিশ্বাসী হলে বুদ্ধই দেবে সব কিছু। দেহধারী বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হলে কি হবে ত্রিপিটকে ধর্ম কায়িক বুদ্ধতো এখনো জীবন্ত। সেই বুদ্ধের উপর তোমরা অগাধ বিশ্বাসী হও। সেই বুদ্ধ মতে চল। বুদ্ধই তোমাকে সবকিছু দেবে। দেখছনা আমাকে? বুদ্ধই আমাকে সবকিছু দিচ্ছে।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সামপ্রদায়িক পরিবেশে বিশেষতৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থির সামাজিক পরিবেশ সর্ম্পকে বনভন্তের ইচ্ছা- এই পাহাড়ী এবং বাঙালীরা প্রত্যেকে স্ব স্ব ধর্মীয় আচার, এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্য অক্ষণ্ন রেখে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান করুক। কেহ অন্যায় ভাবে কারো ধন, জন, বিত্ত, সম্পদ, জমি-জমা এসবের উপর হস্তক্ষেপ না করুক। চারি, ডাকাতি, হত্যা চাঁদাবাজি রাহাজানি এবং সর্বত্র জীবন ভীতি তিরোহিত হউক। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মন্ধতা পরিহার করে মুক্ত বিবেক এবং স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হউক।
চলবে……
লেখক : পণ্ডিত প্রবর, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, ফ্রান্স প্রবাসী।
শেয়ার করুন