ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের:
শ্রদ্ধা ও ভক্তি নামে দুইটি বহুল পরিচিত শব্দ এদেশে বহুকাল ধরে গণ-মানসে বিরাজ করছে। কিন্তু তার প্রচলন কবে থেকে শুরু এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। গুরুজনকে শ্রদ্ধা কর, ভগবানকে ভক্তি করো, এই হিতোপদেশ কানে লাগা মাত্রই কোমলমতি, সরল-প্রাণটি আবেগে উদ্বেলিত হয় তাৎক্ষণিক ভাবে। তখন শ্রদ্ধা আর ভক্তি-এ দু’য়ের মধ্যে কোন ইতর বিশেষ থাকে না ভাবুক হৃদয়ে। ভারত উপমহাদেশে বুদ্ধের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে, তাঁর দার্শনিক তত্ত্বের প্রচার-প্রসারের সাথে সাথেই শ্রদ্ধা আর ভক্তি শব্দ দ্বয়ের অর্থ ও ব্যবহারিক পার্থক্য ব্যাপক হয়ে ওঠে। যার গুণ-গরিমা, জ্যেষ্ঠত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়, তাঁকে শ্রদ্ধা কর। কারণ এই শ্রদ্ধা শব্দের ভাবগত তাৎপর্যে যুক্তি আছে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে, পাত্র-ভেদে শ্রদ্ধার তারতম্যের বিচার মীমাংসা আছে। অপরদিকে যাকে যুগ-যুগান্তর ব্যাপী কেহ দেখেনি, কেবল শ্রুতি ও শাস্ত্র পরম্পরা ভাবুক হৃদয়ে মূর্ত্তিমান করে রাখা হয়েছে, তেমন অমূর্তের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জাত যেই নিবেদন তার নাম ‘ভক্তি’। মানুষের সাথে সম্পূর্ণ মানস নির্ভর এই ‘ভক্তি’। এই ‘ভক্তি’কে নিয়ে তাই কিছুতেই চলে না কোন যুক্তি, তর্ক বা প্রমাণের অস্ত্রোপচার। যা শুনেছি সরল মনে, কেবল তা-ই বিশ্বাস করো। কারণ ‘ভক্তিতে মিলিবে হরি তর্কে বহুদূর’। অতএব, শুরুতেই সাবধান তিনি কে? কোথায় থাকেন? কিভাবে আছেন? এতসব বাচলামি করতে যাবে তো, কেবল ঘোড়ার ডিমই জুট্বে তোমার কপালে। ভারতীয় মৌসুমীতে গড়া নরম মানসীরা এই নরম সাবধানী দিয়েই ক্ষান্ত হন। কিন্তু মরুর কাঠিন্যের গড়া কন্ঠীরা কঠোর কণ্ঠে বলে দেন, এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না; করলে হয় ঈমান যাবে, তো গর্দান যাবে। বেশ তাহলে, আর টু শব্দটি করার জো কোথা?
হ্যাঁ বলছিলাম কি। ভক্তির স্বরূপ প্রকৃতি এমনই হয়। সম্পূর্ণ বিশ্বাস আর আবেগ নির্ভর হওয়াতে এই ভক্তি অতি সহজেই, মানব মনকে প্লাবনমুখি জোয়ারে পরিণত করতে সক্ষম। দুকূল উপচ্েপড়া আবেগের এই উন্মাদনায়, এই বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মুখে, যুক্তির জাল পাত্তে যাওয়া শুধু কঠিন নহে, জীবনের ঝুঁকিও থাকে প্রচুর। কপিলাবস্তুর রাজপুত্র সন্ন্যাসী হয়ে, তেমন কাজটিই করতে গিয়েছিলেন সেদিন, একান্ত অকুতোভয়ী হয়ে। সত্যোপলব্ধি জাত তাঁর অসামান্য মনোবল, বীরদর্পে এভারেষ্টের মতো শির উচুঁ করে, ভারতের উপনিষদীয় ব্রাহ্মণ্য ভক্তিবাদের মহাপ্লাবনে খরস্রোতের বিপরীতে তাঁকে সেদিন দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শুধু ভারত কেন, পুরো বিশ্বের মানব সমাজেই তখন চল্ছিল ভক্তিবাদের এক মহাপ্লাবন। জৈন-সাংখ্যদের ন্যায় যুক্তিবাদী জোনাকীরা ছিলেন নিজের অস্থিত্ব নিয়েই ব্যস্ত, অনেকটা আপোষ-রফা করে ব্রাহ্মণদের সাথে। কারণ শ্রদ্ধাবাদী-এসকল মতবাদীরা নিজেদের মতাদর্শের সিদ্ধান্ত নিয়ে, নিজেরাই ছিলেন সন্ধিগ্ধ এবং অস্পষ্ট। কিন্তু, বুদ্ধজ্ঞানে পরিপূর্ণ জ্ঞানের আলোয় সুর্যের ন্যায় উদ্ভাসিত যার চিত্ত, সেই সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ গৌতমের মনে সেদিন কোন সন্দেহ ছিলনা, অস্পষ্টতা ছিলনা, আপন প্রাপ্তি ও সিদ্ধান্তে। অতএব সন্দেহ, জড়তা ও দ্বিধাহীন চিত্তেই তিনি সকল ভিন্ন-মতাবলম্বীদের সামনে একাই ছিলেন হিমালয়, একাই এভারেষ্ট। পরম সত্য সেই চারি আর্যসত্য, আর প্রতীত্য সমুৎপাদ এর মতো বুদ্ধ জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে অবগাহিত বুদ্ধ গৌতমের চিত্ত শক্তির মধ্যে অপরাজেয় বীর্য-বর্তা ছিল, পরাক্রমতা ছিল, কিন্তু অন্ধ-আবেগের উন্মাদনা ছিল না। অকুতোভয়ী তাঁর চিত্ত শক্তিতে অনমনীয়তা ছিল। কিন্তু একই সাথে যুক্তিগ্রাহ্যতা, সচেতনতা, গাম্ভীর্যতা এবং প্রত্যুৎপন্ন মতিত্বের প্রখরতাও ছিল তাতে। তাই ভক্তিবাদের আবেগ-উম্মাদনা, প্রতি পদে পদে এই মহাবীরের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল সেদিন।
অতঃপর কি হতে কী হয়ে গেলো! মহাজ্ঞান, মহাপরাক্রমের এই বিশাল উৎস ভূমিতে? মূল উৎসের স্বভাব স্বরূপ এর সম্যক্ উপলব্ধি ও ধারণ চরম অক্ষমতা এবং এতে করে মূল ধারার বিচ্যুতি; বুদ্ধ বাণীর ধারক বাহক ভিক্ষুসংঘ এবং বুদ্ধ বাণীর পৃষ্ঠপোষক গৃহী সংঘের মধ্যে এই অক্ষমতা, এই বিচ্যুতিই কাল হয়ে দাঁড়ালো, ভারত উপমহাদেশে বুদ্ধের ধর্মও দর্শনের স্থায়িত্বের উপর তার অপরাজেয়তার উপর। বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ ও গৃহীসংঘ, বুদ্ধ প্রণীত শ্রদ্ধাবাদকে একদল নিয়ে গেল চুলছেঁড়া যুক্তি-তর্কের প্রজ্ঞাবাদে; আর একদল নিয়ে গেল ব্রাহ্মণদের চেয়েও দ্বিগুণ অন্ধত্বের ভক্তিবাদে। তাতে করে বুদ্ধের শ্রদ্ধাবাদ প্রণীত মধ্যপন্থায়; আর কেহ থাকলো না। বুদ্ধ শিক্ষার এই মধ্যম নীতি বর্জনই ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মের বিলুপ্তির প্রধানতম কারণ। বিশ্বখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক অসঙ্গ, বসুবন্ধু আর নাগার্জুনদের মতো অসংখ্য নাম জানা-অজানা দার্শনিকদের শুষ্ক-নিরস তর্কের জালে আবদ্ধ হয়ে, বুদ্ধ-প্রাণ, বুদ্ধ শিক্ষা, যেমন সেদিন ছট্পট্ করেছিল ভারতের এই মাটিতে, অপর দিকে যুক্তির দুর্ভেদ্য প্রাচীর, আড়াল করে দিয়েছিল সেদিন বুদ্ধের দুঃখ মুক্তির করুণাঘন আহবানকে ভারতের জনমানস হতে। তাই সেদিনের ভিক্ষু-গৃহীরা, বাঁচার উপায় হিসেবে বুদ্ধের জ্ঞান দর্শনকে সহজ সরলীকরণ চেয়েছিল মনে প্রাণে। বুদ্ধ আবিষ্কৃত ‘শ্রদ্ধাটি’ ছিল প্রজ্ঞা+বিশ্বাস-এ দু’য়ের সমন্বয় সাধন পন্থা! সেই শ্রদ্ধার এক অংশ প্রজ্ঞাবাদের প্রতি, এই মানুষগুলো যখন ত্যক্ত-বিরক্ত; তখন শ্রদ্ধার অপরাংশ বিশ্বাস নামক ভক্তিবাদ তথা মনোবাদের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেড়ে গেল স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু, সেই ভক্তিবাদের প্রথম ধাপ কাল থেকে দখলীকৃত ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে। ফলে বৌদ্ধ সরলীকরণ বাদী ভিক্ষু, গৃহীরা স্থান করে নিল ব্রাহ্মণ্যবাদের নীচের স্তর থেকে আরো ক্রমিক নীচুতর দিকে। অর্থাৎ ভক্তিবাদের অন্ধত্বে সরলীকরণবাদীরা হলেন ব্রাহ্মণ্যদের তুলনায় আরো দ্বিগুণ, ত্রিগুণ আবেগের শিকার। তাই ব্রাহ্মণেরা মনোময় একটি মূর্ত্তিকে আকার দিলে, বৌদ্ধগণ দিলেন দু’টি, তিনটি দেবদেবীর মূর্ত্তিকে। অচিরেই অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্ত্তিতে তাই ভরে গেল বুদ্ধের আসন। জাহাজের তলায় ছিদ্রটি শুরুতে সামান্য হলেও তা বড়ো হতে বেশীক্ষণ লাগেনা। অধঃপতনের বিকৃত স্বাদ একবার পেলে, তার লবণাক্ত চাহিদার লক্লকে জিহ্বার প্রসারণ কেবল হতেই থাকে। তাই অসংখ্য আশা-আকাঙ্খা জাত পোড়ামাঠিতে বা ধাতবে গড়া বৌদ্ধ দেব-দেবীর মধ্যে ক্রমেই উষ্ণ লোনা রক্ত-মাংসের আমদানী হতে বেশী দিন লাগেনি। অরহত ভিক্ষুণী গৌতমী যশোধরাদের বংশধরগণ এবং অরহত ভিক্ষু সারিপুত্র-আনন্দদের বংশধরগণ, এখন কামনা বাসনা ক্ষয়ের মধ্যপনা’ অবলম্বনের পরিবর্তে ভক্তিবাদী কামনা-বাসনা বৃদ্ধির সাধনাতেই নিমগ্ন হলেন। এতে করে বুদ্ধ পুত্র ভিক্ষুরা একাদশ, দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে, হয়ে গেলেন বৌদ্ধ নেড়া মাথার নারোপা, কাহ্নুপা, লুঁইপা; আর বুদ্ধ কন্যা ভিক্ষুনীরা হয়ে গেলেন বজ্র-যোগিনী, জ্ঞান ডাকিনী নেড়ীর দল। ব্রাহ্মণেরা চিরকাল সমাজ বন্ধনেই আবদ্ধ ছিলেন। তাই বহু বিবাহ প্রথার মাধ্যমে একাধিক নারী ভোগ করলেও, সামাজিকতার দায়িত্ব বোধ আর ভদ্রতাকে পায়ে মাড়াতে পারেননি। বিবাহ সূত্রে নারীর দায়-দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হতে হয়েছে তাঁদের। তাই স্বাভাবিক ভাবেই নারী ভোগে সংযমতা ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল এই ব্রাহ্মণদের। কিন্তু, সর্বত্যাগী বুদ্ধের নামে সর্ব ভোগী, একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর এসকল নেড়া-নেড়ীদের জীবনে সামাজিকতার কোন বালাই ছিল না, সমাজের ও লোকালয়ের বাইরে প্রতিষ্ঠিত, নিজস্ব সম্পদে সমৃদ্ধ সারা ভারতব্যাপী কামরূপ-কামাক্ষ্যা মন্দিরের ন্যায় আরণ্যিক বিশাল বিশাল মঠ মন্দিরে। পাঠক! ভেবে দেখুন, এমন সুবর্ণ সুযোগ-সুবিধায় সেই নেড়া-নেড়ীর ব্রহ্মচারীর নামে অব্রহ্মচর্যের চর্চায় ভোগ-উম্মত্ততায়, কোন্ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। তাদের এসকল অনৈতিকতাকে জন সাধারণের কাছে রাজা-মহারাজা আর ধনী-শ্রেষ্ঠীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কিছু প্রয়োজন ছিল, আপন অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে। তাই গুহ্য-চক্র, ভৈরবী-চক্র ইত্যাদি গোপন ও প্রকাশ্য আচার অনুষ্ঠানগুলোর মহনীয়তা প্রকাশে তারা অতিদক্ষতার সাথে কাল্পনিক দেবদেবীর অলৌকিক শক্তিমত্তার কাহিনীকে সংযুক্ত করে দিলেন। এইলক্ষ্যে মানুষের যাবতীয় আশা-আকাঙ্খার প্রার্থনা পরিপূরণকারী দেবতাদের অতীন্দ্রিয় শক্তি প্রকাশক শ্লোক এবং পুঁথি পত্র ও রচিত হলো অসংখ্য, পূজার অর্ঘ্য নিবেদনে। তান্ত্রিকতার নামে ইন্দ্রজালিক কর্মকাণ্ড আয়ত্ব করে তারা সাধারণ জনকে মোহিত-চমকিত করলেন। উদাহরণ স্বরূপ উত্তর বঙ্গের সোমপুরী বিহার বা উড়িষ্যার সোমনাথ মন্দিরের ঘটনাটি উল্লেখ করা যাক। সেই মন্দিরে ছিল শুন্যে অবস্থানকারী একটি ধাতব মূর্ত্তি। এই মূর্ত্তিটির এহেন আশ্চর্য ঋদ্ধিতে মুগ্ধ জনগণের যুগ যুগ ধরে প্রদত্ত সোনা-রূপা, মনিমুক্তার শ্রদ্ধার্ঘের বিশাল ভাণ্ডার আকর্ষণ করলো তুর্কি মুসলিম আক্রমণকারীদের। তারা তরবারির আঘাতে মুর্ত্তিটিকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে, এই মূর্ত্তিটি শূন্যে অবস্থানের কারণ হচ্ছে, তার চারপাশে স্থাপিত চারিটি শক্তিশালী চম্বুকের আকর্ষণ। সেদিন সারা ভারতবাসী এসকল বৌদ্ধ দেবদেবীর পূজা উপলক্ষে হাজারো উৎসব, অনুষ্ঠানে তাদেরকে দান মহনীয়তার স্তব-স’তি প্রথা তারা চালু করলেন। এ সব নিয়ে ব্যস্ততাই ছিল এ সকল বৌদ্ধ নেড়া-নেড়ীদের মুখ্য বিষয়-নির্বাণ সাধনা নহে। নানাভাবে, নানা উপায়ে নিকৃষ্ট ভক্তিবাদে নিমজ্জিত করলো এই নেড়া-নেড়ীরা ভারত এবং ভারতের বাইরে মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ভূটান, তিব্বত, চীন, কোরিয়া, জাপান-এমনকি বার্মা, থাইল্যাণ্ড, শ্রীলংকাদি এই বিসত্মীর্ণ অঞ্চলকে। সেই বিসত্মীর্ণ অঞ্চলের বিশাল বৌদ্ধ জন-গোষ্ঠীর এই ভক্তি বাদ ছিল, সম্পূর্ণ কাল্পনিক দেব-দেবীর কৃপানির্ভর। তাই এই সকল দেব-দেবীর কৃপা লাভের মাধ্যমে আপন ভাগ্য-উন্নতি, রোগ-বালাই মুক্তির জন্যে পূজা-অর্চনা, মানত্-ছিন্নত, ঝাড়-ফুকতুক-তাক, তাবিজ-টোনা; এ সবই ছিল তখনকার বৌদ্ধ ধর্মের পরিচয়। গৃহীদের দান, শীল, ভাবনা বা ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার সাধনা; এসব তখন ছিল অবান্তর অথবা অসম্ভব বিষয় মাত্র।
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে পুরো ত্রয়োদশ শতাব্দী জুড়ে এদেশের উপর প্রবাহিত হলো এক হাতে কোরাণ আর এক হাতে তরবারি নিয়ে ইসলামের রণ হুঙ্কারের অপ্রতিরোধী ঢেউ দিল্লীর সেই খাইবার পাস দিয়ে। দিল্লী কাশ্মীর হতে আসামের ব্রহ্মপুত্র বঙ্গের নাফ্ নদী, দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত নানা মতবাদে শতধা বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র বৃহৎ বৌদ্ধ রাজ্য ও জনপদ সমূহ শুধু নহে, ব্রাহ্মণ্য বাদ প্রভাবিত রাজ্য গুলোও একে একে আক্রান্ত, পদানত হলো, ইসলামের বিজয় যাত্রার মুখে। তবে রাজ্য রক্ষায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাজারা বিচ্ছিন্ন হলেও স্বশক্তিতে শত্রুর বিরুদ্ধে বহুবার যুদ্ধ করেছেন তাঁদের ধর্মগ্রন্থ গীতা, রামায়ণ, মহাভারতের প্রেরণায়। কিন্তু বৌদ্ধদের ঘরে তো তখন কোন ধর্মগ্রন্থই ছিলনা। পুঁথিপত্র যা ছিল, সবই নেড়া-নেড়ীদের দখলে, বিহারে মন্দিরে। আবার তাও ছিল নিছক্ দেব দেবীর পূজা- উপাসনার মন্ত্রতন্ত্র সর্বস্ব। রাম-রাবণের যুদ্ধ, বা মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে ভীম-অর্জুনের বীরত্বের কাহিনীতো এসবে থাকার কথা নয়। তাই দেবদেবীর কৃপায় একান্ত বিশ্বাসী এ সকল বৌদ্ধরা স্বরাজ্য আক্রান্ত হলে, রাজা প্রজা কেহই প্রতিরোধ যুদ্ধে অগ্রসর হয়নি; তারা দৌঁড়ে ছিলেন বিরাট বিরাট দেবদেবীর মন্দিরে, তাদের অপার বিশ্বাসের ভাণ্ডার অনন্ত শক্তির আধার, সেই দেব-দেবীদের অলৌকিক শক্তিতে দেশ রক্ষার প্রার্থনায়। ইসলামের খড়গের আঘাতও সেখানেই গিয়ে পড়লো সকলের আগে অগাধ ধন-রত্ন লুণ্ঠনের আকষর্ণে। বৌদ্ধদের চোখের সামনেই তাদের শত শত বছরের পুঞ্জীভূত বিশাল বিশ্বাসের শক্তিধর দেবদেবীরা যখন, ইসলামের তরবারির আঘাতে আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড হতে শুরু করলো; অথচ সেই অলৌকিক মহাশক্তির আধার দেব-দেবীর কোন শক্তিই প্রকাশ পেলনা; তখনই বৌদ্ধ নেড়া-নেড়ীদের ঘোর মিথ্যার বেসাতি ফাঁস হয়ে গেল সকল বুদ্ধির বৌদ্ধ জন সাধারণের কাছে। প্রবল আত্ম-ধিক্কারের ঘৃণায়, চিরতরে তারা মুখ ফেরালেন কোন্ দিকে? স্বাভাবিক ভাবে নিরাকার পূজারী, রাজদণ্ডধারী যারা, তাদের দিকেই। ফলে, গুটিকয় মাত্র ইসলামী ধর্ম যোদ্ধরা, ভারতের বাইরে থেকে এসে পেয়ে গেলেন বিশাল সাম্রাজ্য এবং বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলামের পতকাতলে খুব সহজেই।
‘লৌহ হতে উৎপন্ন মল, লৌহকে ধ্বংস করে; এই বাস্তব প্রবাদ বাক্যটি আবার অমোঘসত্য বলে প্রমাণ করলো ভারতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ। ভারতের বৌদ্ধ-ধর্ম ও সমাজের বিলুপ্তিতে এভাবে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ালো বৌদ্ধগণ নিজেরাই? ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক শংকরাচার্য, কুমারিল ভট্ট, রামাণুজেরা বৌদ্ধদের প্রচুর ক্ষতি করলেও এভাবে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না কিছুতেই। কেহ কেহ প্রশ্ন করেন, ইসলামের আক্রমণ তো ভারতের বুকে হিন্দু-বৌদ্ধ উভয়ের উপর সমানই ছিল কিন্তু হিন্দুরা টিকে গেল, বৌদ্ধরা বিলুপ্ত হলো কেন? আমি একে বিলুপ্তি বলবো না, বৌদ্ধদের আত্মবিসর্জনই বলবো। আমার এ মন্তব্যের ঐতিহাসিক সত্যতা পূর্বোক্ত বর্ণনায়, পাঠক নিশ্চয় অনুধাবনে সক্ষম হবেন। বৌদ্ধরা নিজেরাই নিজেকে শেষ করেছে। তবে এ দোষে যারা সবচেয়ে বেশী অভিযুক্ত হওয়া উচিত, তারা হলেন মহান বুদ্ধ প্রবর্ত্তিত উচ্চতম আদর্শের ধারক মহান ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের পরবর্তী নিকৃষ্টতম বংশধর পঞ্চ কামভোগী সেই নেড়া-নেড়ী এবং তন্ত্র-মন্ত্রে ভক্তিবাদের প্রবর্তকেরা। আরো যেই কয়েকটি কারণ ভারতে বৌদ্ধদের অবলুপ্তির জন্যে দায়ী, তা একটি তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা যেতে পারে-
১. ব্রাহ্মণেরা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সাধারণ সমাজেরই বাসিন্দা, বেশ ভূষায়ও তাই। কেবল যিনি পুরোহিত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত, সেই ব্রাহ্মণই মন্দিরে বাস করেন। তাই হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হলেও মন্দিরবাসী এক ব্রাহ্মণ পরিবারই আক্রান্ত বা নিহত হয়েছেন। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে অভিজ্ঞ অপরাপর ব্রাহ্মণেরা বেশ-ভুষায় জনসমাজের সাথে একাকার হয়ে আত্মরক্ষা করতে পেরেছেন সহজে। কিন্তু, গ্রাম বা লোকালয়ের বাইরে বিহারবাসী, পৃথক বেশ-ভুষাধারী বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুনীরা মুসলিমদের আক্রমণের মুখে ব্রাহ্মণদের ন্যায় আত্মগোপন করা সহজ ছিল না। তাই তারা নিহত হয়েছেন বেশী, পালাতে পেরেছেন খুব কম।
২. ব্রাহ্মণদের ধর্মগ্রন্থ গুলো মন্দিরে পুঞ্জীভূত ছিল না। ছিল ব্রাহ্মণদের কাছে ও সমাজের ঘরে ঘরে। ফলে মন্দির ধ্বংস হলেও তাদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-বেদান্ত, রামায়ণ-মহাভারত রক্ষা পেয়েছিল। অপরদিকে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ হিন্দুদের মতো দু’চারটি নহে, অসংখ্য। আর তাও ছিল সমাজের ঘরে ঘরে নহে, বিশালকার মঠ-মন্দিরের বিশালাকার পাঠাগারে। এসকল ধর্মগ্রন্থের সমস্ত বিষয় গৃহীদের মনে রাখা দূরে থাক্, বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের পক্ষে পর্যন্ত দুঃসাধ্য ছিল। একারণেই তারা প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষর দিয়ে, ‘ধারণী’ নামে পৃথক পুস্তক তৈরী করেছিলেন; যেমন- আ,ই,উ,ম, স্বাহা-ইত্যাদি। এগুলোকেই মন্ত্র বা তন্ত্র রূপে ঝাড়-ফুক, তাবিজ-টোনায় ব্যবহার করে মানুষদের বশীভূত করা হতো। ইসলামের আক্রমণ ও ধ্বংস যজ্ঞে যখন নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলা সহ বিশালাকার সব বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস প্রাপ্ত হলো; তখন বৌদ্ধদের ধর্ম-গ্রন্থ রূপে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। ধারণী নামে সংক্ষিপ্ত বিষয় গুলোর অর্থ উদ্ধার ও চিরতরে অসম্ভব হয়ে পড়লো।
৩. ব্রাহ্মণেরা গৃহী এবং ধর্মগুরু উভয় দায়িত্ব পালন করেন বলে, গৃহী-সমাজের স্বভাব রুচি, পছন্দ-অপছন্দ এসব মানসিক বিষয় ও চাহিদা বুঝতে পারতেন সহজেই। এই আলোকে তাঁরা ধর্মকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মনের সাথে, দৈনন্দিন আচার ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত করার সহজতম উপায় গুলোর ব্যবহারের দক্ষ ছিলেন। ফলে হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থও মন্দিরে আবদ্ধ না থেকে, প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে হিন্দু সমাজের ঘরে ঘরে, জনসাধারণের দৈনন্দিন আচারে ব্যবহারে। এতে করে ইসলামের আক্রমণে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস হলে, এবং হিন্দুরা রাজধানীর ক্ষমতা হারালেও ধর্ম হতে তাদেরকে ইসলামী আক্রমণও শাসন বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে খুবই কম।
অপরদিকে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা সমাজ তথা লোকালয় হতে বিচ্ছিন্ন থাকার নির্দেশ তথাগত বুদ্ধ দিয়েছিলেন; ধ্যান-সমাধির মাধ্যমে আপন মনের লোভ, লালসা, আসক্তি, হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা এ সমুদয় পাপ প্রবৃত্তির মূল উচ্ছেদের জন্যে। কিন্তু, পরবর্তীকালের ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা বুদ্ধের সেই মহান ইচ্ছার বিপরীত জীবন গ্রহণের কারণে ধ্যান-সাধনার অনুকূল লোকালয় বিচ্ছিন্ন বিহার গুলো অনুকূল হয়ে দাঁড়ালো, অবৈধ কামাচারের। শীল-সমাধি-প্রজ্ঞায় বিভূষিত চন্দ্র সূর্যের মতো উজ্জল জীবন, হাজার মাইল দূর হতেও মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান, গৌরব আকর্ষণে সক্ষম। সেক্ষেত্রে বৌদ্ধ নেড়া-নেড়ীরা নিজেদের কদর্য-জীবনাচারে; অশ্রদ্ধা, অগৌরব এবং ঘৃণার পাত্রই হয়ে উঠেছিলেন রুচিবান মানুষের কাছে। অধিকন’ তারা ধর্মকে কখনো সমাজে ও মানুষের ঘরে তাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেননি। নিজেদের লাভ-সৎকার বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে ধর্মের নামে যত কিছু তারা করেছেন, সেই সবকিছু করার ব্যবস্থা করেছেন বিহারে। তাই তাদের হাতে বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে পড়েছিল বিহার চত্বর এবং নিছক নতুন উৎসব অনুষ্ঠান নির্ভর। বৌদ্ধ ধর্মের এই গণ-বিচ্ছিন্নতা, বৌদ্ধ সমাজে ইসলামের অনুপ্রবেশে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছিল। ভারতে বৌদ্ধ সমাজের অবলুপ্তি এবং ব্রাহ্মণ্য সমাজের টিকে যাওয়ার ইহাই সবচেয়ে বড়ো কারণ।
৪. বুদ্ধের ধর্মাদর্শ প্রচার প্রতিষ্ঠায় রাজা-মহারাজাদের এক বিরাট ভূমিকা ছিল। তা কিন্তু, রাজশক্তিতে বল প্রয়োগের মাধ্যমে নহে; বুদ্ধ শিক্ষার উচ্চতম নীতি আদর্শে জনমনকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে। একারণেই অসমপ্রদায়িক প্রথাগত নিয়মে বিনা প্রশ্নে প্রত্যেক বৌদ্ধ রাজার মন্ত্রীপদাবৃত থাকতেন ব্রাহ্মণেরা। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে রাজকীয় ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বুদ্ধ কোন দিন রাজ বা রাজনীতি নির্ভরতা মূলক কোন কোন শিক্ষা বা আদেশ-উপদেশ, তাঁর শিষ্য-সংঘ বা অনুসারীদের দেননি। তিনি তাঁর ধর্মের প্রচার প্রসারে প্রব্রজিত সংঘ এবং গৃহী সংঘ এদুয়ের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপরে গুরুত্ব দিলেও, ধর্মের প্রাণ রক্ষায় একক গুরুত্ব প্রদান করেছেন কেবলমাত্র ভিক্ষুদের উপরেই; ভিক্ষুণীদের উপরও নহে। ভিক্ষুরা এক পর্যায়ে অপরের প্রদত্ত অন্ন-বস্ত্র নির্ভর ভিখারী। কিন্তু আর এক পর্যায়ে দেহ ও মনজাত জাগতিক সর্ববিধ দুঃখ মুক্তির একক পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশ্বমানবের সামনে এক অতি উচ্চতম পথনির্দেশক ও গুরু স্থানীয়। তাই কোন ভিক্ষু উপসম্পদা গ্রহণ কালীন উচ্চারিত আটটি প্রতিজ্ঞায় অটুট্ থাকলে, পৃথিবীর যে কোন স্থানে, যে কোন অবস্থায় তাঁরা মানুষের শ্রদ্ধা-গৌরব লাভে সক্ষম এবং বুদ্ধের ধর্মাদর্শের প্রতিষ্ঠা দানেও সক্ষম। অতএব, রাজশক্তি বা রাজনির্ভরতার বস্তুতঃ কোন প্রয়োজনই নেই, বুদ্ধের মতাদর্শীদের জন্যে।
কিন্তু, বুদ্ধের সেই আদর্শ ধর্মসেনারা, পরবর্তী কালে সম্পূর্ণভাবে রাজানুগ্রহ নির্ভর হয়ে, তাঁদের স্তব-স’তি এবং তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী ধর্মের নামে শ্লোক রচনায় অতিউৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থানে অনেক বৌদ্ধরাজ্য যখন বৌদ্ধরাজা শুন্য হয়ে অবৌদ্ধ রাজার করতল গত হলো, তখন পূর্বের মতো আর সেই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাদের ভাগ্যে জুট্লো না। ফলে বিশাল বিশাল বৌদ্ধ সংঘারামে বিপুলসংখ্যক আবাসিকদের অবস্থান ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল ক্রমে ক্রমে।
৫. বিনয় মহাবর্গের ভৈষজ্য স্কন্ধে দেখা যায়, বুদ্ধ এভাবেই ভিক্ষুসংঘকে নির্দেশ দিচ্ছেন, “হে ভিক্ষুগণ! আমি বর্তমানে তোমাদের জন্যে যে সকল শিক্ষা উপদেশ নির্দেশ করছি, সে সমুদয়ের মধ্যে কোন কোন শিক্ষাপদ ভবিষ্যতে এমনও প্রতীয়মান হতে পারে যে, তৎদ্বারা কোন কল্যাণ, কোন মঙ্গল সাধিত হচ্ছে না। তখন সকল ভিক্ষু সংঘ শিক্ষাপদটি বর্জনে এক মত পোষণ করলে, তা বর্জন করতে পারবে। আবার, হে ভিক্ষুগণ! যখন দেখা যাবে যে, আমি এমন কোন শিক্ষাপদ নির্দেশ করিনি, যা ভবিষ্যতে মঙ্গল ও কল্যাণকর প্রতীয়মান হচ্ছে। তখন সকল ভিক্ষুসংঘ একমত পোষণ করলে তেমন শিক্ষাপদ সংঘ গ্রহণ করতে পারবে।”
মহাপরিনির্বাণ শয্যায় শায়িত হয়ে, তথাগত বুদ্ধ সেবক আনন্দকে লক্ষ্য করে বল্লেন, “হে আনন্দ! আমার অবর্তমানে আমার দেশিত ধর্ম-বিনয়ই তোমাদের বুদ্ধ এবং তোমাদের পরিচালক বলে জানবে। হে আনন্দ! ভবিষ্যতে সংঘ যদি মহত্ত্বর কল্যাণে ক্ষুদ্রানু-ক্ষুদ্র শিক্ষাপদ গুলোর কোন কোনটি পরিবর্তন করতে চায়, তা করতে পারবে।”
তথাগত বুদ্ধের এসকল নির্দেশের সম্যক্ মূল্যায়নে সক্ষম হলে বুদ্ধ পরবর্তী ভিক্ষু-সংঘের মধ্যে, এত দ্রুত, এত অসংখ্য দল-উপদল সৃষ্টির কোন সম্ভাবনাই ছিল না। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বুদ্ধের বিভাজ্যবাদ নীতি পরিত্যাগ করে ভিক্ষু প্রধানেরা যখনই একান্তবাদী নীতি গ্রহণ করেছেন; তখনই বৌদ্ধ সংঘে অসংখ্য নিকায় ও দল উপদলের সৃষ্টির বাতাবরণ হয়েছে। সংঘের একতা শক্তি এভাবে ধ্বংস হওয়াতে, বুদ্ধের সংঘে ধর্মবিজয় যাত্রাই শুধু স্থিমিত হয়ে পড়েনি, সংঘে স্বৈরচারী প্রবৃত্তিও মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পেয়েছে ভীষণ ভাবে। সংঘের একতায় এই বিপর্যয়ই ভারতে বৌদ্ধ সমাজ অবলুপ্তির অন্যতম কারণ।
বর্তমান বিশ্বে বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের বিপদ ও বিপদ মুক্তি :
ইতিহাসের এই নির্মম শিক্ষার আলোকে ইদানিং কালের বিশ্ব বৌদ্ধ সমাজ সম্পর্কে এখন কিছু আলোচনা করা যাক। বর্তমান বিশ্বের যে সকল দেশে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে পেরেছেন; আর অপরদিকে যে সকল দেশে বৌদ্ধরা সংখ্যলঘুর অভিশাপ মাথায় নিয়ে আপন অস্থিত্বের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন; এই উভয়ের বর্তমান বিপদ কি? এবং করণীয় কর্তব্য কি? এ প্রশ্নের উত্তরে নিম্নোক্ত বিষয় সমূহ তুলে ধরা হলো, আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে-
সংখ্যা গরিষ্ট বৌদ্ধ সমাজের বর্তমান বিপদ সমূহ :
বর্তমান বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ট বৌদ্ধ সমাজের অস্থিত্ব রয়েছে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যাণ্ড, শ্রীলংকা, বার্মা ও মঙ্গোলিয়ায়। এসকল দেশ সমূহের মধ্যে, জাপান অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সমৃদ্ধশালী দেশ। জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস হাজার বছরের মতো। বৌদ্ধ ধর্ম ভারত হতে উৎসারিত হয়ে চীন সম্রাজ্যকে প্লাবিত করে জাপানে গিয়ে পৌঁছুতে দেড় হাজার বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। এই দেড় হাজার বছরের ব্যবধানে একটি মতবাদকে নিশ্চিত ভাবে তার আদি স্বরূপে পত্তিয়া সম্ভব নহে। জাপানের বেলায় হয়েছেও তাই। বহু পরিবর্তিত পরিবর্ধিত বুদ্ধ মতকেই জাপান পেয়েছে। মহাযান শিল্প ভাষ্কর্যের অবদানে গড়া বুদ্ধ মূর্ত্তির প্রচলন যদি না হতো, তাহলে জাপানে কিছুকাল আগে প্রচলিত বুদ্ধমতকে চিহ্নিত করা বেশ কষ্টকরই হতো। জাপানের হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতীত বাদ বাকী সকল ভিক্ষুই বিবাহিত এবং প্রতিটি বিহার তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উৎকর্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে, জাপানের অর্থনীতি যে ভাবে সমৃদ্ধি পেয়েছে; সে তুলনায় বৌদ্ধধর্মের ভাগ্য সেখানে তেমন প্রসন্ন না হলেও জাপানী অনুসন্ধিৎসার দৌলতে বর্তমান বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে এযাবত যত অনুসন্ধান ও গবেষণা হয়ে গেছে, তার প্রায় সব কিছু জাপানী বৌদ্ধ তথ্যানুসন্ধানীরা স্বদেশের মাটিতে নিয়ে গেছেন। এতদ্সত্ত্বেও জাপানী মানসিকতায়, ধর্মের চেয়ে জাতিবাদের প্রাধান্যতা খুব বেশী। তাই জাপানের বৌদ্ধরা বৌদ্ধিক চেতনায় সত্যিকারের কোন আদর্শ সমাজ গঠনে প্রায় অক্ষম বলা চলে। নিজেদের সুপ্রাচীন ধর্মাদর্শের প্রতি জাপানী-প্রেমের এই দুর্বলতার সুযোগকে সমপ্রসারণবাদী খৃষ্টান মিশনারীগুলো সুকৌশলে কাজে লাগাতে এখন বেশ যে তৎপর, তা আমি দেখেছি। তাঁরা জাপানী উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণীকে সবিশেষ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে নানা প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণীয় উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে; দেশে বিদেশে খৃস্টীয় সাংস্কৃতিক আকষর্ণীয় উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদানের ব্যবস্থা করে এবং দেশে বিদেশে সমাজ সেবা ও মানব সেবামূলক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করানোর মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী খৃষ্টান মিশনারী নেটওয়ার্কের এই ব্যাপক তৎপরতার মুখে, জাপানী বৌদ্ধ ধর্ম গুরুরা নিজেদের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ কোন উদ্যোগ কার্যকরী ভাবে গ্রহণ করতে পারছেন বলে মনে হলো না। জাপানী বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের হতাশ মনের এক দীর্ঘশ্বাস আমি শুনতে পেয়েছি ১৯৯৩ খৃষ্টাব্দে আমার জাপান ভ্রমণ কালে। সেই ভিক্ষু মহোদয় বল্লেন, জাপানী সমাজে আমাদের প্রয়োজন শুধু মৃতদের জন্যেই; জীবিতদের প্রতি আমাদের করণীয় বলতে কিছুই নেই। দেখুন না, জাপানী শিশু ভূমিষ্ট হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিন্টো মন্দিরে, জাপানী যুবক-যুবতীর বিবাহ অনুষ্ঠান হয় খৃষ্টান গীর্জায়, আর তারা মৃতশয্যায় শায়িত হলে, তখনই আসে আমাদের কাছে মরদেহ সৎকারের জন্যে। এছাড়া অন্য কোন ধর্মীয় সম্পর্ক জাপানীদের সাথে আমাদের নেই। পাঠক! জাপানী বৌদ্ধ ভিক্ষুর এই একটি মাত্র উক্তিতেই বুঝে নিতে কষ্ট হবে না, জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের বর্তমান বাস্তব অবস্থা; এখন কোন্ পর্যায়ে আছে।
জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের এই অচলায়তনের মূল কারণ হলো, জাপানে যারা বিবাহিত হয়ে যুুগযুগ ধরে নিজেদেরকে ভিক্ষু বলে বিশ্বাস করে চলেছেন; তাদের এই ভ্রান্ত দৃষ্টি-ভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা। তারা যদি বলেন, আমরা মূল বৌদ্ধ ধর্মের থেরবাদী দর্শন অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম বাদকে গ্রহণ করে, বিশ্বে আমাদের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিকে হারাতে রাজি নই। তাহলেও আপত্তি নেই। কিন্তু জাপানে বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হলো প্রব্রজ্যার মূল্য আদর্শ হতে বিচ্যুতি। বুদ্ধ তথাগত “সম্বাধো ঘর বাসো, অব্ভকাসো পব্বজ্জা”-এই উপমা দিয়ে প্রব্রজ্যা জীবনের যেই মৌলিক দিকটিকে নির্দেশ করেছেন, জাপানী বর্তমান ভিক্ষু দাবীদারগণ বিবাহিত জীবনকে বরণ করে নিয়ে, সেই মৌলিক আদর্শ এবং তার শক্তি হতে বহু দূরে সরে গেছেন। বর্তমান জাপানী ভিক্ষুরা সংঘ বা নিকায়ের ঐক্যতার দাবী যতই করুন না কেন, আর্থিক শক্তিমত্তা যতই প্রদর্শন করুনা কেন, পারিবারিক পিছুটান মুক্ত চিত্ত শক্তির অধিকারী, তাঁরা বর্তমান জীবনাচারে কিছুতে অর্জন করতে পারবেন না। সহজ কথায় জাপানী ভিক্ষুদের বর্তমানে ধর্ম-সেবা বলতে বালি চরের খুঁটিতে আবদ্ধ নৌকার বৈঠা টানা তুল্য। যেখানে আছেন সেখান থেকে এক কদমও অগ্রসর হতে পারবেন না। এই সত্যটি উপলব্ধি করে, জাপানী বৌদ্ধ সংঘকে মৌলিক বুদ্ধ শিক্ষা ও আদর্শের আলোকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্রহ্মচারী জীবন রীতি প্রবর্তন অবশ্যই করতে হবে। আর তাহলো, জাপানী নারী-পুরুষের সম্মিলিত একটি অনাগারিক অনাগারিকা সংঘের জন্ম দেয়া। জাপানের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সন্তান জন্ম দান এবং সাংসারিক বন্ধনের ঝামেলায় না জড়ানোর একটি পশ্চিমী যান্ত্রিক মানসিকতা দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে বলে শুনা যায়। এই মানসিকতায় নারী-পুরুষ কামসেবা করবে, অথচ সন্তান নেবে না। এমন প্রবৃত্তি তখনই অনৈতিক এবং মহা অপরাধের সামিল হবে, যদি তা জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্য, প্রণোদিত অনুপ্রাণিত না হয়। অর্থাৎ আমি অল্প শ্রমের বিনিময়ে মদ, জুয়া, কামাচারেই নিজেকে অবাধে সমর্পিত করবো কিন্তু স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের কোন দায়-দায়িত্ব নেবো না। এমন হীন উদ্দেশ্যে এই অনীহা প্রবৃত্তি পরিচালিত না হয়ে, আমি নিজের স্বজাতি ও বিশ্বমানব সমাজের কল্যাণে আমার জীবনকে উৎসর্গীত করতেই স্বামী-স্ত্রীর জীবনে সন্তান কামনা করছি না। রূপ মহৎ সংকল্পেই পরিচালিত করতে হবে জাপানী তরুন সমাজের এই অনীহা প্রবৃত্তিকে। তখন তারা আগারিক তথা সাধারণ জনজীবনের আওতাভুক্ত হয়েও মহাত্যাগময় বৌদ্ধিক চেতনা সমৃদ্ধ অনাগারিক অনাগারিকা জীবনের মহাশক্তিকে ধারণ করতে পারবে অতি সহজে। এই অনাগারিক অনাগারিকা সংঘের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হলে, বুদ্ধ প্রণীত এই ছয়টি সংযমশীল অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে, তাদেরকে; যথা-
১. আপন মনে অন্যকে ঘৃণা, প্রতিশোধ স্পৃহা, হত্যা, আঘাত বা যে কোন কারণে দুঃখ দানের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ বর্জনের অভ্যাস গঠন করতে হবে।
২. পর দ্রব্যের প্রতি লোভ, অন্যায় ভাবে ধন উপার্জন বা আত্মসাতের স্পৃহা সম্পূর্ণভাবে বর্জনের অভ্যাস গঠন করতে হবে।
৩. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে কামসেবন প্রবৃত্তি সম্পূর্ণ ভাবে বর্জনের অভ্যাস গঠন করতে হবে।
৪. জীবনান্তেও মিথ্যা বলা, শঠতা বা প্রতারণামূলক আচরণ করার ইচ্ছা ত্যাগের অভ্যাস গঠন করতে হবে।
৫. জীবন ধারণের নূন্যতম প্রয়োজনে যেই আহার, পানীয় ও ঔষধ জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার প্রয়োজন; তার বাইরে অন্য কোন আহার পানীয় বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের ইচ্ছা সম্পূর্ণ ভাবে বর্জনের সাধনা করতে হবে।
৬. প্রমত্ততা উৎপাদক নাচ, গান, বাদ্যের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ ত্যাগ করে, দেহ মনে পবিত্র প্রশান্তি উৎপাদক গান ও ধ্যান ভাবনায় আপন চিত্তকে জ্ঞানমূলক পথে পরিচালনার শক্তি অর্জনের সাধনা করতে হবে।
কেবল জাপানী বৌদ্ধ সমাজ জীবনে নহে, বিশ্বের সকল বৌদ্ধ সমাজে এমন একটি আদর্শ জীবন ধারা প্রবর্তন সম্ভব হলে, এই মহতো মহান জীবনের মাধ্যমে শুধু স্বসমাজকে নহে, সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে একটি সংঘবদ্ধ বৌদ্ধিক প্রয়াস। থেরবাদ মহাযান নির্বিশেষে বৌদ্ধ সমাজ জীবনে বুদ্ধ প্রণীত অনাগারিক অনাগারিকা জীবনের এই মডেল, কেবলমাত্র বৌদ্ধ সমাজে নহে, বর্তমান বিশ্বের শান্তিকামী সকল সমাজে বিহার আশ্রয়ী জীবনের বাইরে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চীন সাম্রাজ্য হতে বৌদ্ধ ধর্ম কোরিয়ার উপর দিয়েই জাপানে প্রবেশ করেছে বলে ঐতিহাসিক রেকর্ড আছে। বর্তমানে সেই কোরিয়া দেখলাম বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির অনুশীলনে জাপানীদের চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ানরা উন্নত। কোরিয়ান বৌদ্ধ সমাজে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা এখনো ব্রহ্মচর্য-জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু, তাঁরা লোকালয় হতে দূরে অবস্থিত বিহারাশ্রয়ী জীবনের কর্মকাণ্ডেই নিজেদেরকে সবিশেষ ব্যস্ত রাখেন। জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক হয় বিহারের প্রয়োজনে এবং উৎসব অনুষ্ঠানাদি উপলক্ষে। মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের কর্মকাণ্ডে ধর্মপ্রেম জাগ্রত রাখা যায়, এমন কোন কার্যক্রম কোরিয়ান বৌদ্ধ সমাজে চালু আছে কি-না আমার জানা নেই। অধিকন’, বর্তমান বিশ্বে ধর্মভিত্তিক সমাজ গঠনে খৃস্টান ও ইসলামী মিশনারদের তৎপরতা; ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক শক্তি ধর্মের প্রচার শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ অথনৈতিক মানব সেবামূলক কর্মসূচির সমপ্রসারণ, শুধু কোরিয়ায় নহে পৃথিবীর যে কোন দেশের বৌদ্ধ সমাজকে তার অস্থিত্ব রক্ষায় এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এ সকল মিশনারীরা। অথচ বিশ্ব বৌদ্ধ সমাজে তা ভীষণভাবে দুর্বল-এমনকি উপেক্ষিতও বটে। কোরিয়ান সমাজে বৌদ্ধ সমাজের এসকল দূর্বলতার সুযোগে, সেখানকার খৃষ্টান মিশনারীগুলো নগর-পল্লীর অলিতে গলিতে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য মিশনারী স্কুল, হাসপাতাল ও গীর্জা। জনজীবনের এসকল জরুরী প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমে তঁাঁরা ব্যাপকভাবে খৃষ্টীয় প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছেন-যা আমি স্বচক্ষেই দেখে এসেছি ১৯৯২ খৃস্টাব্দে আমার কোরিয়া ভ্রমণ কালে। ফলে মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে বৌদ্ধ প্রধান দক্ষিণ কোরিয়া, বর্তমানে খৃষ্টান প্রধান দেশে পরিণত হয়ে গেল!
এবারে তাইওয়ান সহ বিশাল চীন, যারা বিশ্বের সমগ্রলোক সংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ, সেই চীনা জাতির কথাই বলি। এককালে চীনা জাতি বলতে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীই বুঝাতো। অর্থাৎ চীনা জাতির একশোভাগ সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। চীনের আদি ধর্মনীতি বা সামাজিক বিশ্বাস নামক কনফুসিয়াস মতবাদ বুদ্ধের পঞ্চশীল আদর্শের সাথে একাকার হয়ে চীনা জনগণের লোকচারে এক সময় হাজার বছর ধরে নবতর উদ্দীপনার জন্ম দিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বিশাল চীনা বৌদ্ধ সমাজে ইতিহাস খ্যাত চীনা পরিব্রাজক ফাহিয়ান, হিউয়েন সাং এর ন্যায় অসংখ্য চীনা জ্ঞান-বিজ্ঞান পিপাসুদের মাধ্যমে ক্রমে প্রবেশ করতে থাকে, বৌদ্ধ ভারতের অন্তিম লগ্নের বিষাক্ত, পচাঁ দূর্গন্ধ, ঘৃণিত তান্ত্রিক ও সহজিয়া মহাযানী মতাদর্শ সমূহ। বহু শতকের আচরিত ও অভ্যস্ত বুদ্ধের মৌলিক দর্শন ভিত্তিক সমাজ জীবনটি যুগে যুগে তার অনিবার্য পরিবর্তনের মূল্যায়নের দাবীতে তার জন্মগত ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে, এক এক সময়ে কিছু না কিছু সংযোজন-বিয়োজন অবশ্যই করতে হয়; অসাধারণ দূরদৃষ্টির মাধ্যমে। ‘ভাঙবো তবু মচ্কাবো না’ এই একান্তবাদী প্রবাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে গিয়েই, মহান বুদ্ধের পরিনির্বাণের মাত্র তিন মাসের মাথায় বুদ্ধের সংঘে ভিন্নমত মাথাচাড়া দিতে দেখা যায়। আর সেই একান্তবাদীতার সুযোগ, বিকৃত রুচিবানেরা একবার পেলেই হলো; তাদের অবাধ রুচির সহস্র বাহু বিস্তারে তারা বিন্দুমাত্রও কাল বিলম্ব করে না। ভাগ্যিস্ সম্রাট অশোক সময়ের মোগ্গলিপুত্ত তিষ্য স্থবিরের ন্যায় সংঘের কিছু মহান ব্যক্তিত্বকে পরবর্তী কালে বেশ দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে। তাঁদের সেই মহান অবদানেই বুদ্ধের দর্শন ও শিক্ষা ভারতের বুকে না হলেও বর্হিবিশ্বে বহু চড়াই-উত্রাই বেয়ে, বহু উত্থান-পতনের আঘাত খেয়ে খেয়ে আড়াইটি হাজার বছর অতিক্রম এসেছে এ বিশ্বের বুকে।
চীনা জন সমাজে বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের প্রলম্বিত ইতিহাসের গতিও ছিল ঠিক ভারতেরই মতো। মহাযান মতবাদ ভারত থেকে খৃস্টীয় প্রথম শতকে তার স্বর্ণ-যুগেই মহাচীনের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়েছিল। ইহা ছিল চীনা জনগণের জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ। অবাধ পরিবর্তনের প্রশ্রয়বাদী মহাযানের অভিশাপে তান্ত্রিক-সহজিয়া মতাদর্শটি বাংলা বিহার উড়িষ্যা ও মধ্য প্রদেশের মাটি থেকে উৎসারিত হয়ে খৃস্টীয় ৭ম, ৮ম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত অভিশাপ হয়ে প্রবেশ করে মহাচীনের মর্ম মূলে। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের এই দুর্বল মুহূর্তে ব্রাহ্মণ্যবাদের খক্ষ এবং ইসলামের তরবারীর ক্রমাগত ঝড়ো হাওয়া একাদশ, দ্বাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ দূর্বল প্রদীপটিকে ভারতে যেভাবে সহজে নিভিয়ে দিল; মহাচীনে বৌদ্ধ মতের পৃষ্ঠপোষক প্রবল প্রতাপী চীনা সম্রাটের বংশধরগণের একক আধিপত্যের কারণে চীনা-সমাজের বৌদ্ধ ধর্ম সে সময়ে গুণগতমানে মূলে দুর্বল হলেও টিকে থাকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত। গাঁজা, মদ, ভাঙ-এই তিন মরণাস্ত্রের নেশায় ডুবে থাকা চীনা বৌদ্ধ সমাজের লৌহ কবাট ভাঙলো, ঘোর বস্তুতান্ত্রিক কমিউনিষ্ট মতবাদ, চীনের শাসন ভার গ্রহণের মধ্য দিয়ে। নতুন চীনের এই অভ্যুদয় প্রকৃত বুদ্ধ মতবাদের জন্যে কখনো কাল হয়ে দাঁড়াতো না। যদি চীনের মাটিতে বুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ প্রাণবন্ত থাকতো এমনকি কমিউনিষ্ট মতাদর্শ চীনা জনগণের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতো না বৌদ্ধ আদর্শ সাম্যবাদের প্রভাবে। কিন্তু, বুদ্ধের নামে অবুদ্ধের আচারে নিমজ্জিত চীনা ধর্মগুরুদের সহায়তায় চীন সম্রাটের বংশধর ও তাঁদের প্রশাসন, চীনের সাধারণ মানুষের রক্তমাংস যেভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছিল; তার পরিণতিতে দিশেহারা চীনাজনগণ ঘোর বস্তুতান্ত্রিক বিদ্বেষের উদ্গাতা কমিউনিজমকেই আশীর্বাদ স্বরূপ গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল।
তাই চীনা কমিউনিজমের ঘোর শত্রু হয়ে পড়েছিল চীনের প্রতিটি বৌদ্ধ-মঠ। সে সকল মঠে সুরক্ষিত ছিল হাজার হাজার বছরের মহাচীন ও ভারতের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্ম-দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল বিশাল পাঠাগার। আধুনিক চীনের মহান নেতা মাও সেতুং এর ক্রোধের আগুনে সেই জ্ঞান সমৃদ্ধ হাজার হাজার পাঠাগার গুলোতে বিশাল বহ্নি উৎসব উদ্যাপিত হলো; সাংস্কৃতিক বিল্পবের নামে। এদিক দিয়ে মাও সেতুং নামক চীনের এই ভাগ্যবিধাতা, তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা ধ্বংসকারী মুসলিম সেনাপতি মুহম্মদ ঘোরী, বিন বক্তিয়ার খিল্জী সবাইকে অতিক্রম করে গেলেন। তাই মহাচীনে বৌদ্ধ ধর্মকে এখন মিউজিয়ামে দেখেছি, ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে চীন ও মঙ্গোলিয়া ভ্রমণ কালে।
তাইওয়ান, হংকং, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সংখ্যালঘু হিসেবে অবস্থানকারী বৌদ্ধ জনতা, বৌদ্ধ ধর্মকে কি ভাবে ধরে রেখেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল হলেও বলা যায়, বৌদ্ধ কর্মবাদের মানবিক দিকটির পৃষ্ঠপোষক মহাযান মতবাদের প্রতি হাজার বছরের ঐতিহ্যের প্রতি মৃয়মান অনুরাগের গুণে, তাঁরা স্ব স্ব অবস্থানে অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতায় অন্যান্য সমপ্রদায় হতে বেশ এগিয়ে আছে। কিন্তু, সংখ্যালঘুর অভিশাপে তারাও কম ভোগান্তির শিকার নহেন। যেমন, মালয়েশিয়ায় এই চীনা বৌদ্ধরা পেনাং শহরে একটি উঁচু চুড়া বিশিষ্ট বিহার নির্মাণ করতে গিয়ে, স্থানীয় মসজিদের মিনারের চুড়ার উচ্চতাকে অতিক্রম করায়, বিহার মন্দিরের চুড়া ভেঙ্গে দিতে হলো। এ জাতীয় অনেক দমন নীতি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ও আরোপিত হয়েছে সরকার কর্তৃক। ১৯৯০ এ আমার মালয়েশিয়া ভ্রমণকালে স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষ করে এসেছি।১৯৮২ থেকে ৮৫ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত শ্রীলংকায় মহরাগমা ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টারে আমার অবস্থান কালে সুপাত্তো নামে চীনা বংশোদভুত এক ইন্দোনেশিয়ান যুবকও সেখানে ছিলেন। তারই মুখে সেখানকার বৌদ্ধদের একই দুর্দ্দশার কথা শুনেছি। তবে ইসলামের তুলনায় বহু গুণে সহনশীল খৃস্টীয় মতবাদের কারণে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং এর বৌদ্ধদেরকে অনেক সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে দেখেছি, ১৯৯৪ সালে এ সকল দেশ ভ্রমণকালে।
বলতে গেলে বর্তমান বিশ্বে ভীষণ ভাবে মৃয়মান থেরোবাদী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর তুলনায়, মহাযানের কর্মতৎপরতা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী বহু গুণে তেজোদ্দীপ্ত; অতি সামান্যতম বুদ্ধ শিক্ষার যথার্থ ব্যবহার করতে পেরে। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী খৃস্টান ও ইসলামী মিশনারী নেট্ওয়ার্কের সামনে বুদ্ধ প্রেমে দুর্বল এই বিত্তশালীদের দ্বারা বুদ্ধবাণীর প্রচার প্রসারে যা হচ্ছে তা দিবালোকে প্রদীপ শিখার ন্যায় বড়ই করুণ।
থেরোবাদ অধ্যুষিত বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু-লঘুরা কেমন আছেন? থেরোবাদী বৌদ্ধ সংখ্যাগুরুদের অবস্থা :
পূর্বেই বলেছি ভারত থেকে উৎসারিত মহাযানী আচার সংস্কার প্রথম প্রতাপে এক সময় বর্তমান থেরোবাদী রাষ্ট্র শ্রীলংকা, মায়ানমা, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়াকেও ব্যাপকভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। নানা দেবদেবীর মূর্ত্তি পূজা এবং তন্ত্র-মন্ত্র, গণা-পড়া ইত্যাদি জনপ্রিয়তা তাই এখানো পর্যন্ত পুরোদমে বিদ্যমান আছে এসব দেশের বৌদ্ধ সমাজে। শ্রীলংকায় আমার অবস্থান কালে তথাকার প্রথম পুণ্যতীর্থ অনুরাধাপুরে এক প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নসত্মূপে পাওয়া গিয়েছিল বহু স্বর্ণপাতে উৎকীর্ণ মহাযানে প্রধানগ্রন্থ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’র সম্পূর্ণ অংশ। এসবের পরেও থেরোবাদী বৌদ্ধ রাষ্ট্র সমূহের বৌদ্ধ জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ও সামাজিক বর্তমান অবস্থা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
শ্রীলংকা : সেই শৈশব থেকেই শুনে আস্ছিলাম শ্রীলংকার কথা। আমার জন্মস্থান জোবরা সুগত বিহারের অধ্যক্ষ প্রয়াতঃ উপসংঘরাজ গুণালংকার মহাস্থবির ছিলেন সেই দক্ষিণ শ্রীলংকার পানাদুরা শহরের বিখ্যাত বিদ্যোদয় পিরিবেনে শিক্ষা লাভ করা একজন কীর্ত্তিমান বাঙালী বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিনি আমার পিতামহ মৃত্যুঞ্জয় বড়ুয়ার ছোট ভাই, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে পালি শিক্ষায় প্রথম বিনয় বিশারদ উপাধি-প্রাপ্ত ভিক্ষু মুণিন্দ্র প্রিয়ের একমাত্র শ্রমণ শিষ্য। পরবর্তীতে চতুর্থ সংঘরাজ বরজ্ঞান মহাস্থবিরের নিকটে উপসম্পদা গ্রহণ করে তিনি ভদন্ত গুণালংকার ভিক্ষু নামে ধর্ম-বিনয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে শ্রীলংকার এই পানাদুরা বিদ্যোদয় পিরিবেনে গমন করেন। এদেশের বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজে তখন সদ্ধর্মের পুণরুত্থানে প্রবর্ত্তিত, ১৮৬৪ খৃস্টাব্দের সমাজ-ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার চল্ছিল। বিনয়াচার্য বংশদীপ, আর্যপুরুষ জ্ঞানীশ্বর, অগ্রমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরদের সতীর্থ ছিলেন এই গুণালংকার মহাস্থবির। তাঁরা শ্রীলংকা থেকে শিক্ষা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে নিবেদিত হয়েছিলেন। তাঁদেরই অক্লান্ত প্রয়াসে এদেশে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের প্রথা প্রবর্ত্তিত হয়। এই গুণালংকার মহাস্থবিরকে দেখেছি, তিনি জন্ম-জাত গ্রাম জোবরা সুগত বিহারে অবস্থান করে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ নোয়াখালী, কুমিল্লা পর্যন্ত অত্যন্ত সার্থকভাবে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের গতিবেগ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সেই সাফল্যে অত্র বিসত্মীর্ণ অঞ্চলের বৌদ্ধ সমাজ থেকে শনিপূজা, লক্ষীপূজা, কার্ত্তিক পূজা, স্বরস্বতী পূজা-ইত্যাদি অনেক অনেক হিন্দু আচার, প্রায় অপঃসৃত হয়ে গিয়েছিল। তিনি লক্ষী পূজার পরিবর্তে শ্রীলংকার পদ্ধতিতে বুদ্ধ পূজা ও অষ্টশীলাদি উপোসথ ব্রতের প্রচলন করেছিলেন এবং কার্ত্তিক পূজার পরিবর্তে বুদ্ধভাত নামে পান্থা ভাত-রান্নার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেখা গেছে, যারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করতো, তাদেরকে দণ্ড স্বরূপ বিহারে বালুটানা এবং বোধিবৃক্ষের গোড়ায়জল ঢালার দণ্ড দিতেন। এই মহাজীবনের আকর্ষণেই বুদ্ধশাসনে জন্ম-নিয়েছিলেন আলীশ্বরের বিনয়ধর পূর্ণানন্দ মহাস্থবির, জ্যোতিঃপাল মহাস্থবির , ত্রিপুরার ডক্টর বুদ্ধদত্ত স্থবির, উপ-সংঘরাজ ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির, বিদর্শনাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাস্থবির প্রমূখ অনেক গুণী শিষ্য। উল্লেখ্য যে, চার শতাধিক গুণী শিষ্যের জনক সাধক কূলতিলক আর্যপুরুষ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয়ের উপধ্যায় তথা উপসম্পদা গুরুও ছিলেন এই গুণালংকার মহাস্থবির।
শ্রীলংকার কথা বলতে গিয়ে কেন গুণালংকারের এতো কথা এলো? কারণ, সেই গুণালংকার এদেশের হিন্দু আচারে সংস্কারে নিমজ্জিত বৌদ্ধদের দৈনন্দিন ধর্মীয় জীবনে বৌদ্ধোচিত যেই পরিবর্তন আনায়ন করেছিলেন তা শুধু সম্ভব হয়েছিল তাঁর শ্রীলংকান শিক্ষাগুরুদের আদর্শ জীবনাচার, চিন্তন ও মননকে আপন জীবনে গভীর আন্তরিকতায় ধারণের ফলেই। ভদন্ত গুণালংকার এদঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষু গৃহীকুলের নিকট ছিলেন সত্যিকারের এক আদর্শ শিক্ষা গুরু। তাঁর পূঁত জীবনের প্রত্যক্ষ পরশ ধন্য হওয়ার ভাগ্য, আমার জীবনে হয়েছিল অতি সামান্য। তবুও জোবরা সুগত বিহারে তাঁরই সুসজ্জিত শ্রীলংকান অক্ষরের পবিত্র ত্রিপিটকের গ্রন্থাগার এবং বিরাট ধর্মশালায় সুসজ্জিত শ্রীলংকা থেকে আনায়ন করা উইলিয়াম ফেড্রিক্্র এর আঁকা বুদ্ধের সমগ্রজীবন ভিত্তিক চিত্তাকর্ষক বিশাল বিশাল ছবিগুলো সেই শ্রীলংকার প্রতি দূর্ণিবার এক আকর্ষণের জন্ম দিয়েছিল আমার মনে সেই শৈশবে। কৈশোর থেকে যখন যৌবনে পদার্পন করলাম তখন এগুলো সবকিছুই এক সময় মনের পর্দা থেকে মুছে গিয়েছিল। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ আমার জীবনে এনে দিল প্রব্রজ্যা। সেই প্রব্রজ্যাই আমার জীবনে যেন অনিবার্য করে দিল শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আমার শ্রামণ্য শিক্ষা গুরু এবং ভিক্ষুত্বের দীক্ষাগুরু বিদর্শনাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো মহোদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় ১৯৮২ থেকে ৮৫ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত আমাকে শ্রীলংকায় পালি ভাষা ও ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়নের লক্ষ্যে অবস্থান করতে হয়েছিল। চার বছর কাল আমার শ্রীলংকার জীবনটি অতি কাছে থেকে শ্রীলংকার ইতিহাস ও তার চলমান পরিবেশ পরিস্থিতিকে গভীর ভাবে জানার ও বুঝার সুযোগ আমাকে এনে দিয়েছিল।
শ্রীলংকার ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু হয় খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহামতি সম্রাট অশোক তনয়-তনয়া থেরো মহিন্দ এবং থেরী সংঘমিত্রা-এ দুই জনের লংকার মাটিতে পদার্পন থেকে। তাঁরাই শ্রীলংকান জনজীবনে বুদ্ধ ধর্মের গোড়া পত্তনকারী। তবে এই দ্বীপরাষ্ট্র সিংহলের দ্বীপবংশ নামক সুপ্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থটি শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসকে আরো তিনশত বছর এগিয়ে নিয়ে বুদ্ধের পরিনির্বাণের ক্ষণটিকে মাইলফলকে পরিণত করেছে। এই দ্বীপবংশে বর্ণিত হয়েছে, জম্বুদ্বীপ নামক ভারতবর্ষে যে দিন বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভ হয়, সেদিনে সিংহলদ্বীপের মাটিতে বাঙ্গালী সন্তান, রাজকুমার বিজয় সিংহ সপরিষদ নৌযান হতে সিংহল দ্বীপের মাটিতে পা রাখেন। সেই বিজয় সিংহই ভারত মহাসারের বুকে এই ক্ষুদ্র ব-দ্বীপে সিংহলী জাতির জন্মদাতা। তাঁরই স্মৃতিতে দ্বীপটির নাম হয় সিংহল। বিজয় সিংহের মাতৃভূমির পরিচয় স্বরূপ সিংহলী মাতৃজাতির কর্ণে অতি আদরে ব্যবহৃত একটি অলংকারের নাম রাখা হয় ‘বাঙ্গালী বালালো’। বাঙ্গালী জাতীয় জীবনে বৌদ্ধধর্মের সূচনা কাল নির্ণয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যেই বিতর্ক, তার অবসান ঘটাতে পারে লংকাদ্বীপে সিংহলী জাতির অভ্যুদয়ের এই ঘটনাটি। বিজয় সিংহের সিংহল দ্বীপে আগমনের পূর্বেই ভগবান বুদ্ধ এই দ্বীপে এসে তথাকার সর্বোচ্চ পর্বত মালা সুমন-পর্বত শৃঙ্গে তাঁর পবিত্র পদচিহ্নটি অধিষ্ঠান স্বরূপ রেখে যান এই বলে, অনাগত কালে এই দ্বীপটিই হবে আমার প্রচারিত সদ্ধর্মের প্রকৃত সংরক্ষক।
দ্বীপ বংশ নামক গ্রন্থে ধারণকৃত ২৫৫০ বর্ষ পূর্বের এই উক্তি আশ্চর্যজনক ভাবে যে সত্যে পরিণত হয়েছিল, বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসই তার সাক্ষী।
অতীতে এই শ্রীলংকা একমাত্র প্রতিবেশী তামিলদের দ্বারা বহুবার আক্রান্ত ও পর্যূদস’ যে হয়েছিল, তার ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন শ্রীলংকার যত্রতত্র এখনো বিদ্যমান। মহানবুদ্ধ ও থেরো মাহিন্দ এবং থেরী সংঘমিত্রার শিক্ষা, তাঁদেরকে এই নিকট প্রতিবেশীর প্রবল আঘাত থেকে বার বার রক্ষা করে এসেছে। এই তামিলদের সৃষ্ট বর্তমান ধ্বংসযজ্ঞের অবসান যে একদিন হবেই হবে, শান্তিপ্রিয় অহিংসাবাদী সিংহলীদের মনে সে বিশ্বাস এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তবুও বুদ্ধ শিক্ষার কিছু অপঃপ্রয়োগ সিংহলী জাতির বর্তমান দুঃখ-দুর্দ্দশা সমূহের কারণ বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। যেমন সিংহলী বৌদ্ধ শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সকলেই উদাস উদাস ভাব এবং অতি অল্পে সন্তুষ্ট থাকেন। তাদের পোষাক পরিচ্ছদ খুবই সাদাসিধে, গায়ে অলংকার বলতে কিছুই থাকেনা। খাদ্য উপকরণ তো লতাপাতা সর্বস্ব বল্লেই চলে। হাতে গোণা কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তিছাড়া, বাদ বাকী সকলেই অবস্থান করেন, থেরো মাহিন্দা প্রদত্ত নক্সা অনুযায়ী অতি অনাড়ম্বর বসত বাড়ীতে। তবে কি ধনী, কি দরিদ্র সকলের বসতবাড়ী অতিশয় পরিচ্ছন্ন, যেন এক একটি পুষ্প উদ্যান। বলছিলাম সিংহলী জাতির এই উদাস ভাব এবং অল্পে তুষ্ঠি মনোবৃত্তির জন্ম দাতা হচ্ছে; পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, বিহার-পিরিবেণ সহ যাবতীয় ধর্মানুষ্ঠানে ভিক্ষুদের কণ্ঠে, চব্বিশটি ঘন্টার নিন্দ্রা ব্যতীত অবশিষ্ট সময়ে যা শোনা যায়, সবই সংসার বিমুখী অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মবাদী ধর্মদেশনা। কর্মোদ্যাগে, কর্মপ্রেরণা দায়ক কথাবার্তা যা শোনা যায় তাও যেন অত্যন্ত প্রাণহীন, শুধু কথার কথা মাত্র। ধর্মগুরুদের স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞানহীন এসকল ধর্ম দেশনার প্রভাব সিংহলী বৌদ্ধদেরকে ‘না ঘরকা, না বাহির কা’ ঠিক এমন একটি দোলায়মান মানসিকতার জন্ম দিয়ে চলেছে বহুযুগ ধরে। ফলে তারা গৃহী হয়েও প্রায় বিরাগ প্রবণ মানসিকতার অধিকারী। এই মানসিকতা তাঁদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো সৃজনশীল, ঝুঁকিপূর্ণ, দিনে-রাতে উৎকণ্ঠিত থাকার জীবিকায়, মোটেই অনুপ্রাণিত করে না। তাই ঝুঁকি হীন, চিন্তামুক্ত, কেবল চাকুরী ও কৃষ্টি জীবিকার প্রতিই তাঁদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশী। ফলে শ্রীলংকার বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তারা সংখ্যা লঘু ব্যবসায়ী জাতি মুসলিম, তামিল ও খৃস্টানদের অধীনে চাকুরী করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তি তাই সংখ্যাগুরু দরিদ্র সিংহলী বৌদ্ধদের হাতে নহে, সংখ্যালঘু হিন্দু তামিল, মুসলিম ও খৃস্টানদেরই হাতে। আধুনিক গণতন্ত্র সিংহলীদেরকে রাজদণ্ড হাতে পাওয়ার সুযোগ এখনো দিচ্ছে; কিন্তু আধুনিক বেনিয়া অর্থনীতিই তো রাষ্ট্র-যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর সে কারণেই অর্থ-বিত্তে, ব্যবসা-বাণিজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী তামিলরা আজকে আকাঙ্খা করছে শ্রীলংকার বুকে সিংহলী প্রভাব মুক্ত স্বাধীন ভূমি। অপরদিকে শ্রীলংকার মুসলিমেরা উদগ্রীব হয়ে আছে, আগামী কাল তাঁদের জন্যেও পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হওয়ার।
বুদ্ধ শিক্ষার অপপ্রয়োগই সিংহলী সংখ্যা-গরিষ্ঠ বৌদ্ধ জন গোষ্ঠীর বর্তমান দুঃখ-দুর্দ্দশার মূল কারণ কি না; প্রিয় পাঠক! তা এখন আরো একবার চিন্তা করতে অনুরোধ জানাই। একই দৃশ্য আমি স্বচক্ষের প্রত্যক্ষ করলাম থেরোবাদী বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশ থাইল্যাণ্ড ও মায়ানমার রাষ্ট্রে বৌদ্ধ জনমানসে।
বৃটিশ শাসনামলে সিলোনে ভারতের তামিলনাড়- থেকে চা-বাগানের কুলি রূপে আশ্রয় নেয়া হিন্দু, মুসলিম ও খৃস্টানরা ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন সে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০% ভাগ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সংখ্যা লঘুদের সংখ্যা ইদানিং আরো দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে বিগত দুইদশকের মধ্যে। তার কারণ হিন্দু ও খৃস্টান তামিলদের সাথে শ্রীলংকার চলমান যুদ্ধে বহু শ্রীলংকান বৌদ্ধ যুবক প্রাণ দিয়েছে, তাঁদের অথনৈতিক দুর্বলতা ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দরিদ্র সিংহলী বৌদ্ধদের বহু সুন্দরী কন্যা ধনাঢ্য মুসলিম তামিলদের সাথে বিবাহ সুত্রে আবদ্ধ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। অনেক দরিদ্র, অনেক সিংহলী চাকুরী, চিকিৎসা ও শিক্ষা সহায়তা লাভের মাধ্যমে সপরিবারে খৃস্টান ধর্মের আশ্রয় নিচ্ছে। এসকল কারণ সমূহের সাথে যোগ হয়েছে ধর্মীয় প্রথাগত প্রব্রজ্যা সিংহলী বৌদ্ধদের সংখ্যা অতি দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে। নারী-পুরুষের মধ্যে ব্রহ্মচর্য প্রথাটি স্বাভাবিক নিয়মে জাতীয় জনসংখ্যার উর্ধগতি রোধ করে থাকে। বিপর্যয় মূলক কোন কারণ বৌদ্ধদেশে না থাকলেও চিরকুমার প্রব্রজ্যা প্রথা জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি কোনটাই না ঘটায়ে, সর্বদা একটি ভারসাম্য অবস্থা, স্বাভাবিক নিয়মেই যে বজায় রাখে। তার প্রমাণ মায়ান্মার, থাইল্যাণ্ড ও কম্বোডিয়া রাষ্ট্র সমূহে দীর্ঘকাল ধরে জনসংখ্যার স্থিতিশীল অবস্থাটি।
বুদ্ধের শিক্ষায় ধর্মের নামে সামপ্রদায়িকতা বা ধর্মীয় প্রেরণায় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের প্রথা অথবা ধর্মের প্রচার প্রসারে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার কোন বিষয় লক্ষ্য করা যায় না। তবুও বুদ্ধের শিক্ষায় সর্বজীবে মৈত্রী-করুণাময় অসামপ্রদায়িক মহনীয়তায় বিভিন্ন ধর্মীয় মতাবলম্বী দেশে বা বিভিন্ন জাতীয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দেশে, শান্তি ও সমপ্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে সম্্রাট ধর্মাশোকের রাষ্ট্রনীতি, পরবর্তী কালে সম্রাট কণিষ্ক, সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার পাল রাজাদের ন্যায় অনেকেই রাজকীয় অনুশাসনকে বুদ্ধ শিক্ষার অনুকুলেই প্রয়োগ করেছেন। এবং বুদ্ধ শিক্ষা উপদেশের প্রচার-প্রসারে এই রাজকীয় শক্তি যথেষ্ট সহায়তাদান করেছেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী প্রজারা সেই বৌদ্ধপ্রেমী রাজা, সম্রাটদের এই পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চয় ভালো চোখে কোন দিন দেখেননি। এটাই স্বাভাবিক। তাই সময় ও সুযোগে তারা বিদ্রোহ করেছেন এবং ক্ষমতা দখল করতে পারলে তাদের ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সামপ্রদায়িক রোষানলকে বৌদ্ধ কীর্ত্তি ধ্বংসের কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি বৌদ্ধগণ দমন-নিপীড়নের শিকার হয়ে ক্রমে নিশ্ছিন্ন হয়েছে ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। এতদ্সত্ত্বেও বিশ্ব বুকে সর্বজীবে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার আদর্শবাহী, বুদ্ধ শিক্ষা আড়াই হাজার বছর ধরে কোটি কোটি অসামপ্রদায়িক শান্তিপ্রিয় জনতার হৃদয়কে জয় করে করে এখনো টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও অবশ্যই থাকবে। আমার এই দৃঢ় বিশ্বাস অবশ্যই সত্য হবে, যদি বুদ্ধ অনুরাগীরা উপরোক্ত গুণাবলীকে প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শীতার সাথে স্থান-কাল-পাত্র উপযোগী করে ব্যবহার করতে সক্ষম হন।
মায়নমার : শ্রীলংকার বর্তমান দুঃখ-দুর্দ্দশার যেই চিত্র আমি এ পর্যন্ত দিলাম, ঠিক একই হুমকি বিরাজ করছে থেরোবাদী বৌদ্ধ প্রধান দেশ মায়ানমার এবং থাইল্যাণ্ডেও। আমি বিভিন্ন উপলক্ষে বহুবার থাইল্যাণ্ডে গেছি। কিন্তু মায়ানমারেতে যাওয়া হয়েছে মাত্র একবার, সেই ১৯৯৫ খৃস্টাব্দে প্রয়াত অষ্টম সংঘরাজ শীলালঙ্কার মহাস্থবিরের সাথে ১৮দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে। তবে, শৈশব থেকে আমার মা, বাবার মুখে প্রায় শুন্তাম, তাঁদের দীর্ঘকাল বার্মাদেশে অবস্থানের অভিজ্ঞতার কথা। আমার বিশ্বাস ছিল, ভারতীয় মহাজনী সুদের ব্যবসায়ী এবং বেনীয়া মাড়োয়ারী সহ প্রায় সব বিদেশীদের তাড়িয়ে দিয়ে মায়ানমার আর্মি-প্রশাসন নিশ্চয় সেদেশের শোষিত-দারিদ্রতা ক্লিষ্ট জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা যে কিছুই হয়নি, ১৯৯৫ এ আমার সে দেশটি ভ্রমণ কালে স্ব চক্ষেই তা প্রত্যক্ষ করলাম। লক্ষ লক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুখে দিবা-রাত্র, যত্র-তত্র অনিত্য, অনিত্য ধর্মদেশনা শুনতে শুনতে কর্ম-বিমূখী বর্মী নর-নারীরা কেমন্ জানি এক আশ্চর্য আরামপ্রিয়, পলায়নী মনোবৃত্তির শিকার হয়ে পড়েছে। পুরুষেরা দলে দলে প্রব্রজ্যা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিক্ষা সর্বস্ব পরজীবিতে পরিণত হওয়া; আর মহিলারা ভোগের লালসায় সুযোগ পেলেই ধনাঢ্য ভিন্নধর্মালম্বীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করাটা, যেন জাতীয় চরিত্রেরই অঙ্গ। সেনা প্রশাসন বহুবিধ আইন করেও এই প্রবণতা দূর করতে পেরেছেন, এমনটি মনে হয় না। সবচেয়ে বড়ো কথা, বর্মী জনগণের দারিদ্রতার অবসানে তাদেরকে কর্মঠ জাতিতে পরিণত করাটাই ছিল জরুরী। কিন্তু বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে টিকে থাকা মায়ানমার সেনা প্রশাসন সে দায়িত্বটি পালনে ব্যর্থ তো হলোই; অধিকন’ তারাও এখন অসম্ভব রকমের ঠক্বাজী ও দুর্নীতির পঙ্কিুল আবর্তে নিমজ্জিত। ফলে সেখানকার বৌদ্ধ জনগণ কেমন আছেন, তার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোধগম্য হতে মোটেই কষ্ট হবে না।
১৯৯৫ খৃস্টাব্দে আমাদের একটি সংস্থাকে মায়ানমার সরকার সে দেশে ১৮ দিনের সরকারী সফরের আমন্ত্রণ জানান। আমরা মহামান্য অষ্টম সংঘরাজ ভদন্ত শীলালঙ্কার মহাস্থবির সহ ২২ সদস্যের একটি দল যথাসময়ে মায়ানমার রাজধানী ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গিয়ে অবতরণ করলে, সে দেশের ধর্মমন্ত্রী সহ বহু উচ্চপদস’ সরকারী কর্মকর্তারা বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাদেরকে ৬ষ্ঠ সঙ্গায়ন অনুষ্ঠান স্থল, গাবায়ে সাসন হিতায় ইউনির্ভাসিটির অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সংঘরাজ ভন্তের সাথে আমিও হেমেন্দ্র বাবুকে একটি পৃথক ভবনে রেখে অবশিষ্ট সবাইকে অপর একটি ভবনে রাখা হয়। তাদের জন্যে ২জন মহিলা গাইড এবং আমাদের জন্যে সাসন হিতায় ইউনির্ভাসিটির রেকটর সহ একজন অফিসার স্থানীয় যুবককে সার্বক্ষণিক সেবক ও গাইড রূপে রাখা হয়। অতঃপর ইয়াঙ্গুনের সোয়েডাগণ প্যাগোডা, চূলে প্যাগোডা, কয়েকটি বড়ো বড়ো টাইক তথা ভিক্ষু নিবাস সহ মহাসি মেডিটেশন সেন্টার, উবা কিন্ মেডিটেশন সেন্টার, সামায়ে মেডিটেশন সেন্টার, প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের চট্টগ্রামী ধর্মদূত বুদ্ধ বিহার সহ মাণ্ডালে, পাগান, মেমিও পর্যন্ত বহু প্রাচীন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানেই গেলাম, প্রত্যেকটি প্রসিদ্ধ স্থানে আমাদের জন্যে সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। তবে সে সকল সভায় ৫০ হতে ১০০ জনের উর্ধে নারী পুরুষের সমাবেশ হয়েছে, মান্দালে ইউনির্ভাসীটি সহ মাত্র দু’তিনটি স্থানে। আর আশ্চর্য এই যে, ইয়াঙ্গুনে গাবায়ে শাসন হিতায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মান্দালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোন প্রাচীন তীর্থ স্থানে আবাসিক কোন ভিক্ষুর উপস্থিতি ছিল না। উপস্থিত নারী পুরুষের প্রায় সকলেই পাবলিক প্রশাসনে কর্তব্যরত আর্মি কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য। এবং প্রত্যেকটি তীর্থ স্থান, আর্মি কর্মকতাদেরই তত্ত্বাবধানে; কোন ভিক্ষু বা ভিক্ষু সংঘের নিয়ন্ত্রণে নহে। দেশের উন্নয়ন বলতে যা চোখে পড়লো শুধুমাত্র প্রাচীন মন্দিরগুলোর সংস্কার সাধন ও সাজসজ্জা করণের কাজ এবং কিছু বিশেষ বিশেষ স্থানে আন্তর্জাতিক মানের টুরিষ্ট হোটেল নির্মাণে কাজ। পথে পথে এমনকি ইয়াঙ্গুন, মান্দালে, মেমিওর মতো বড়ো বড়ো নগরে পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো কোন বড়ো বা উচ্চু বহুতল আবাসিক ভবন কোথাও চোখে পড়েনি; চোখে পড়েনি পণ্য সামগ্রী পরিপূর্ণ বড়ো আকারের কোন দোকান বা সপিং কম্প্লেক্স। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায় এমনি আকাশ নেমে আসা বিসত্মীর্ণ সমতল জনশূন্য প্রান্তর, অনাবাদী পড়ে আছে মাইলের পর মাইল। অথচ মাটি গুলো যে খুবই উর্বর, তার প্রমাণ দিচ্ছে জংলা উদ্ভিদ গুলো।
মেমিও সফর শেষে মান্দালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনঃ নিয়ে এসে প্রাচীন রাজ প্রাসাদ, শ্বেত প্রস্তরে উৎকীর্ণ ত্রিপিটকের ৫ম মহাসঙ্গায়নের স্থান, এবং অমরাপুরা মহাটাইক গুলো দর্শন করানোর পর আমাদেরকে। ইয়াঙ্গুনে ফিরায়ে আনতে আগের মতো সামরিক বিমানের ব্যবস্থা করলেও সংঘরাজ ভন্তে সহ কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিয়ে, আমরা কিছু সংখ্যক ট্রেনে ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করলাম, দু’দিকের দৃশ্যাবলী দেখে দেখে যাওয়ার ইচ্ছায়। ট্রেনের পুরো একটা ১ম শ্রেণীর বগী শুধু আমাদের জন্যেই রিজার্ভ করা হলো। প্রতি মধ্যে হঠাৎ বাঙালী চেহারার এক লুঙ্গিপরা লোক ঢুকে পড়লেন আমাদের কম্পার্টমেন্টে। বাঁধা দিলেন আমাদের গাইড। আমরা থাকতে দিলাম, ট্রেন ছেড়ে দিল দেখে। দাঁড়িয়েই ছিলেন লোকটি। পাশে বসতে বললে, অত্যন্ত সংকোচের সাথে বসে পড়লো এই দিবা-রাত্র দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণে। ক্রমে আলাপ জমে উঠলো। নিজের জন্ম মায়ানমারেতে হলেও পিতৃ নিবাস বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায়। হৃদ্যতা আরো গভীর হলো। তিনি দুই নামে রেকর্ডভূক্ত, রার্ষ্টীয় নাম বর্মী ভাষায় এবং পারিবারিক নাম ইসলামী ভাষায়। একপর্যায়ে চম্কে উঠলাম যখন প্রকাশ করলেন, তিনি আন্তর্জাতিক মানের জেম (হীরা) ব্যবসায়ী, ইয়াঙ্গুন, মান্দালে, মেমিও সহ দেশের প্রত্যেকটি বড়ো শহরে তার শো-রুম আছে। অগাধ অর্থবিত্তের মালিক এখানকার প্রায় মুসলিমেরা, নানা প্রকারের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত থেকে। উচুঁমানের চাকুরী ছাড়া, তারা কোন চাকুরী জীবিকা সহজে গ্রহণ করেন না। প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত বাস্তব চিত্রটির পাশাপাশি এবার শুনুন আমাদের ১৮ দিনের ভ্রমণে সেবক গাইডটির কাহিনী। এই ভালো ইংরেজী জানা অফিসার যুবকটি ধর্মমন্ত্রণালয়ে কর্তব্যরত। তিনি ডিগ্রী পাশ, বয়স আমার মনে হলো বড় জোর পঁচিশ। কিন্তু শীর্ণ খাটো দেহী চল্লিশ বছরের যুবকটি বল্লেন, পিতা-মাতা সহ পরিবারে তারা এক ভাই ও এক বোন মাত্র। বোনটি তার বড়ো। তাঁরা চার জনেই চাকুরী করেন। অথচ, আর্থিক কারণে বোনটিকে এখনো বিয়ে দিতে পারছেন না, নিজেও বিয়ে করতে পারছেন না। কথাটি আমার অবিশ্বাস্য ঠেক্লো। তখন তিনি বল্লেন দেখুন, আমি একজন অফিসার হয়েও আমার বেতন মাত্র চার হাজার টাকা। অপরদিকে, চাল এক কেজির দাম ৬০ টাকা, আলু এক কেজি ৪০ টাকা। আমাদের সকলের উপার্জন পারিবারিক ব্যয়েই নিঃশেষ হয়ে যায়। ইয়াঙ্গুনে সামেয়াতা ধ্যান কেন্দ্রে যেদিন আমাদের পরিদর্শন ও মধ্যাহ্ন ভ্রমণের ব্যবস্থা হলো, সেদিন উন্নত মানের ভোজন শেষে জানালা দিয়ে হঠাৎ আমার চোখ গিয়ে পড়লো, অতি নিকটে নীচে গাছ তলায় বসে ভোজনরত নির্মাণ শ্রমিকদের দৃশ্যটি। প্রত্যেকে ছোট্ট একটি মাত্র বক্সে করে ভোজন করছেন নীরবে। আশ্চর্য! এত চেষ্টা করেও আমি খুঁজে পেলাম না, তাঁরা কী দিয়ে ভাতগুলো খাচ্ছেন। ভারী অস্ত্র কাঁধে রাস্তায় পাহারারত সেনাদের দেখলাম, পোষাক ও অস্ত্র দুইই যেন তাদের চেয়ে অনেক ভারী। যেখানেই চোখ যায়, পুষ্টি হীন নর-নারী। তাহলো আমার মা-বাবার মুখে শোনা সেই হুর-পরী সদৃশা বার্মার নারী পুরুষেরা এখন কোথায়?
থাইল্যাণ্ড : অতীতের শ্যামদেশ, চির স্বাধীন বলেই বর্তমানের নাম থাইল্যাণ্ড। নগরের মানুষ গুলোর দেহে মাংস যেন আর ধরে না। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মঙ্গোলীয় চেহারার এ সকল মানুষগুলোকে থাই রাজধানী ব্যাংককে দেখতে দেখতে, আমার এক সময় দৃঢ় বিশ্বাস জেগেছিল পুরো থাইবাসীরাই বুঝি এমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান। কিন্তু না, ব্যাংক্ক থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে ওয়াট্ বাংলাকম-এ একবার বেড়াতে গিয়েই গ্রামীন জীবনের খেটে খাওয়া মলিন-বিবর্ণ মানুষগুলো দেখতে দেখতে আমার সেই স্বপ্ন ঘোর মুহূর্তেই উঠে গেল। ব্যাংককে একদিন হঠাৎ এক থাই মহিলা আমাকে বিদেশী দেখে হাতে তুলে দিলেন কিছু খৃস্ট ধর্মের লিফ্লেট ও বই। আমি চম্কে উঠলাম এজন্যেই যে, থাইমহিলা কি করে বাংলাদেশের মুসলিম ধর্ম প্রচারক তবলীগ পার্টির ন্যায় দায়িত্ব পালনে ব্রত হলো। প্রিয় পাঠক, এটাই চলছে এখন থাইল্যাণ্ডের দারিদ্র তাড়িত প্রায় প্রত্যেকটি গ্রাম-গ্রামান্তরে। নাগরিক বিত্তশালী, অত্যাধুনিক ঐশ্বর্যে ঠাসাঠাসি করা চিরস্বাধীন থাইল্যাণ্ডের দরিদ্র বৌদ্ধ নারীদের এক বিরাট অংশ, সামান্য দু’চারটি ইংরেজী বাক্য মুখস’ করে দেশে বিদেশে পাঁচ তারা দশতারা, হোটেল গুলোতে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তো বিশ্বখ্যাতিই অর্জন করে বসলো! থাই সরকার আরো একটু গর্বের সাথে এর নাম দিল ‘সেক্স-ইণ্ডাষ্ট্রী’ বলে। সেখানকার বৌদ্ধদের বিশ্বাস বুদ্ধ সমকালীন আম্রপালীদের ন্যায় সারাদিন-রাত দেহব্যবসা করে, ভোরে ভিক্ষুদের পিণ্ডদান করতে পারলে, সব পাপ-তাপ ধুয়ে মুছে যায়।
থাইবাসীর বড়ো ভাগ্য এই যে, চাইনিজ বৌদ্ধ ব্যবসায়ীরা সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল ধরেছে। অন্যথায় স্বদেশী মালয়েশিয়ান-মুসলিম, খৃস্টান এবং ভারতীয় সহ বিদেশী বেনীয়ারাই শ্রীলংকার মতো নিয়ন্ত্রণ করতো দেশের পুরো অর্থনীতি।
এশিয়ান বৌদ্ধদের সম্পর্কে পূর্বোক্ত নেতিবাচক সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পর তাঁদের ইতিবাচক দিকগুলোর কিছু বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি। থাই ও শ্রীলংকান বৌদ্ধরা ধর্মীয় যে কোন অনুষ্ঠানে অবশ্যই শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে গমন করেন।
মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড ও শ্রীলংকার প্রতিটি বিহারের সপ্তাহের ছুটির দিনে সকাল বেলায় স্কুল, কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বৌদ্ধ আচার ব্যবহার এবং ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। ছুটির দিনে বিকেলে বয়স্ক ও যুবক-যুবতীদেরকে ধর্মদেশনার আয়োজন হয়ে থাকে। প্রতিমাসের পূর্ণিমাতে নারীপুরুষ সকলেই উপোসথ ব্রত পালন, ধ্যান অনুশীলন, ধর্মদেশনা শ্রবণ এবং সূত্রাদি আবৃত্তির বিশেষ আয়োজন করা হয়। থাইল্যাণ্ডে দীর্ঘ ছুটির দিনে স্কুল কলেজের ছাত্রদেরকে প্রব্রজ্যা এবং ছাত্রীদেরকে অষ্টাঙ্গ উপোসথ ব্রত পালনে দীক্ষা দিয়ে ধ্যান অনুশীলন ও বৌদ্ধ আচার নীতি শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়। এমন ছুটিতে বয়স্করাও প্রব্রজ্যা গ্রহণ ও উপোসথ ব্রত পালন করে থাকেন।
মহাযান বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মধ্যেও কোন কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ইদানিং থেরোবাদী বৌদ্ধদের ন্যায় পূর্বোক্ত আচার প্রথার প্রবর্তন করা হচ্ছে। তবে তাদের মধ্যে গৃহীদের সাময়িক প্রব্রজ্যা গ্রহণ ও উপোসথ ব্রতপালনের প্রথাটি নেই। অথচ এই দুই প্রথার মাধ্যমেই ভিক্ষু ও গৃহীরা পরষ্পরকে সবিশেষ অনুধাবনে সক্ষম হন এবং অন্তরঙ্গতাও সবিশেষ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। মহাযানীদের মধ্যে ইদানিং খৃস্টীয়ান সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তাঁদের অনেক কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাইপে হতে ‘দি কর্পোরেট বডি অব বুড্ডিষ্ট এডুকেশন’ নামক প্রতিষ্ঠানটির বিনামূল্যে বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধধর্মীয় গ্রন্থ বিতরণের উদ্যোগটি অতীব প্রশংসনীয়। জাপানী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’, রেডক্রস-ইত্যাদি খৃষ্টীয়ান মানবিক সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গত জনগণের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। তবে, এই ধনী বৌদ্ধরা নিজস্ব সংস্থা সংগঠনের মাধ্যমে এ সকল মানবিক সেবা করতে পারলে সবচেয়ে উত্তম হতো।
এশিয়ান বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ায় ইদানিং কালে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চায় সাড়া জেগেছে বলে শোনা যায়। দুইভাবে এই জাগরণ ঘটছে বলে আমার ধারণা হয়। থেরোবাদী এশিয়ান রাষ্ট্র সমূহ এতে প্রসারিত বিদর্শন এবং জাপানী জেন-এ দুই পদ্ধতির ধ্যানের প্রতি পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ। অপরদিকে নোবেল বিজয়ী তিব্বতী ধর্মগুরু দালাইলামা সহ তাইওয়ান, কোরিয়ান ও ভিয়েতনামী মহাযানী ধর্মগুরুদের দ্বারা এ সকল পশ্চিমা দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ যথেষ্ট বাড়ছে। তবে, এই বৃদ্ধি এখনো পর্যন্ত সত্যই কি তেমন আশা ব্যঞ্জক? যদি তাই হতো, তবে তো দেখতে পেতাম ‘ইস্কনের’ মতো বৌদ্ধধর্মও এই পশ্চিমা দেশ সমূহের প্রধান প্রধান ধর্ম-মতসমূহের অন্যতম বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করতো। ‘ইস্কন’ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলাস’ শ্রী গৌরাঙ্গের প্রবর্তিত ‘বৈষ্ণবীয়-দর্শনের’ প্রচার মিশন সমূহের একটি। এই মিশন অতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বৈষ্ণবীয় দর্শনকে পশ্চিমা জনসমাজে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গিয়ে রাশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছে। পশ্চিমা ইস্কন অনুরাগীদের তুলনায় বৌদ্ধ অনুরাগীর সংখ্যা তত কম নহে। কিন্তু, এই পশ্চিমা বৌদ্ধ অনুরাগীরা সমাজ বদ্ধ হওয়া বা সংগঠিত হওয়ায় তেমন উৎসাহী নহেন। তাঁদের বৌদ্ধ ধর্মানুরাগ তাই, নিতান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়েই রয়ে গেছে। আর এ কারণেই পশ্চিমা দেশ সমূহে বৌদ্ধধর্ম অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি অর্জনে অক্ষম হয়ে রইলো।
ঠিক পশ্চিমাদের ন্যায় একই মনোবৃত্তির লালন চলেছে ভারতীয় বৌদ্ধ জাগরণের ক্ষেত্রেও। ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর যেই পরিকল্পিত উপায়ে লক্ষ লক্ষ অনুসারী সহ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন; সেই পদক্ষেপ তাঁর হঠাৎ মহাপ্রয়াণে ভীষণভাবে মৃয়মান হয়ে পড়লেও, তা এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায়ে যিনি বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজাগরণের নেতৃত্ব পেলেন, তিনি হচ্ছেন বিশ্বখ্যাত বিদর্শনাচার্য শ্রী সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কাজী। কিন্ত, তিনি ভারতের বুকে বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজাগরণই কেবল ঘটাচ্ছেন, পুনঃপ্রতিষ্ঠা নহে। তিনি বিশ্বের সকল ধর্ম মতালম্বীকে এই বলে আহ্বান জানাচ্ছেন; “আপনারা স্ব স্ব ধর্মবিশ্বাস কিছুদিনের জন্যে ফেলে রেখে নিরপেক্ষ মনে একটি বার বুদ্ধ ধর্মকে অনুভব করে যান। গ্রহণযোগ্য হলে, গ্রহণ করে উপকৃত হোন।” তাঁর এই সাদর আহ্বানটি, এখানেই নিজ দায়িত্ব শেষ করে দিল। গোয়েঙ্কাজী এবং তাঁর অনুসারীরা এক্ষেত্রে ‘বুদ্ধের সম্পদ’কে বিতরণের দায়িত্বই কেবল নিলেন; কিন্তু সেই সম্পদ রক্ষা ও সমৃদ্ধির দায়িত্ব নিলেন না। এই রক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্যেই ভগবান বুদ্ধ সংঘের জন্ম দিয়েছিলেন। আর সেই সংঘকে রক্ষা করতে বিনয়-বিধান প্রজ্ঞাপিত করেছিলেন। কিন্তু, গোয়েঙ্কাজী বুদ্ধের এই সংঘের প্রতি কেবল উদাসীনতাই প্রদর্শন করলেন না, তিনি আপন অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন, ভারতের ভেতরে ও বাইরে তাঁদের কোন প্রতিষ্ঠান যেন ভিক্ষুদ্বারা পরিচালিত না হয়। গোয়েঙ্কাজীর এ সিদ্ধান্ত পূর্ণাঙ্গ না, অপূর্ণাঙ্গ?
বৌদ্ধ প্রধান নেপাল রাজ্যের ব্রাহ্মণেরা, বৌদ্ধদেরকে মহাযানী-হিন্দু বানিয়ে, রাজ্যটিকে বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র বলে ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে ভুটান রাজ্যটি বৌদ্ধ-বজ্রযানের আশীর্বাদে ভারতের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়ে আছে। বৌদ্ধ প্রধান রাষ্ট্র সিকিম আরো একধাপ এগিয়ে ভারত সাগরেই আত্ম বিসর্জন দিল। বাংলাদেশী বৌদ্ধ, যারা অনুবীক্ষণ-সংখ্যালঘু বলে পরিচিত, তারা কেমন আছেন এই মুসলিম প্রধান দেশটিতে? সংখ্যা লঘুত্বে সার্বজনীন অভিশাপটির সাথে এখানে যুক্ত হয়েছে, বৌদ্ধদের মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রীময় ভ্রাতৃত্ব বোধের চরম অভাব। এ কারণে সব সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকতে হচ্ছে এদেশের বৌদ্ধ সমপ্রদায়টিকে।
বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধদের চলমান বিপদ ও বিপর্যয় সমুহ হতে আত্মরক্ষা করতে হলে নিন্মোক্ত বিষয় গুলো বাস্তবায়িত করা একান্ত প্রয়োজন মনে করি :-
(১) সর্বপ্রথম বুদ্ধের ধর্মসেনা নামক বর্তমান তরুণ ভিক্ষু সংঘকে অবশ্যই বুদ্ধ এবং বুদ্ধ সমকালীন আদর্শ ভিক্ষুদের আচরিত জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটি গভীরভাবে উপলব্ধি করণের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
(২) দ্বিতীয়তঃ উপসম্পদা গ্রহণকালীন সময়ে ভিক্ষুদেরকে চারিটি অনিবার্য আশ্রয় গ্রহণের জন্য যেই প্রতিজ্ঞা করানো হয়, সেই প্রতিজ্ঞা সমূহ অভ্যস’ করতে মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর মতো প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
(৩) প্রব্রজ্যাপ্রার্থী প্রতিটি তরুণ কূলপুত্র প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষু উপসম্পদা গ্রহণের পূর্বে গৃহী অবস্থায় যতদুর পর্যন্ত স্কুল কলেজের ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়, ততদুর পর্যন্ত সমাপ্ত করে, উপসম্পদা গ্রহণের পর প্রথম দিকে শুধুমাত্র বুদ্ধবাণী ত্রিপিটক শাস্ত্রের উপর যতদুর সম্ভব অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ দান করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে পালি ভাষা সহ অতি প্রয়োজনীয় জাতীয় ও আন্তজার্তিক কয়েকটি ভাষা আয়ত্ব করানো একান্ত প্রয়োজন। কারণ একজন ভিক্ষুর জন্যে নানা ভাষার জ্ঞানই বুদ্ধের বাণীকে প্রচার প্রসারে, অনির্বায ভাবে প্রয়োজন হয়। তবে এসকল ভাষা জ্ঞান আয়ত্বের আগে তরুণ ভিক্ষুটিকে আত্মরক্ষার্থে, ধর্ম বিনয়ের উপর প্রাথমিক জ্ঞানটুকু অর্জনের পরপরই, ধ্যান বিদর্শন অনুশীলনে কমপক্ষে সাতটি বছর, অবশ্যই গভীর আত্মনিয়োগের জন্য নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
(৪) উপরোক্ত ভাবে একজন তরুণ ভিক্ষুর জীবন বুদ্ধ শাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তিনি বুদ্ধের ধর্মের প্রচার প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই সাফল্যমন্ডিত হবেন। যে সকল দেশে ভিক্ষুণী সংঘ অথবা অনাগারিকা সংঘ বিদ্যমান আছেন, তাঁদেরকেও ঠিক একই নিয়মে দক্ষতা দান করলে, তারাও সমসাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবেন-এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই ব্রহ্মচারী ভিক্ষুণীদেরকে যে কোন অবস্থায়, পুরুষের সহজ সান্নিধ্য হতে দূরে থাকার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।
(৫) ধর্ম বিনয় এবং শীল সমাধিতে সমৃদ্ধ ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, অনাগারিক, অনাগারিকাকে সমাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, ব্যবহারিক শিক্ষানীতি, বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মদর্শন ও রাজনীতির উপরে তুলনামুলক জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। ফলে তারা যেখানেই অবস্থান করবেন, সেখানেই জনসমাজের ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে একজন আদর্শ শিক্ষকের ন্যায় ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
এভাবেই বৌদ্ধ ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, অনাগারিক, অনাগারিকা নামের এই ধর্ম সেনাদের দ্বারাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বুদ্ধ শিক্ষার প্রসারণ ঘটানো সম্ভব। এ আলোকে বিশ্বের যে কোন ধর্ম সমপ্রদায়ের মাঝে বুদ্ধের এই ধর্মসেনারা সকল ধর্ম সমপ্রদায়ের মাঝে স্ব সমপ্রদায়কে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের এবং প্রগতি শীল জীবন সমৃদ্ধিতে ধারণ করতে সক্ষম হবেন। তাই আমাদের প্রার্থনা, হে বুদ্ধ! তোমার জ্ঞান প্রজ্ঞা সম্যক্ ভাবে জেগে উঠুক-প্রতিটি বুদ্ধানুরাগী ভিক্ষু-গৃহীর হৃদয়ে। সকলেই মঙ্গল দর্শন করুন।