বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন-
ভিক্ষু জিনানন্দ ছিলেন সমাজসেবক, ত্রিপিটকবিশারদ ও বৌদ্ধ ভিক্ষু। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ছিলেন সংসারবিমুখ। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। বৌদ্ধবিহারে থেকে বৌদ্ধ ছেলেমেয়েদের নৈতিক শিক্ষা দিতেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিনানন্দ গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো তখন পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বৌদ্ধদের বাঁচানোর জন্য চট্টগ্রামে একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অফিসের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন ভিক্ষু জিনানন্দ। এখান থেকে বৌদ্ধদের পরিচয়পত্র দেওয়া হতো, সেটা দেখলে পাকিস্তানি সেনারা পরিচয়পত্রধারীকে হত্যা করত না।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত অনেক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ভিক্ষু জিনানন্দের যোগাযোগ ছিল। তিনি সেই সব যোদ্ধার অনেককে বৌদ্ধ হিসেবে পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকাপয়সা ও সাহায্য দ্রব্যাদি বহন করা ছাড়া অস্ত্রও বহন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জিনানন্দের এই তৎপরতার কথা একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকারদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ১৩ ডিসেম্বর রাজাকাররা তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর কোথাও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ শহীদ হন।
জিনানন্দ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যায় ড. প্রণবকুমার বড়ুয়ার ‘আমার আপনজনেরা’ রচনা থেকে। প্রণবকুমার লিখেছেন, ‘…বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে তিনি খুবই সুনাম অর্জন করেছিলেন এবং বৌদ্ধ নরনারীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বৌদ্ধবিহারে অবস্থান করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা দিতেন।
‘১৯৭১ সালের দুঃসহ দিনে বৌদ্ধদের রক্ষার জন্য পাশে এসে দাঁড়ালেন বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার সাথে যোগাযোগ ও অন্যান্য কার্যক্রম চালানোর জন্য চট্টগ্রাম শহরে একটি অফিস স্থাপন করেন। ভিক্ষু জিনানন্দ ছিলেন সে অফিসের কর্মাধ্যক্ষ। সে সময় বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ বৌদ্ধদের নিরাপত্তার জন্য পরিচিতিপত্র বিলি করেছিলেন বৌদ্ধদের মাঝে। পরিচিতিপত্র দেখালে পাকসেনা এবং তাদের দোসররা বৌদ্ধদের নির্যাতন করত না। ভিক্ষু জিনানন্দের সাথে সম্পর্ক ছিল মুক্তিপাগল দামাল ছেলেদের। তিনি এ রকম অনেক পরিচিতিপত্র বৌদ্ধ ছাড়াও অনেক যুবককে দিয়েছিলেন। ঐ পরিচিতিপত্র নিয়ে অনেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এবং প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে দেশে এসে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। অধিকন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরও পরিচিতিপত্র দিয়েছিলেন, যাতে তারা অবাধে চলাফেরা করতে পেরেছিল। অসীম সাহসের অধিকারী এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন এবং দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর এ গোপন তৎপরতার কথা ফাঁস হয়ে যায়। তখন তিনি পটিয়া থানার পাঁচারিয়া গ্রামের বৌদ্ধবিহারে অবস্থান করছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’দিন পূর্বে রাজাকাররা তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তিনি নিখোঁজ হন ১৩ই ডিসেম্বর তারিখে। তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বাদশ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
ভিক্ষু জিনানন্দের জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার আঁধারমানিক গ্রামে। তাঁদের পরিবার ছিল জমিদার বংশ। এই পরিবারে বৌদ্ধধর্ম দর্শনবেত্তা বিমলানন্দ মহাথেরোসহ অনেক কৃতী মানুষের জন্ম হয়েছে। কেউ কেউ বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শাক্যপদ বড়ুয়া অন্যতম।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান (প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫)
শেয়ার করুন