ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া:
সাহিত্যের স্রোত সর্বগামী। ধর্ম-দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি সবখানেই সাহিত্যের কলধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতে বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের বিবিধ বিষয় এসে মিশেছে। আজ হতে আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধের ভিক্ষু সংঘে বঙ্গীশ নামে এক স্বভাবকবি ছিলেন। নেপাল রাজ দরবারে খুঁজে পাওয়া পূঁথি ‘চর্যাশ্চর্য বিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদ’ হতে আমরা জেনেছি-হাজার বছরের বেশি সময় আগে হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পুষ্ট হয়ে আছে। ‘চর্যাপদ’ মূলতঃ বৌদ্ধ সাধনাচার্যদের সহজিয়া সাহিত্য। ‘রবীন্দ্র মননে বুদ্ধ’ গ্রন্থের সুবাদে আমরা জানি রবীন্দ্র সাহিত্যের বিভিন্ন রচনায় লুকিয়ে আছে বৌদ্ধ সাহিত্য ও তার হরেক উপাদান।
বৌদ্ধ সাহিত্যের খোঁজে বের হয়ে আমরা পেয়ে যাই বৌদ্ধ জাতকমালার কথা। বৌদ্ধ জাতকমালা ত্রিপিটকে বিধৃত বিষয়বস্তু হতে নিংড়ানো সাহিত্য কথন। বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ত্রিপিটক মূলতঃ তিনটি গ্রন্থ বা পিটক বা ঝুড়ির সমন্বয়। যথা: সূত্র পিটক বা সূত্র গ্রন্থ, বিনয় পিটক বা আচরণবিধি গ্রন্থ এবং সর্বশেষ অভিধর্ম পিটক বা দর্শনশাস্ত্র। সূত্র পিটকের একটি ভাগ হচ্ছে খুদ্দক নিকায়। খুদ্দক নিকায়ের পনরটি গ্রন্থ। তার মধ্যে দশম গ্রন্থটি হচ্ছে জাতক। আভিধানিক অর্থে জাতক হলো যে জন্মগ্রহণ করেছে বা যে জাত হয়েছে। কিন্তু পালি সাহিত্যে বা বৌদ্ধ সাহিত্যে জাতক বলতে বুঝায় গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্ম-বৃত্তান্ত। গৌতম বুদ্ধ কেবল এক জন্মের অর্জিত পুণ্য ও প্রজ্ঞায় বুদ্ধ হননি। বৌদ্ধ মতে তিনি পাঁচশ’ পঞ্চাশ জন্মে বিভিন্ন যোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। এই সকল জন্মে তিনি বিভিন্ন রকমের শর্ত পূর্ণ করেন। শর্ত বা নর্মস হলো পালিতে পারমী। গৌতম বুদ্ধ বিভিন্ন জন্মে দশ প্রকার পারমী, দশ উপ-পারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পূরণ করেন। এরই ফলে বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভ হয়। বুদ্ধের পারমী পূরণের পথে লব্ধ সকল অতীত জন্মের কাহিনী হতে শিক্ষণীয় বা উপদেশনীয় অংশ নিয়েই জাতকের সৃষ্টি। বৌদ্ধ জাতক সাহিত্যে প্রায় পাঁচশত জাতকের অস্তিত্ব জানা যায়। গৌতম বুদ্ধ যখন তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের এবং ভিক্ষু সংঘকে ধর্মোপদেশ ও দেশনা (ধর্ম ব্যাখ্যা) প্রদান করতেন তখন তিনি দিব্যজ্ঞাননেত্রে জানতে পারতেন-কাকে কোন্ জন্মের কাহিনী শোনালে শ্রোতা মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হবে। বুদ্ধ দেশিত, শিক্ষনছলে বর্ণিত এই কাহিনীগুলোই বৌদ্ধ সাহিত্যে তথা পালি সাহিত্যে জাতক নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
জাতকের কাহিনীগুলো প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। লোকপরম্পরা চলে আসা লোকসাহিত্যের আদি অবস্থা, পরিবর্তন ও পরিবর্তনের কারণ এবং রচনার উদ্দেশ্য বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি মাত্রেই জাতক পঠন-পাঠন জরুরি। এতদ্বিধ প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ বহু আগেই জাতক অধ্যয়ন সমাপ্ত করেছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার, রীস্ ডেভেডস্, ফৌসবল, চার্লস এলিয়ট প্রমুখ বিদগ্ধজন অক্লান্ত প্রচেষ্টায় জাতক এবং সমগ্র ত্রিপিটককে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত ও ইংরেজিতে অনুদিত করেছেন। তারা কেবল জাতকের অনুবাদ সমাপনেই ক্ষান্ত হননি। তারা জাতক হতে চিত্তাকর্ষক ও দরকারি কাহিনীগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রকার শিশু-পাঠ্য রচনা করেছেন। এ কারণেই এই উপমহাদেশের বাইরের অধিকাংশ সাহিত্যেই জাতকের প্রভাব সুস্পষ্ট। অসংখ্য লেখক তাদের লেখনীর উপাদানের জন্যে জাতকের কাছে হাত পেতেছেন। এমনকি, অতি জনপ্রিয় ঈশপের নীতিবাক্য সম্বলিত ফেবল্সেও জাতকের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
প্রয়াত ঈশান চন্দ্র ঘোষ ফৌসবল গ্রন্থের ইংরেজি হতে বঙ্গানুবাদ করে ছয়টি খণ্ডে জাতকের মূল কাহিনী সংরক্ষণ করেন। বৌদ্ধ জাতকের বিশেষত্ব শুধু হিতোপদেশ প্রদান বা প্রচার করা নয়। এর মাধ্যমে প্রাচীন ভারতবর্ষের মানুষের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, লোকজীবনের লৌকিকতা, গার্হস্থ্য জীবনের প্রেম-প্রীতি, রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি তুলে ধরা হতো। জাতকে সমাজ জীবনের ইতিহাস, রাজনৈতিক, পটভূমিও উঠে আসতো দর্পণের প্রতিবিম্বের মতো। মোটকথায় জাতকের কাহিনীগুলোতে সমাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগলিক বিবর্তনের বহুমাত্রিক তথ্যও ফুটে উঠে।
মূল জাতক গদ্য ও পদ্যে রচিত। তবে পদ্যের চেয়ে গদ্য অংশের বিস্তৃতি বেশি। জাতকে পাঁচশ সাতচল্লিশ খানা পদ্য বিরচিত আছে। জাতকের তিনটি অংশ আছে। এটিই জাতক চিহ্নিত করার মূল উপাদান। জাতকের প্রধান তিনভাগের প্রথমটি হলো প্রত্যুপন্ন বস্তু। প্রত্যুপন্ন বস্তু হলো বর্তমানকে ঘিরে বর্ণিত। বুদ্ধ ধর্ম দেশনা কালে বা শিক্ষাপদ ব্যাখ্যাকালে যে পাত্র-পাত্রী থাকতো এবং যে পরিস্থিতি উদ্ভব হতো তাই-ই হলো প্রত্যুপন্ন বস্তু। জাতকের দ্বিতীয় অংশটি হলো বুদ্ধের অতীত কোনো এক জন্মের জীবন। এটাই মূল জাতক। এই অংশে জাতিম্মর বুদ্ধ শিক্ষণীয় অতীত জন্মের কাহিনী গল্পচ্ছলে বর্ণনা করতেন। জাতকের তৃতীয় অংশ হলো সমবধান। সমবধান হলো সম্পর্ক স্থাপন। বুদ্ধের দেশনাকালীন পাত্র-পাত্রীর সাথে অতীত জন্মের পাত্র-পাত্রীর তুলনান্তে সম্পর্ক স্থাপন ও শিক্ষা সমাপনই হলো সমবধান।
বুদ্ধের অতীত জন্মের বুদ্ধ-চরিত্রকে বলে বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্বের দান-শীল-প্রজ্ঞার আচরণই জাতকের মূল প্রতিপাদ্য। জাতকের সূচনার ভাষা অনেকটা রূপকথা বা উপকথা বা লোককথা বলার ঢংয়ে বর্ণিত। ইংরেজিতে যেমন Once upon a time ধরনের সূচনায় Fairy tale গুলো বর্ণিত হয় তেমনি জাতকও ‘পরকালে বারানসীতে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন’-এই ভাষাভঙ্গি দিয়ে সূচিত হয়। জাতক বর্ণনার সময়কালে বারানসী রাজ্যই অধিক হারে উল্লেখিত হয়েছে এবং ব্রহ্মদত্ত নামক রাজার শাসনই বর্ণিত হয়েছে। জাতকের কাহিনীতে বোধিসত্ত্ব কখনও রাজা, কখনও মন্ত্রী, কখনো সামান্য গৃহীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষের মতোই বোধিসত্ত্বের চরিত্রের দোষগুণ বিদ্যমান ছিলো। তিনি কোনো অলৌকিত্বের অধিকারী ছিলেন। না। তবে তার চরিত্রে সত্য ও ন্যায়ের শক্তি থাকতো অধিক। দয়া ও দানের মমতা থাকতো অপার। চরিত্রবল থাকতো অটুট।
গৃধ্র জাতকে বোধিসত্ত্ব গৃধ্র বা শকূন হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এক শ্মশান হতে শকূনরূপী বোধিসত্ত্ব মৃত গরুর মাংস এনে তার শকূন বাবা-মাকে খাওয়াতেন। কিন্তু সেই শ্মশানে এক ব্যাধ ফাঁদ পেতে রাখায় বোধিসত্ত্ব তাতে আটকে গেলেন। আটক বোধিসত্ত্ব নিজের জন্যে না ভেবে বাবা-মার জন্য চিন্তা করতে লাগলেন। ব্যাধ আটক বোধিসত্ত্বকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করেন-তার দুঃখ কি? জবাবে শকূনরূপী বোধিসত্ত্ব বললেন, বৃদ্ধ বাবা-মার আমি ভরণ-পোষণ করি। আমি না থাকায় তারা কি করবে? ব্যাধ জিজ্ঞাসা করেন-শকূনরাতো আকাশে অনেক উপর থেকে মৃত গরু দেখতে পায়। তুমি কেনো তা দেখতে পেলে না। বোধিসত্ত্ব উত্তরে বলেন, আয়ু শেষ হলে জীবগণ কাছের জিনিসও দেখতে পায় না। আমিও সে রকম এই ফাঁদ দেখিনি। তখন ব্যাধি বোধিসত্ত্বকে মুক্তি দিয়ে বললেন, তুমি তোমার বুড়ো বাবা-মা’র প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। এতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাই তোমাকে মুক্তি দিলাম। বোধিসত্ত্ব এতে ব্যাধের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এই জাতকের যে হিতোপদেশ-তাতে বলা হচ্ছে, মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সত্যবাদীরা চরম বিপদ থেকেও রক্ষা পান।
সম্মোদমান জাতকে বোধিসত্ত্ব ভারুই পাখিকূলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একদিন ভারুই পাখির দলপতি ছিলেন। শিকারী ব্যাধ ফাঁদ পেতে তার দলের সদস্যকে ধরে নিয়ে যেতো। এতে ভারুই পাখির সংখ্যা কমে যেতে লাগলো। বোধিসত্ত্ব খুব চিন্তা করে সবাইকে বললেন, পরেরবার ব্যাধ ফাঁদের জাল ফেললে সবাই এক সাথে জাল সহ উড়ে যাবে। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন ব্যাধ জাল ফেললে পাখির দল নেতার কথা মেনে জালসহ উড়ে যায় বনে। এতে কোনো পাখি ধরা পড়েনি। কিন্তু একদিন তাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়। এক পাখির মাথায় অন্য পাখির পা লাগায় বিবাদ শুরু হয়। ফলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। বোধিসত্ত্ব তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা অবুঝ। বোধিসত্ত্ব তার পরিবার নিয়ে নিরাপদে সরে গেলেন। এবার বিবাদ সঙ্কুল পাখির দলের উপর একদিন ব্যাধ জাল ফেললো। তখন পাখিদের কেউই নিজে থেকে জাল উঠানোর চেষ্টা করলো না। সবাই চিন্তা করলো দেখি আমি জাল না তুললে কিভাবে তারা উড়তে পারে। এতে ব্যাধের সুবিধা হলো। উড়তে অনিচ্ছুক বিবাদে ব্যস্ত পাখিকূলকে জাল গুটিয়ে ব্যাধ সবাইকে ধরে ফেললো। এই জাতকের হিতোপদেশ হলো-একতাই বল। এরকম জাতকের গল্পকে উপজীব্য করে ‘দলবেঁধে চলি’ নামে শিশুপাঠ্য রচিত হয়েছে।
নক্ষত্র জাতকে বোধিসত্ত্ব এক গ্রামবাসীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তখন বারানসী নগরের লোকজন জনৈক গ্রামের এক গ্রামবাসী মেয়ের সাথে নগরবাসী পাত্রের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। কিন্তু নগরবাসীরা তাদের কূলগুরু আজীবকের আর্শীবাদ নিতে গেলে আজীবক মনে মনে ক্ষেপে যায়। তাকে না জানিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করায় তার মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। বিয়ে পণ্ড করার জন্যে আজীবক বলে ওঠে, বিয়ের দিন নক্ষত্র লগ্ন মোটেই শুভ নয়। আজ বিয়ে হলে অমঙ্গল হবে। এই শুনে নগরবাসীরা আর ঐদিন বিবাহ বাসরে যায়নি। এদিকে পাত্র পক্ষকে আসতে না দেখে পাত্রী পক্ষ অন্য আর একজনের সাথে নিরূপায় হয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। পরদিন নগরবাসী-পাত্রপক্ষ বিয়ে করতে আসলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ হয়। বোধিসত্ত্ব নিকটে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি একসময় বলতে শুরু করলেন, নক্ষত্র লগ্ন শুভ কি অশুভ তাতে কি আসে যায়। মূর্খরাই নক্ষত্রের লগ্ন নিয়ে শুভ-অশুভ চিন্তা করে। যথাসময়ে কাজ সম্পাদন করে সুফল অর্জনই শুভ লক্ষ্মণ। শুভ কাজে নক্ষত্রের কোনো যোগ নেই। বরং তিথি-নক্ষত্র মেনে চলতে গেলে নিজেদেরই কাজের ক্ষতি হয়। বোধিসত্ত্বের উপদেশ শুনে উভয় পক্ষ শান্ত হলো। এই জাতকের হিতোপদেশ হলো�শুভ কাজের কোনো কালাকাল নেই।
বক্ষ্যমান আলোচনায় বর্ণিত জাতকের মতো বৌদ্ধ জাতক সাহিত্যে বাবেরু জাতক, সুবর্ণ কর্কট জাতক, নামসিদ্ধি জাতক, গিরিদণ্ড জাতক, কালকর্ণী জাতক ইত্যাদি আরো অনেক জাতক আছে। এইসব জাতক হতে ‘গুণ থাকলে সকলে সমাদর করে, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু, নামে না কর্মে পরিচয়, খারাপকে অনুসরণ অনুচিত, ত্যাগই সুখ ভোগে সুখ নেই….ইত্যাদি হিতোপদেশ পাওয়া যায়।
আধুনিক কালের শিশু সাহিত্যের অনেকগুলোরই মূল উপজীব্য বিষয় বৌদ্ধ জাতক সাহিত্য। এমনকি অনেক নীতিবাক্যধর্মী পদ্যের উৎসও বৌদ্ধ জাতক সাহিত্য। জাতক সাহিত্যের ভাষা হয়তো আধুনিক নয় কিন্তু তার শিক্ষা ও কাহিনী বর্ণনা আজও সমান উপযোগী এই যন্ত্রণাদগ্ধ সমাজে। তাই কেবল ললিত সাহিত্য নিয়েই জীবন নয়, জীবনে নৈতিক সাহিত্যেরও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
শেয়ার করুন