বৌদ্ধনাথ মন্দির নেপালের বৃহত্তম গোলাকার বৌদ্ধমন্দির বা স্তূপাগুলোর অন্যতম। শুধু নেপালের মধ্যে নয়, এমন স্তূপা সারা পৃথিবীতেই বিরল। এ মন্দির ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া এ মন্দির নেপালিদের কাছেই নয়; সারা পৃথিবীর বৌদ্ধদের কাছেও প্রার্থনার পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। ঘুরে এসে লিখেছেন গাজী মুনছুর আজিজসকালে বৌদ্ধনাথ মন্দিরে যখন পা রাখি, তখন প্রার্থনা চলছে। আর প্রার্থনার দিন হওয়াতে মন্দির প্রাঙ্গণজুড়ে পুণ্যার্থীদের ভিড়। সেই সঙ্গে পর্যটকের ভিড় তো আছেই। কাঠমান্ডুর থামেল থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরের এ মন্দিরের চারপাশে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, আর্ট স্কুল, আর্ট গ্যালারি, স্যুভেনির শপসহ নানা পণ্যের দোকান। আর মাঝখানে বৌদ্ধ মন্দিরটি। যেন এক মন্দিরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এক শহর।
নেপালের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এ বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপা নেপালের বৃহত্তম গোলাকার বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপাগুলোর অন্যতম। কেবল নেপালের মধ্যেই নয়, এমন স্তূপা সারা পৃথিবীতেই বিরল। সেজন্য এ মন্দির ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া এ মন্দির সারা পৃথিবীর বৌদ্ধদের কাছেও প্রার্থনার পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে তিব্বতি বৌদ্ধদের কাছে এ মন্দির অন্যতম তীর্থস্থান। সে জন্য মন্দির প্রাঙ্গণজুড়েই দেখি বিভিন্ন দেশের পুণ্যার্থীদের মুখরিত পদচারণা।
আমরা মন্দিরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখি। স্যুভেনির শপ বা দোকানগুলোতে ঢুকে নানাচাড়া করে দেখি এখানকার ঐতিহ্যবাহী খুরকি (খাপওয়ালা এক ধরনের ছুরি), পুঁথির মালা, মুখোশ, কাঁসা-পিতলের মূর্তি, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিক, ট্যাপেস্ট্রি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার ছবি সংবলিত মগ, চাবির রিং, ক্যালেন্ডার, শুভেচ্ছা কার্ডসহ নানা ধরনের পর্যটন স্মারক। আর্ট গ্যালারিগুলোতেও ঘুরি। মূলত এসব আর্ট গ্যালারি চিত্রকর্মের বিক্রয় কেন্দ্র। সব দোকানেই পুণ্যার্থী বা পর্যটকের ভিড় আছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্টে বসি চা খাওয়ার জন্য। এ রেস্টুরেন্টেও ভিড় দেখি পুণ্যার্থী ও পর্যটকের। চা খেয়ে আবার ঘুরতে শুরু করি।
নেপালের ভাষায় এ মন্দির ‘খাতি’ নামে পরিচিত। আর তিব্বতের ভাষায় পরিচিত জিহরং খাশর নামে। মন্দির প্রাঙ্গণে মন্দিরের বর্ণনা সাঁটানো। সেখানেই জানা যায় মন্দিরের বিস্তারিত। সমতল থেকে গোলাকার এ মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত উচ্চতা ১১৮ ফুট। প্রথম পর্যায়ে আছে ৫টি স্তর। এগুলো বৌদ্ধের প্রাসাদ। এ প্রাসাদ ইট-সিমেন্টের তৈরি। প্রাসাদের ওপর গোলাকার গম্বুজ। এ গম্বুজ মহাবিশ্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এ গম্বুজও ইট-সিমেন্টের তৈরি। এ গম্বুজের ওপর চার কোণাকৃতির চূড়া। সোনালি রঙের এ চূড়া সোনায় মোড়ানো বিভিন্ন ধাতব দিয়ে তৈরি। চূড়ার প্রথম কিছু অংশ সমান। এ সমান অংশটুকু আটটি রাস্তার প্রতীক। চূড়ার এ সমান অংশের চারপাশে দুটি করে চোখ ও একটি করে নাক আঁকা। এই চোখ-নাক জ্ঞান ও নির্বাণের প্রতীক। সমান অংশের পর থেকে পিরামিডের মতো ১৩টি ধাপে উঠে গেছে চূড়া। এ ধাপগুলো আলোকায়ন বা জ্ঞানদানের স্তরের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তার পর আছে পদ্ম। এ পদ্ম সমবেদনা ও বিশুদ্ধতার প্রতীক। তার পরের অংশটি ছাতা হিসেবে বিবেচিত। এ ছাতা তিন রত্ন- বৌদ্ধ, ধর্ম ও সংঘকে রক্ষার প্রতীক। এ ছাড়া চূড়ার শেষ বিন্দু বা অংশটুকুকে সব পাহাড়ের রাজার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর পুরো মন্দিরটি গড়ে উঠেছে ৬,৭৫৬ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে।
ইতিহাসের পাতায় এ মন্দির স্থাপনার কাহিনী নিয়ে রয়েছে নানা মত। কারও কারও মতে, নেপালের গোপাল রাজাবংশাবলির (গপু) মতে, বৌদ্ধনাথ স্তূপা লিচ্চবি রাজ সিবাদেব (৫৯০-৬০৪ খ্রিস্টাব্দ) বা রাজা মানদেব (৪৬৪-৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করেন। তবে তিব্বতিয়ানদের দাবি অনুযায়ী, খনন করতে গিয়ে ১৫ শতাব্দীর শেষদিকে এখানে রাজা অংশুভার্মার (৬০৫-৬২১ খ্রিস্টাব্দ) হাড় খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রচলিত আছে, তিব্বতি রাজা ত্রিসং দেটসান (৭৫৫-৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ) এই স্তূপার সংস্কার কাজে জড়িত ছিলেন।
মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে কিছুটা পরপর ড্রাম আকৃতির দৃষ্টিনন্দন প্রার্থনার হুইলার আছে। কাঁসা-পিতল বা বিভিন্ন ধাতবের তৈরি এ হুইলারে খোদাই করে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বাণী লিপিবদ্ধ আছে। কিছু হুইলার ছোট আবার কিছু হুইলার বড়। পুণ্যের আশায় এ হুইলার ঘুরান মন্দিরে আসা পুণ্যার্থীরা। তবে বিশাল একটি হুইলার আছে মন্দিরে ওঠার ঠিক বিপরীতে একটি ঘরের মধ্যে। দোতলা এ ঘরের নিচতলায় আছে এ হুইলারটি। সম্ভবত এ ঘর মন্দিরেরই কার্যক্রম পরিচালনার কার্যালয়। এ ঘরের সামনে বেশ বড় একটি পিতলের ঘণ্টা বাঁধা। এ ছাড়া মন্দিরের চারপাশে লম্বা লম্বা স্টিলের খুঁটিতেও প্রার্থনার হুইলার লাগানো আছে। আর মন্দিরের একেবারে চূড়া থেকে নিচ পর্যন্ত ঝুলানো আছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ও সাদা রঙের কাপড়ের ছোট ছোট পতাকা। মূলত এ পতাকাও ঝুলানো হয়েছে পুণ্যের আশায়। আছে মন্দির প্রাঙ্গণজুড়ে অসংখ্য কবুতরের ওড়াউড়ি। পুণ্যের আশায় এসব কবুতরকে মন্দিরে আসা পুণ্যার্থীরা চাল বা গম জাতীয় খাবার ছিটিয়ে খেতে দেন।
অবশ্য ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালের অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সঙ্গে এ মন্দিরের ওপরের চূড়াটিও ভেঙে যায়। পরে চীনের সহযোগিতায় এটি সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরের বর্তমান রূপটি সংস্কারের পরের।
মন্দিরের চার পাশে ঘুরতে ভালোই লাগছে। সত্যি সত্যিই মনে হয়, মন্দিরকেন্দ্রিক এক শহর। আর এ শহরে ইউরোপ-আমেরিকাসহ নানা দেশের পর্যটকের অভাব নেই। আর পুণ্যার্থীদের শুভ্রতার পরশ তো আছেই। সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতো স্থান। সময় থাকলে পুরো দিনই থেকে যাওয়া যায় এখানে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। যেতে হবে আরও অনেক স্থানে।
মন্দিরে ঢোকার অনেক গেট। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে ৫০ রুপির টিকিট কেটে আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকেছি, সেই গেট দিয়েই বের হই। রিজার্ভ করা ট্যাক্সিচালক আমাদের নিয়ে রওনা হন অন্য দর্শনীয় স্থানের দিকে।