ড.দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া:
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ প্রধানত দুইভাবে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন। প্রথমত দেশের অভ্যন্তরে বৌদ্ধদের জানমাল রক্ষায় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর নেতৃত্ত্বে আভ্যন্তরীণ মিশনারী কাজ, দ্বিতীয়ত মুক্তযুদ্ধে স্বপক্ষে জনমত গঠনে সংঘরাজ পণ্ডিত জ্যোতি:পাল মহাথেরর বৌদ্ধদেশ পরিভ্রমণ।
মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের পাকিস্তান সৃষ্টির পর ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত স্বল্প সংখ্যাক বৌদ্ধদের জন্য এবং এ দেশের বৌদ্ধদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বহু আয়াস স্বীকার করে ঢাকা ধর্মরাজিক মহাবিহার কমপ্লেক্স গড়ে তোলেন। ঢাকায় বিহার নির্মিত হওয়ার ফলে দেশে বিদেশে বৌদ্ধদের পরিচিতি পেতে থাকে। ইতিমধ্যে ১৯৫০ সালে বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাত্ব সংঘ গতি হলে বনগঠিত বাংলাদেশ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এর সদস্য পদ লাভ করে। সংঘের নেতৃত্বে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের। বৌদ্ধদের পক্ষে কাজ করার সুবাদে এ সংগঠন ও সংগঠনের সভাপতি বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরও পাকিস্তন সরকারের আস্থা লাভে সমর্থ হন। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হলে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের পাকিস্তান সরকারের নিকট এদেশের বৌদ্ধদের জানমাল রক্ষার জন্য আবেদন জানান। তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সম্মতিক্রমে তিনি বৌদ্ধদের পরিচয় পত্র প্রদান করেন। এ পরিচয় পত্র নিয়ে শুধু বৌদ্ধ নয়, বহু হিন্দু-মুসলিম ও মুক্তি যোদ্ধারা জীবন রক্ষা করেছিলেন। বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পত্র নিয়ে অবাধে চলাফেরা ও পাকসেনাদের খবরা খবর আদান প্রদান করতেন। মহাথের এ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বৌদ্ধ প্রধান এলাকায় তাঁর সহকর্মীদেরসহ উপস্থিত হয়ে সাধারণকে অভয় দিয়েছেন; প্রয়োজনে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে বৌদ্ধদের অবস্থানের কথা অবহিত করেছেন। এ সময়ে তাঁর সহযোগী হিসেবে শহীদ জিনানন্দ ভিক্ষু, শহীদ ননী গোপাল বড়ুয়া (লাখেরা), প্রয়াত সংঘনায়ক প্রিয়ানন্দ মহাথের, শ্রীমৎ শুদ্ধানন্দ মহাথের, প্রয়াত বোধিপাল মহাথের, সংঘনায়ক এস. পাল মহাথের, শ্রীমৎ বনশ্রী মহাথের, বাবু শীলব্রত বড়ুয়া (চরকানাই), প্রয়াত সুগতানন্দ মহাথের, অশ্বিনী রঞ্জন বড়ুয়া(পাঁচরিয়া), প্রকৌশলী ব্রহ্মদত্ত বড়ুয়া (রাউজান), উ: পণ্ডিতা মহাথের (টেকনাফ), দীপংকর শ্রীজ্ঞানসহ আরো অনেকে কাজ করেছেন।স্মরণীয় যে মহাসংঘনায়কের সহযোগী শ্রীমৎ জিনানন্দ ভিক্ষু দেশ স্বাধীন হওয়ার দুদিন পূর্বে শহীদ হন।
এখানে উল্লেখ্য যে, তখন বাঙালি বৌদ্ধদের অবিসংবাদিত নেতা ও ধর্মীয় গুরু হিসেবে পাকিস্তান সরকারের কাছে বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সমধিক। অপর দিকে চীন সরকার পাকিস্তান সরকারের সমর্থক ছিল বিধায় বাংলাদেশী বৌদ্ধদের প্রতি পাক সরকারের একটা সহাভূতি ছিল। ফলে বৌদ্ধরা ‘চীনা বুড্ডিষ্ট’ পরিচয় দিয়ে বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আশ্রয় প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রক্তন মন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার, সাম্যবাদী দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার বড়ুয়া এবং হিন্দু ধর্মীয় নেতা মি: আর. এন. দত্ত গুপ্ত অন্যতম। আরো বহু নারী পুরুষ এ সময়ে বিহারে আশ্রয় গ্রহণ করে জীবন রক্ষা করেছিলেন। এ সব কাজে বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর সহযোগিতা ছিল অপরিসীম।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, ‘চীনা বুড্ডিষ্ট’ হিসেবে বৌদ্ধরা জীবনের নিরাপত্ত পাওয়ায় বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম হিন্দু সম্প্রায়ের প্রধান নিরাপদ আশ্রস্থলে পরিণত হয়। হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বৌদ্ধ গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের জীবন ও মান সম্মান রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধারাও বৌদ্ধ গ্রামকে নিরাপদ আশ্রয় স্থান মনে করত এবং এ সব গ্রাম থেকে বহু অপারেশন পরিচালনা করেছিল। এ কারনে বাংদেশের মুক্তি সংগ্রামে বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ গ্রাম, বৌদ্ধ পরিবারগুলোর ভুমিকা অত্যন্ত গৌরবের। অনেক বৌদ্ধবিহার ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। অনেক পরিবারেও তাদের অবাদে বিচরণ ছিল এবং বৌদ্ধরাও তাদের আপন আত্মীয় স্বজনের মত যথাসাধ্য আহর্যাদি দিয়ে সেবা করছিল।
দেশ স্বাদীন হওয়ার পর প্রয়াত মহামান্য সংঘরাজ শ্রীমৎ শীলালংকার মহাস্থবির এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের পাকিস্তান হানাদারদের নৃশংস অত্যাচারে সমগ্র বাংলাদেশের নরনারী যখন প্রাণভয়ে সন্ত্রস্ত হয়েছিল তখন কর্তব্য পরায়ণ বিশুদ্ধানন্দ মহাথের গ্রামে নিগমে জনপদে অক্লান্ত পরিশ্রম সহকারে স্বয়ং উপস্থিত হয়ে সকলকে অভয়দান করেছিলেন। বহু বিপদগ্রস্তকে ত্রাণ দান কিেছলেন। ইহা তাঁর মানবতার পরাকাষ্টা মহানুভবতার উজ্জ্বল নিদর্শন( বড়ুয়া, প্রণব কুমার, প্রগুক্ত, পৃ:৩৬)।
মুক্তিযুদ্ধে বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর অবদান সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিশিষ্ট সংগঠক প্রয়াত সংঘরাজ পণ্ডিত জ্যোতিপাল মহাথের বলেন, ‘মাননীয় মহাথের মহোদয় পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে শেষ পর্যায়ে চীনা বৌদ্ধ নামে পরিচয় পত্র প্রদান করে শত শত লোকের প্রাণ রক্ষা করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন, তিনি কাজ করলেন দেশে, আমি কাজ করলাম মাতৃভুমির শান্তি ও স্বাধীনতার পূর্ণ সমর্থক রূপে বিদেশে। ……….. তাঁর সাথে থাকতো সরকারী কর্মকর্তা এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তিনি বিভিন্ন জায়গায় সভা করলেন, সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানালেন। তিনি বৌদ্ধদের অভয় দিলেন এবং পরিচিতি পত্র প্রদান করলেন। বৌদ্ধরা রক্ষা পেল, বৌদ্ধ গ্রামগুলো অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে যায়। সরকারও বৌদ্ধদের রক্ষার নির্দেশ দেয়। আর সেই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে নিরাপদে আশ্রয় নেয়।
‘ব্যক্ত হোক জীবনের জয়’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে শুদ্ধানন্দ মহাথের লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষের শান্তির জন্য’ নিরাপত্তার জন্য গুরুদেব বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর নেতৃত্বে আমরা মিশন নিয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পটুয়াখালিসহ দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। আমাদের মিশনের ফলে অসংখ্য মানুষের জীবন সম্ভ্রম রক্ষা পেয়েছে। বৌদ্ধ সমাজের বহু মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বৌদ্ধ নারীরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ঘরাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুট ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রচার সংঘের শত শত কর্মী অংশ গ্রহণ ছাড়াও আমরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য নারীপুরুষকে বিহারে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছি। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বিহারে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কমলাপুর এলাকায় আমাদের বিহারটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থান। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী এ বিহার থেকে ঢাকা শহরের একাধিক অপারেশন চালিয়েছেন। (পৃ: ৮৬-৮৭)
মূলত পাকিস্তান সরকার থেকে বৌদ্ধদের জানমালের নিরাপত্তা আদায় এবং চীনা বৌদ্ধ (China Buddhist) পরিচয় পত্র পাওয়ার কারনে বৌদ্ধরা বহুলাংশে নিরাপদ ছিল, এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা তা যদি না হতো তাহলে জান মালের ক্ষয় ক্ষতি আরো বহু গুন বেশী হতো। এদিক থেকে বলা যায় বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার কারনে বৌদ্ধ গ্রামগুলো পাক বাহিনীর তাণ্ডব লীলা থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছিল, অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু নিরাপদ সাধারণ মানুষ বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছিল এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা এসব গ্রাম থেকে শত্র“ঘাটির উপর আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালের দৈনন্দিন ঘটনাবলী নিয়ে বিশুদ্ধানন্দ মহাথের১৯৭২ সনে ‘রক্ত ঝরা দিনগুলোতে’ নামে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা রচনা করেন। এটা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিল পত্র’ নামক গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে।
শেয়ার করুন