রোমানা পাপড়ি:
(প্রথম পর্ব)
ভূমিকাঃ
যাঁর সাধনায় পৃথিবীকে নতুন আলোয়ে উদ্ভাসিত করেছে এবং তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের ধর্ম, সাহিত্যে, বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-কলা ও স্থাপত্য, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল বিভাগকে সজীব করে দিয়েছিল তিনি হলেন মহাপুরুষ গৌতম বুদ্ধ। তিনি হিমালয়ের পাদদেশেস্থ কপিলাবস্তু নগরে আনুমানিক খ্রী. পূ. ৬২৩ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। শাক্য বংশের রাজা শুদ্ধোধন ও মাতা মহামায়ার একমাত্র পুত্র ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রাজ্যের সুখ-আহলাদ উপভোগ করেনি। মানব তথা সকল প্রাণীর দুঃখ মোচনার্থে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর ধ্যান-সাধনা করে অবশেষে পরম সত্যের সন্ধান বা পরম জ্ঞান লাভ করে গৌতম বুদ্ধ উপাধিতে ভূষিত হন। ললিতবিস্তর গ্রন্থে তুষিত স্বর্গ হতে চ্যুত হয়ে বুদ্ধের মায়াদেবীর গর্ভে জন্মগ্রহন, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বারানসীতে ধর্মচক্র প্রবর্তন পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা মহাযানী ভাবধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
২.ললিতবিস্তর গ্রন্থের পরিচিতিঃ
মহামানব গৌতম বুদ্ধ যে ভাষায় শিষ্যদের উপদেশ প্রদান করতেন তাকে পালি ভাষা বলা হয়। বুদ্ধের বাণী সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে পালি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। পালি ভাষা ছাড়াও সংস্কৃত, আধা-সংস্কৃত ভাষায় বহু বৌদ্ধগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থগুলো পালি ভাষার ন্যায় পরপর সাজানো ও সুরক্ষিত না হলেও প্রকাশভঙ্গী, রচনাশৈলী, বর্ণনা ও ভাব-বিশ্লেষণ কোনো বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থের চেয়ে কম নয়।
সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্মপ্রচার করে গৌতম বুদ্ধ আশি বছর বয়েসে মহাপরিনির্বান লাভ করেন। তাঁর নির্বান প্রাপ্তির তিন মাস পর প্রথম সঙ্গীতির আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ভগবান বুদ্ধের বাণীগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা। মহামানব বুদ্ধ যখন শিষ্যদের উপদেশ দিতেন তখন তাঁর শিষ্যরা শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতেন। দ্বিতীয় সংগীতির সময় বজ্জীদের কারনে বৌদ্ধ সংঘ দুটি রূপান্তর হলো। দশবত্থনী যারা মানতেন তারা মহাযানী আর মূলধারা ভগবান বুদ্ধের অনুসারীরা ছিল মহাযানী। এভাবে দ্বিতীয় সংগীতেই মহাযানী বৌদ্ধধর্মের বহিঃপ্রকাশ পায়। চতুর্থ সংগীতিতেই কণিষ্কের সময়কালে পূণাঙ্গ মহাযান বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীসময়ে মহাসাংঘিকরা মহাযান আর স্থবিরবাদীরা হীনযান রূপ ধারণ করে। মহাযানীদের নিজস্ব কোন ত্রিপিটক নেই। হীনযানীদের এই ত্রিপিটক সাহিত্যই হচ্ছে মহাযানীদের প্রধান অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা করেছেন।
মহাযান বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যে ৯টি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় যাকে নব মহাযান সূত্র বা নবধর্ম পর্যায় যেগুলোকে ললিতবিস্তরসহ ‘বৈপুল্যসুত্র’ বলা হয়ে থাকে। এসব গ্রন্থ নেপালে রক্ষিত বৌদ্ধ আগমগ্রন্থ নামে পরিচিত। যথাঃ
Ø ললিতবিস্তর
Ø সমাধিরাজ সূত্র
Ø লংকাবতার সূত্র
Ø অষ্ট্রসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র
Ø গণ্ডব্যুহ সূত্র
Ø সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্র
Ø দশভূমিক সূত্র
Ø সুবর্ণপ্রভাস সূত্র
Ø কারণ্ডব্যুহ সূত্র
উপরোক্ত গ্রন্থসমূহ নিয়ে বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সকল সংস্কৃত গ্রন্থ শুধু বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যে এদের মূল্যায়ণ রয়েছে।
৩. ললিতবিস্তর শব্দের অর্থঃ
ললিতবিস্তর (ললিত+বিস্তর) শব্দটি ছোট হলেও এর অন্তনিহিত তাৎপর্য ব্যাপক।
বাংলা একাডেমী প্রণীত ব্যাবহারিক বাংলা অভিধানে লেখা আছে, ললিত শব্দের অর্থ সুন্দর, মনোহর, চারু, মনোরম, কমনীয়, কোমল, সুকুমার, মধুর ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে বিস্তার বলতে চওড়া, প্রসার, বিস্তৃত, প্রস্থ, প্রসারণ, প্রসার, প্রাপ্তি, পরিসর, ব্যাপক, প্রসারিত, ছড়ানো, বিছানোকে বোঝানো হয়েছে।
বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পালি-বাংলা অভিধান (২য় খ-) লেখা আছে, ললিত শব্দের অর্থ ক্রীড়া, চলন, সুন্দর, কোমল, প্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির উপাধিবিশেষ, অনন্ত জীবন, মুক্তি, আকর্ষণ ইত্যাদি।
বাংলা একাডেমী প্রণীত পালি-বাংলা অভিধানে লেখা আছে, আচরনের স্বাভাবিক মাধুর্য বা সৌষ্ঠব আকর্ষণশক্তি, মনোহারিত্ব সৌন্দর্যই ললিত।
বাংলা একাডেমী প্রণীত Bengali-English Dictionary – তে বলা হয়েছেঃ ললিত হলো Charming, lovely, beautiful, pleasant, gentle, soft, artless, innocent, desired, wished for quivering, wanton, tremulous, playing, amorous, voluptuous, suave, bland.
বিস্তর হলো -Spreading, extent, expanses, stretching, stretch, spread, width, breadth, amplitude, specification, detailed, description, enumeration.
ড. জগন্নাথ বড়ুয়া তাঁর বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য গ্রন্থে বলেছেন, ললিত অর্থ কলা, ক্রীড়া, কৌশল, ভাব আর বিস্তর হলো বর্ণনা, বিবরণ, বিশ্লেষণ, বিস্তার।
৪. প্রামান্য সংজ্ঞাঃ
ললিত বিস্তর সম্পর্কে অনেক প্রাজ্ঞ পন্ডিতজন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। একেক জনের বক্তব্য উপস্থাপন করা হলো।
অধ্যাপক ভিক্ষু শীলাচার শাস্ত্রী তাঁর মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন গ্রন্থে বলেছেনঃ
“মহাযান বৈপুল্য সুত্রসমূহের মধ্যে ললিতবিস্তর অতি পবিত্র তথা মহাসাংঘিক লোকত্তরবাদীদের প্রামাণিক গ্রন্থরত্ন। ভগবান ভূমন্ডলে যে সমস্ত ক্রীড়া (ললিত) প্রদর্শন করেছিলেন, তারই বিস্তৃত বর্ণনা হওয়ায় গ্রন্থের নাম ললিত বিস্তর।”
আচার্য নরেন্দ্র দেব তাঁর বৌদ্ধধর্ম দর্শন গ্রন্থে বলেছেন,“ললিতবিস্তরকে অভিনিস্ক্রমন সূত্র তথা মহাব্যুহও বলা হয়। তুষিত স্বর্গলোক থেকে ধর্মচক্র প্রবর্তন পর্যন্ত সবিস্তর বুদ্ধচরিতকথা বর্ণিত হয়েছে।”
মনিষী ওল্ডেনবার্গের মতে, “মহাযানের অন্যতম বৈপুল্যসুত্ররূপে গৃহীত ললিতবিস্তর মূলে সম্ভবত সর্বাস্তিবাদীদের লেখা একটি বুদ্ধজীবনী।”
বাঙালী বৌদ্ধ আচার্য ড. রবীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া তাঁর পালি সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খ-) গ্রন্থে লিখেছেন, “বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কীয় যত পুস্তক সংস্কৃতিতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে ললিতবিস্তর সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। মহাযান সম্প্রদায়ের লোকেরা এই গ্রন্থ বৈপুল্য সূত্র বা দীর্ঘসূত্র বলে ধারনা করেন।”
লেখক: রোমানা পাপড়ি
এম. ফিল গবেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(চলবে)
শেয়ার করুন।